ফিচার

হাওরের শরৎ -সাইফুল হক মোল্লা দুলু

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৬

কবি জীবনানন্দ দাশ কখনও হাওর ভ্রমণে এসেছিলেন কিনা কিংবা তিনি কখনও নিজের চোখে হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। তবে, বরিশালের ধানসিঁড়ি নদীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি তাঁর কাব্যের পরতে পরতে বাংলার প্রকৃতি, বন-বনানী আর হিজল-তমালের যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন-তা পড়ে যে কোন বাঙালিরই মনে হতে পারে, জীবনানন্দ বারবার ছুটে এসেছেন দিগন্তবিস্তৃত হাওরের অবারিত নীলিম সৌন্দর্যে।

তাঁর রূপসী বাংলা কাব্যের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছড়িয়ে আছে আবহমান বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক রূপ। তাঁর বর্ণনায় প্রকান্তরে যেন হাওরের সৌন্দর্যই বিধৃত হয়েছে। বিশেষ করে শরৎকালে কিশোরগঞ্জের সুবিশাল হাওর জুড়ে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এক কথায় তা মনোমুগ্ধকর।

তাই হয়ত কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যে ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছেন-

‘এখানে আকাশ নীল

নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে

হিম শাদা রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;

আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ রৌদ্রের দুপুর ভরে।

হাওর দেখলে বিশাল সাগরের দৃশ্যই চোখে ভাসে। কারণ হাওর শব্দটিও এসেছে সাগর শব্দের অপভ্রংশ হিসেবে। সাধারণত বর্ষাকালে হাওর ধারণ করে রুদ্ররূপ। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। থৈ-থৈ উর্মিমালার প্রচন্ড গর্জনে সর্বগ্রাসী রূপ নেয় হাওরের জনপদ। এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে শরৎকাল। এ সময়ে আকাশের গভীর নীল যেন আকাশের সীমানা ছেড়ে নেমে আসে হাওরের থৈ থৈ জলে। মনে হয় আকাশ যেন হাওরের জলে ছড়িয়ে দিয়েছে নীলাম্বরী শাড়ির নীলাভ আঁচল।

মন ভাল করে দেয়ার মতো এই অপার নান্দনিকতা মুগ্ধ করে প্রতিটি মানুষকে। শরৎ এলে তাই নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে অনেকেই ছুটে যান নৌ-বিহারে। এ যেন এক অন্য বাংলাদেশ। যেখানে প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে গেছে মানুষের জীবন-জীবিকা। সরেজমিনে হাওর ঘুরে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম-ইটনা-মিঠামইন-নিকলী এ চার হাওর উপজেলা বর্ষাকালে চতুর্দিক পানির মাঝে বন্দি থাকে। যেদিকে চোখ যায় দেখা যায় শুধু পানি আর পানি। পানির মাঝে ভেসে থাকে কিছু গ্রাম যা দেখলে মনে হয় জনমানব শূন্য কিছু ভাসমান দ্বীপ। কিন্তু পানির মাঝে এসব ভাসমান গ্রামে হাওরবাসীর বসবাস। আর বর্ষাকালে এসব গ্রামের মানুষদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। হাওরে বসবাসরত মানুষদের কাছে হাওরের সৌন্দর্য বরাবরের মতোই।

তবে শরৎকালে হাওরে নীল আকাশ, নীল আকাশের বিছানায় মাঝে মাঝে সাদা সাদা মেঘ ছুটে যাচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। আবার আকাশের মন খারাপ থাকলে সাদা সাদা মেঘেগুলো কালো আকার ধারণ করে বাতাসের সাথে বৃষ্টিতে আফাল (হাওরে বাতাসের ঢেউ) বয়ে আনে। এই আফালে ভেঙ্গে যায় হাওরের অনেক বসতবাড়ি।

ভরা বর্ষায় এক তপ্ত দুপুরে দেখা যায়, বিশাল হাওরে পানি আর পানি। পানির উপরে দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। আকাশ পুরোটাই নীল রঙে আবৃত। শরৎকালে মনে হবে নীল আকাশের নীল রং হাওরের পানিতে ছুঁয়ে পড়ছে। আর মাঝে মাঝে মৃদু বাতাসে হাওরের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ সৃষ্টি করছে। শরৎকালের এমনদিনে হাওরে অথৈ পানিতে নৌকা নিয়ে ঘোরাফেরা করলে শীতল হাওয়া, নীল আকাশে মেঘের ছোটাছুটি দেখলে মলিন মুখেও আনন্দের দোলা দিয়ে যাবে।

ছড়াকার ও লোকসংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান বলেন, উজান-ভাটির মিলিত ঐশ্বর্যে কিশোরগঞ্জ এক নান্দনিক পলিমাটির জেলা। এ জেলার প্রধান আকর্ষণ সুবিস্তৃত হাওর। হাওরকে কেন্দ্র করে এ জেলায় গড়ে উঠতে পারে সৌন্দর্যের এক চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র। সেটি গড়ে তোলা সম্ভব হলে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিনোদন পিয়াসী মানুষেরাও পাবে ভ্রমণের অমল আনন্দ। প্রকৃত বাংলাদেশকে চিনতে হলে হাওরের প্রকৃতিকে চিনতে হবে। দেখতে হবে হাওরের অপরূপ সৌন্দর্যের নান্দনিক দৃশ্য। আকাশ, হাওরের বাতাস, হাওরের পানি, হাওরের গাছপালা এটাই হচ্ছে পূর্ব বাংলা। হাওরকে না দেখলে বাংলাকে চেনা যাবে না। বাংলার প্রকৃত রূপ দেখতে হলে হাওরে আসা উচিত।

dulu

সাইফুল হক মোল্লা দুলু: সাংবাদিক, লেখক।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment