মানুষ- সমাজ

জীবন নিজেই তার প্রেরণা: সৈয়দ শামসুল হক

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬

সৈয়দ শামসুল হক বাংলাসাহিত্যের বিস্ময়কর চিরতরুণ। ছয় দশকের বেশিকাল ধরে এক অনিঃশেষ সৃজন-জীবন উদযাপন করেছেন তিনি। সাহিত্যের প্রায় সব মাধ্যম ছাড়াও সঙ্গীত-নাটক-চলচ্চিত্র-চিত্রকলা-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি সবল। তাই ‘সব্যসাচী’ অভিধাটি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর নামের সমার্থক। তাঁর ৮০তম জন্মদিনকে সামনে রেখে ভিন্নধর্মী এক আলাপচারিতায় মিলিত হয়েছিলেন কবি সৈকত হাবিব, যা দৈনিক ইত্তেফাকে মুদ্রিত হয়। তাঁর প্রয়াণের পর লেখাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে নরসুন্দা ডটকমের পাঠকদের জন্য এখানে পুনর্মুদ্রণ করেছি।

[শুরুর আগে: এ ছিল দীর্ঘ-আকাঙ্ক্ষা। সৈয়দ হকের জীবনবেদ ও শিল্প-অভিজ্ঞতা তার মুখ থেকেই শোনা। বিভিন্নভাবে তাঁর সান্নিধ্য ও স্নেহলাভের সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও নিবিড় ও প্রায়-আনুষ্ঠানিক বসা হয়ে উঠছিল না। আচমকা সুযোগটি করে দিলেন ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক অনুজসম মাইনুল শাহিদ। হঠাৎ করেই তাঁর অনুরোধ; প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হক ভাইয়ের কাছে সময়-প্রার্থনা এবং সম্মতিলাভ। পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় ‘মঞ্জুবাড়ি’তে সময়প্রাপ্তি। যেন স্বপ্নের মতো ঘটে গেল সব।

১৯ ডিসেম্বর, শুক্রবার। যথাসময়ে হাজির হলাম গুলশানের বাড়িটায়। মরুভূমি-ঢাকায় এই বাড়িটা আমার কাছে মরুদ্যানের মতো। কারণ, এর সুপরিসর ও আরণ্যক পরিবেশ ছাড়াও বাড়িকর্ত্রীর মাতৃস্নেহ। বাড়িটির নামের কল্যাণে যার ‘মঞ্জু’ ডাকনামটিও ইতিহাস হয়ে আছে- সুলেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক। ছুটির দিন, তাই ভাগ্যক্রমে তাঁকেও পেয়ে গেলাম। এক পর্যায়ে তিনিও আমাদের আসরে হাজির হলেন।

বাড়িতে ঢুকে সালাম পাঠাতেই উপস্থিত হলেন কাঙিক্ষত চিরসবুজ। আশির কোঠায় পৌছেও যিনি তরুণ, দৃঢ় আর তুমুল স্মার্ট। এই শীতেও উষ্ণতা ছড়িয়ে বসলেন নিজের আসনে। আমার সঙ্গী তরুণ লেখক-সম্পাদক স্নেহভাজন ইমরান মাহফুজ রেকর্ডিং-আয়োজন করার ফাকে নগণ্য উত্তরসূরি হিসেবে জানালাম আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি: ‘হক ভাই, কদিন পরই আপনি আশি বছরে পা দিতে যাচ্ছেন। আপনি ঈর্ষণীয়ভাবে তরুণ এবং এখনো সক্রিয়। এজন্য আপনাকে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।’
এরপরই শুরু করি আমাদের সেই কাঙিক্ষত আলাপ, প্রায় দেড় ঘণ্টার। এখানে পাঠকদের জন্য কেবল তার সারটুকু…]

