বাংলাদেশের বাঙালি যতো দূরেই যাক, দেশ তার সঙ্গে সঙ্গে যায়। প্রবাসী বাঙালির হৃদয়ে বাংলাদেশ থাকে অষ্টপ্রহর। বাংলাদেশকে বুকে নিয়েই সে ঘুমায়, জাগে। শরীরটা প্রবাসে থাকলেও মন তাঁর পড়ে থাকে প্রিয় বাংলাদেশেই। কায়ার সঙ্গে ছায়া হয়ে জড়িয়ে থাকে প্রিয়তম স্বদেশ, দিবানিশি। ব্যস্ততায় কাজের ফাঁকেও ল্যাপটপ মনিটর কিংবা সেলফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনজুড়ে ফুটে থাকে তার বাংলাদেশ।
১৩ অক্টোবর বিকেলের যাই যাই রোদের একেবারে শেষ বিভাটুকু ফুরিয়ে যাবার লগ্নে তন্দ্রা আর সুদীপ্ত সরকার আমাকে নিয়ে গেলো হিউস্টন শহরের রেন রোডের সাইনট এর কর্ণারে নাইজেরিয়ান চার্চের পাশে বাংলাদেশ সেন্টারের সবুজ ঘাসের চত্বরে। এখানকার স্বপ্নবান বাঙালিরা বাংলাদেশ আমেরিকান সেন্টার-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেশ ক’বছর আগে। অতঃপর ৩/৪ একর জমি তাঁরা কিনে নিয়েছিলেন, দৃশ্যমান একটা বাংলাদেশ সেন্টার গড়বেন বলে। বিশাল জায়গাটা প্রায় অব্যবহৃতই পড়ে আছে এখনো। তবে সেখানে মাথা উঁচু করে গৌরবের সৌরভ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেছে শ্বেতশুভ্র শহিদ মিনার। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে।
২০০৯ সালে এই শহিদ মিনারটি নির্মিত হয়েছে। নিউ ইয়র্কবাসী শিল্পী ও ভাস্কর তানভীর সারওয়ার রানার মমতা আর দক্ষতার মিশেলে নির্মিত হয়েছে চমৎকার এই স্থাপনাটি। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে মিনারের পেছনে টুকটুকে লাল সূর্যের বৃত্তটিও বাদ যায়নি। মূল মিনারের সঙ্গে শাদার প্রেক্ষাপটে কালো অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছে–‘মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা।’ পেছনে উডেন সীমানা প্রাচীরে মোটা ব্রাশের নিপূণ টানে শিল্পী রানা শাদা রঙের দ্যূতিময় বিন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাভাষার অপরূপ বর্ণমালার নিদর্শনসমূহ। অ আ থেকে চন্দ্রবিন্দু এবং আকার একার ওকার হ্রস্য উকার থেকে যতি চিহ্নের সব ক’টা অবয়ব যেনো বা অপূর্ব সিম্ফনি তুলে সম্মিলিত কণ্ঠে ঘোষণা করছে আমাদের ভাষা শহিদদের অমর কীর্তিগাঁথা।
শহিদ মিনারের সামনে সামান্য উঁচু একটা মুক্তমঞ্চ আছে। একুশের-স্বাধীনতার-বিজয়ের-বৈশাখের কিংবা দিবসহীন যে কোনো আয়োজন যেমন আবৃত্তি-নাটক-সঙ্গীত-আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্যে এই মুক্তমঞ্চ চমৎকার একটা ভ্যেনু হতে পারে।
এখানেই দেখা হলো অলি মোহাম্মদ নামের এক অদ্ভুত দেশপ্রেমিক বাঙালির সঙ্গে। ঢাকার খিলগাঁও-এ নিবাস ছিলো একদা। দেশ ছেড়েছেন ১৯৮৪ সালে। কেনিয়ায় ছিলেন কিছুকাল। হিউস্টন শহিদ মিনার কমিটির চেয়ারম্যান তিনি। আমার মতো নগন্য এক ছড়াকারের অপেক্ষায় এখানেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। হিউস্টনে শহিদ মিনার নির্মাণের পেছনে শ্রম ও মেধা দিয়েছেন বলে আমি তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে নিজের কৃতিত্ব অস্বীকার করার পাশাপাশি সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বললেন।
অলি মোহাম্মদদের মতো বাঙালিরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে আছেন বলেই আমাদের অস্তিত্বের আমাদের চেতনার আমাদের পরিচয়ের স্মারক একুশের শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে টোকিওতে, নিউইয়র্কে, নিউজার্সিতে এবং সিডনিতে। আগামীতে টরন্টোতেও নির্মাণ হতে যাচ্ছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের গৌরব এই শহিদ মিনার।
সন্ধ্যার আগমনীর আবছা হয়ে আসা আলোয় বাংলাদেশ সেন্টারের শান্তসৌম্য মাঠে একুশের ভাষাশহিদ সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের পাশাপাশি আমার মস্তিষ্কে অণুরণিত হচ্ছিলো আরো কয়েকটি নাম–আবদুল গাফফার চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, হামিদুর রহমান, নভেরা–আহা কী উজ্জ্বল থোকা থোকা! তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলতাফ মাহমুদের নাম এবং মুখচ্ছবি আমার চারপাশে কেমন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিলো।
হিউস্টনের সেই বিকেলটায় চমৎকার মৃদুঠান্ডার ছোঁয়াচ লাগানো একটা বাতাস বইছিলো, এলেমেলো। সেই বাতাসে কেমন একটা বিষণ্ণতার প্রলেপ মাখানো ছিলো। আর সেই বিষণ্ণ বাতাসের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদের করুণ অর্কেস্ট্রা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। চার্চ সঙ্গীতের আবহে পিয়ানো এবং ভায়োলিনের অভূতপূর্ব সম্মিলনিতে আলতাফের সুরের মূর্ছনায় হিউস্টনের বাতাস আমার কানে কানে গেয়ে উঠছিলো রক্তে শিহরণ জাগানিয়া গান–আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…
হিউস্টন ১৯ অক্টোবর ২০১৮ [আলোকচিত্র/ সুদীপ্ত সরকার]
নোট: বাংলাদেশের খ্যাতিমান ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন’র ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া।