সৈকত হাবিব: আপনার সাথে রবীন্দ্রনাথের বেশ মিল আছে। একই সাথে আপনি যেমন তাঁর মতো শিল্প-সাহিত্যের সব মাধ্যমে কাজ করেছেন, তেমনি বয়সের দিক থেকেও আপনি তাঁকে ছুতে চলেছেন। কেমন লাগছে?
সৈয়দ শামসুল হক: [খুব উদ্ভাসিত স্বরে] রবীন্দ্রনাথের সাথে মিলিয়ে আমি নিজেকে দেখি না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতো, আমি আমার মতো। আর অনেকগুলো মাধ্যমে কাজ করার যে বিষয়টি, হ্যাঁ সেটা আমি করি। বিশেষ করে ভাষায় তো বটেই আর ভাষাটাই আমার মাধ্যম। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এগুলো হচ্ছে উপায় মাত্র। ভাষা দিয়ে এই উপায়ে নিজের কথাকে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি সংকেতে, ইঙ্গিতে। সবটাই তো আর সম্পূর্ণ তৈরি করা যায় না। যা মনের মধ্যে থাকে, সবটা কি ধরা যায় লেখার ভেতরে? রবীন্দ্রনাথও পারেননি। কোনো কবি, লেখক, শিল্পীই পারেন না। কল্পনায় যা থাকে, তার সঙ্গে যা হলো, তার সঙ্গে দূরত্ব থেকেই যায়। সেই অর্থে সংকেতে, ইঙ্গিতে চেষ্টা করে যাওয়া, যতদূর পৌছুতে পারা যায়। এই চেষ্টা করেই এতদিন পার করে এলাম। হ্যা…ভালোই লাগছে। এবং এখনো মনে হচ্ছে না যে, হাল ছেড়ে দেবার সময় এসেছে বা বসে পড়বার জন্য ডাক এসেছে। আগের মতোই তো আছি।

সৈকত: এই যে অপূর্ব প্রাণরস, যেখানে এ দেশের মানুষ একসময় ৪০-৫০ বছরে বুড়ো হয়ে যেত, সেখানে আপনি ৮০-তে পৌছেও যে এমন জীবনতৃষ্ণার কথা বলছেন- এর প্রেরণা কোথায় পান?
সৈয়দ হক: জীবন নিজেই তার প্রেরণা, এই যে বেঁচে থাকাটা। লালন বলেছেন না, এমন মানব জনম আর কি হবে? হবে না, এখানেই, হিয়ার অ্যান্ড নাউ। তাই এই যে সময়টা পার করে এলাম, তাকিয়ে দেখি এটা খুবই উত্তেজক, উদ্বোধক, নাটকীয়, সংঘাতপূর্ণ… এই সময়টা আমাকে এমনভাবে নিয়ে এসেছে, মরে যদি আবার জন্ম হয়, তাহলে এমনভাবেই আসতে চাইব, এই জীবনই চাইব।

সৈকত: আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৮০ বছরের জীবন বেশ দীর্ঘ। এই জীবনে নানা পর্ব, বাক ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা আপনি পার করে এসেছেন। আপনার জীবন-উপলব্ধি সম্পর্কে কি আমরা কিছু শুনতে পারি?
সৈয়দ হক: জীবন চলেই চলে। একে চালাতে হয়। এবং চালানোটা একটা শক্তির দাবি রাখে। এই শক্তি হচ্ছে নিজেই। নিজের ভেতরেই বিশ্ব। নিজের ভেতরেই উদ্ভব, নিজের ভেতরেই বিলয়। আমি কতটা জীবনকে এগিয়ে নিতে পারছি- সবারই বয়স বাড়ে, সময় এগিয়ে চলে সেটা একরকম। কিন্তু জীবনের একটা অগ্রগামিতা আছে- পেছন থেকে সম্মুখের দিকে…

সৈকত: বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, এমনকি বিশ্ব ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ সময়েও আপনি জীবন পার করেছেন। আপনার শৈশবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ; এরপর পাকিস্তানপর্ব, ভাষা আন্দোলন, আপনাদের নানা রকম তৎপরতা আর বাঙালির চিরকালীন স্বপ্ন স্বাধীনতা- এই যে ঘটনাময় দীর্ঘ সময় পার করে এলেন- এগুলোর কি পর্বে পর্বে কোনো মূল্যায়ন করা সম্ভব?
সৈয়দ হক: মূল্যায়ন তো আমার হাতে ঐতিহাসিকের মতো হবে না, তবু লেখার ভেতর দিয়ে সময়ের জীবনযাপনকে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার বালককালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ; বিশেষ করে যে কুড়িগ্রামে আমার জন্ম, ১২ বছর ৩ মাস পর্যন্ত তো ওখানেই বাস করতাম। ওই সময়ে আমাদের কুড়িগ্রাম শহর প্রায় পুরোটা, মিত্রবাহিনী, মানে যাদের শ্বেতাঙ্গ সৈন্য বা গোরা সৈন্য বলা হয়, দখল করে নেয়। একটা ধারণা ছিল, জাপানি সেনারা বাংলাদেশে এলে এই পথেই প্রবেশ করবে, স্থলপথে। কুড়িগ্রামও তার মধ্যে পড়ে। সমস্ত শহর ছেয়ে গিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ সৈন্যে। আমার চার বছর বয়সে যুদ্ধটা শুরু হয়, শেষ হয় ১০ বছর বয়সে। তারপর দেশভাগ। আমি ভারত-পাকিস্তান হওয়া বলি না। সময়টাকে চিহ্নিত করি দেশভাগ হিসেবে। দেশভাগের বেদনা এখনো আমার চেতনা থেকে ঝরে…

সৈকত: এবং আপনি খুব স্পষ্ট করেই বলে থাকেন- দুই বাংলা বলে কিছু নেই…
সৈয়দ হক: বাংলা একটি অখণ্ড অনুভব। একে ভাগ করা যায় না। দেশভাগের ঘটনায় এখনো আমার ভেতর থেকে রক্ত ঝরে। আমার জীবনে ইতিহাসের দুটি ঘটনা খুব বড়ভাবে হৃদয়ে দাগ কেটে আছে- একটা হচ্ছে ’৪৭-এর দেশভাগ, আরেকটা হচ্ছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। তুমি ঠিকই বলেছো সৈকত, আমি ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছি।

সৈকত: দেশভাগের যে ক্ষরণের কথা আপনি বললেন…সে সময় পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আবুল হোসেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম দেন ‘নববসন্ত’, আহসান হাবীবও তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ের নাম দেন ‘রাত্রিশেষ’- এই যে একটা ইউটোপিয়ার মধ্যে ঢুকে যাওয়া কবি-লেখক নির্বিশেষে- অন্যদিকে কাজী নজরুল বলছেন, ‘পাকিস্তান হবে ফাকিস্তান’। এভাবে পাকিস্তানবাদী হয়ে যাওয়া কি বাঙালি মুসলমানের বিভ্রান্তি বা নিজের সত্তা-হারানোর মতো ব্যাপার ছিল না?
সৈয়দ হক: (খানিকটা বিরক্ত হয়ে) তুমি কি এই সকালবেলায় আমার সঙ্গে ইতিহাস আলোচনা করতে বসেছো? সাহিত্যের আলোচনা করতে এসে ইতিহাস! শুরু করেছিলে আমার ৮০ বছর, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য নিয়ে…এখন চলে গেলে ইতিহাসের দিকে।

সৈকত: আমি সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই কথাটা তুলেছি…
সৈয়দ হক: শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপারে যারা পাকিস্তান নিয়ে উন্মাদনা করেছে, তারা আজ ঝরে গেছে।

সৈকত: আমরা জানি, আপনি অনেক স্ট্রাগলের ভেতর দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে আপনার জীবনের দর্শনটা একটু শুনতে চাই।
সৈয়দ হক: আমাকে দেখে হয়তো অনেক ভাবেন- আমি এখন যেমন আছি, হয়তো সবসময় তেমনি ছিলাম। আসলে জন্ম খড়ে-ছাওয়া একটি কুটিরে, নদীর পাড়ে। আবার বাবা খুব পরিশ্রম করে নিম্নমধ্যবিত্তর পর্যায়ে পৌছেছিলেন। কুড়িগ্রামে যে ঘরে আমরা থাকতাম তার চালে টিন থাকলেও বেড়া ছিল বাশের, মেঝে ছিল মাটির। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে উচ্চাশা দিতেন- ‘তোমাকে ইটের দালানের দিকে পৌছুতে হবে।’ এটা একটা প্রতীক, এবং বলতেন, ‘ইটের দালানের দিকে যাত্রাটা মনে রেখো।’ এই বাড়িটা যখন শুরু করি, প্রথম ভিত স্থাপন করতে যাই, তখন বাবার কথাটা খুব মনে পড়েছিল। বাবা হঠাৎ চলে গেলেন, আমার আঠারো বছর বয়সে। তাই অনেক কষ্ট করেই বড় হয়েছি। সাত-সাতটা ভাইবোন ছিলাম, যা পেয়েছি তা পরিবারের সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েছি। তবে ঝুকি যেমন ছিল, তেমনি আমার ভেতর জেদও ছিল। ভেবেছিÑ হবে না কেন, অবশ্যই হবে। কখনো হাল ছেড়ে দিইনি। তুমুল নিরাশার সময়ও আশাকে বিদায় করিনি। অন্ধকারের ভেতর থাকলেও তাতে অন্ধকার মনে করেনি। কখনো অনুতাপ করিনি। আমি সব সময় নিজের জীবনকে ভেতর থেকে যেমন দেখি, তেমনি বাহির থেকেও দেখি। আমার অনেক কঠিন সময়ে নিজেকেই নিজে দর্শক হিসেবে দেখেছি, যেন এসব ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি। আর নিজেকে নিরাসক্তভাবে বাইরে থেকে দেখা একজন লেখকের জন্য জরুরি। এখন আমরা যে বাস্তবতায় আছি, তাতে আমার ধারণা, সাহিত্যকে আরো নিরাসক্ত হতে হবে। এই চতুর্দিকে এত আকর্ষণ-বিকর্ষণ, এত প্রযুক্তি, এত হুল্লোড়- এখন যদি সাহিত্যকে সঠিক ভূমিকা রাখতে হয়, তবে অর্ন্তমুখী হতে হবে। যা-ই হোক, নিজের কথা বলছিলাম, আমার মধ্যে একটা নিরাসক্তি আছে। আর একটা ব্যাপার, আমি কখনো কোনো কিছু নিয়েই অনুতাপ করিনি।

সৈকত: বাবাকে যদিও অল্পদিনই পেয়েছেন, তবু আপনার জীবন গড়ার ক্ষেত্রে বাবার প্রভাবটাই বেশি। তাই কি?
সৈয়দ হক: অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই তাই হয়। স্বীকার করুক বা না করুক।

সৈকত: কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে তো মায়ের প্রভাবও…
সৈয়দ হক: আমার ক্ষেত্রে এটা এমন আলাদা কিছু নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবার প্রভাবই বেশি। এখনো তুমি গ্রামে গেলে দেখবে- কৃষক যখন জমিনে কাজ করে গাছের নিচে বসে আছে, তাকে যদি তুমি তার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করো, সে তোমাকে বলবে- ‘বাপজান আমারে কইছিল, মাটি এইভাবে ছানতে হয়, এইভাবে বীজ বুনতে হয়…।’ বাবার খুব প্রভাব ছিল এমন নয়, তবে বাবার দু-একটা কথা মনে পড়ে। বলতেন, ‘সবসময় তুমি নিজেকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কী করছো?’ উনি নিজেকেও এই প্রশ্ন করেছেন। আমার আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’-এ লিখেছি, কলকাতা নগরীতে তিনি ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস করতেন। একদিন হঠাৎ তার মনে হলো, এখানে আমি কী করছি, আমি গরিবের ছেলে, গ্রামের ছেলে, আমি এখানে কেন? সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতার পাট চুকিয়ে তিনি খুজে খুজে বার করলেন তখনকার ব্রিটিশ-বাংলার সবচে দরিদ্র এলাকা কুড়িগ্রাম। সেখানে গিয়ে ডাক্তারি শুরু করলেন। একটা আত্মজিজ্ঞাসা সবসময় তার মধ্যে ছিল। আরেকটা জিনিস পেয়েছি, বাবার মধ্যে একটা যাযাবর বাস করত। আসাম থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত, দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। আমি এই যাযাবর মনটি বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। তবে সেই অর্থে যাযাবর নয়, খালি স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ানো, মানে কোনো আসক্তি নেই। কিন্তু একটি ভ্রমণশীল, সঞ্চরণশীল মন।

সৈকত: এরপর আবার উৎসের দিকে ফেরা…
সৈয়দ হক: সে তো বটেই। যেখানে আমার জন্ম, আমার শেকড়, আমার মাটি তাকে তো উৎস বলাই যায়। তবে উৎস বলতে একটা মনোভঙ্গিও আছে।

সৈকত: এই যে উৎস প্রসঙ্গে আপনি মনোভঙ্গির কথাও বললেন, তাহলে এবার আমরা একটু জলেশ্বরীর দিকে যাই। আপনি নিজে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন, দীর্ঘকাল বিলেতে থেকেছেন, তারপরেও আমরা দেখে জলেশ্বরীকে ঘিরে আপনি একটি ভুবন তৈরি করেছেন। জয়েসের ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখি ডাবলিনই তার জগৎ, আপনার ক্ষেত্রে কি জলেশ্বরীও তেমন…
সৈয়দ হক: [হাসতে হাসতে] তা নয়, তা নয়, এটা একটা ভূগোল। ধরো বারবার গ্রামের মানুষের কথা লিখতে চাই, গ্রামের গল্প লিখতে চাই। বারবার একটা নতুন জায়গা নিয়ে কল্পনা করে কোনো লাভ আছে? তার চেয়ে একটা এলাকা গড়ে তুলি না কেন? আমার চেনা জগৎ, যা কিছু দেখেছি, জেনেছি, চিনেছি তাই নিয়েই একটা জায়গা গড়ে তুলি না কেন- বারবার একটা পরিবেশ কল্পনা করতে হবে কেন? যদি একটা নতুন কিছু তৈরি করে সেখানেই মানুষগুলোকে স্থাপন করতে পারি…এভাবেই জলেশ্বরীকে গড়ে তোলা। এর মূলে আছে কুড়িগ্রাম এবং আমার ঐ অঞ্চল। তারপওে বাইরের অনেক কিছু, উপাদান আমি এর সঙ্গে যুক্ত করেছি, মিশ্রণ করেছি এবং আমি খুব স্বস্তি বোধ করি যখন আমি গল্প না লিখেও জলেশ্বরীর কথা ভাবি। বলা যেতে পারে, এটা আমার সাহিত্যিক এলাকা।

সৈকত: লেখকই হবেন, এই চিন্তাটা এল কখন থেকে?
সৈয়দ হক: খুব ঘটা করে কিছু নয় যে, বিশেষভাবে বলবার মতো। তবে যখন আমার বছর পনেরো বয়স, তখনই আমার মনে হলো, বড় হয়ে আমি এ কাজটিই করব। এর পেছনে আর ঐতিহাসিক কোনো কারণ নেই। তবে আমার কাছে লেখাটা হচ্ছে খুন করার মতো, সর্বোচ্চ অপরাধ। অধিকাংশ খুনিরই এ ব্যাপারে কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না। কিন্তু খুনটা করার পর তার মনে হয়, সর্বোচ্চ অপরাধ করে ফেলেছি। তারপর থেকে সে সারা জীবনের জন্য খুনি। তো লেখাটা হচ্ছে সেই রকম। তুমি একটা কিছু করে ফেলেছো, তারপরই ভাবলে, আরে করে ফেলেছি তো…চার লাইন লিখে ফেলেছি তো কবিতা, একটা গল্প লিখে ফেলেছি, এই যে তোমার হয়ে গেল, তুমি হয়ে গেলে চিরকালের লেখক, চিরকালের খুনি…। তবে হয়তো লেখার প্রতি আকর্ষণ হবার একটা কারণ থাকতে পারে- বাবা তো হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারির বই লিখতেন, মাঝে মাঝেই খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতাম, মৃদু আলোয় বাবা খুব মগ্ন হয়ে লিখে চলেছেন, আর তখন নিবে কালি চুবিয়ে লিখতে হতো, একটা খসখস শব্দ হতো। ভাবতাম, কাজটি নিশ্চয়ই ভালো, এটা আমিও করব। সেখান থেকেই হয়তো একটা বিশেষ আকর্ষণ, তবে আকর্ষণটা বড় কথা নয়, লিখছি এটাই বড় কথা। এবং লিখে আমি খুব আনন্দ পাই।

সৈকত: এই আনন্দই কি আপনার বিপুল সৃষ্টির উৎস?
সৈয়দ হক: লিখেই আমি সর্বোচ্চ আনন্দ পাই। কখনো কখনো এমন হয় একটা তৃপ্তিকর লেখা শেষ করার পর নিজেকে বাইরে নিয়ে যাই। তাকে নানা কিছু উপহার দিই। কোনো ভালো রেস্তোরায় ডিনার করাই। এবং নিজেকেই বলি, বয়, ইউ হ্যাভ ডান এ গুড জব। এর মানে, আমি লেখাটাকে প্রচণ্ড এনজয় করি।

সৈকত: এই যে আপনার অনিঃশেষ সৃষ্টির উৎসার, বিচিত্র মাধ্যমে এত সব রচনা, আনন্দই কি সব? আর কিছু নয়?
সৈয়দ হক: [খুবই উৎসাহ ও উত্তেজনার সঙ্গে] আনন্দই প্রথম। কাজটা করতেই খুব আনন্দ। এমনকি লেখার টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গেই মনে আমি একটি আনন্দের দরোজায় দাড়িয়েছি, এবার আমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে…। একটা কোনো পঙক্তি হয়তো চলতে চলতেই মাথায় এল, কবিতায় যেমন হয়, একটা-দুটো লাইন উড়ে আসে, তখনই মনে হয়, একটা প্রজাপতি কাপছে, পাখা নাড়ছে, কোথায় বসবে বুঝতে পারছে না। আমি স্পষ্টই দেখতে পাই লাইনটা উড়ছে… উড়ছে…। ‘এখানে থেমো না তুমি’ এ একটা কথা সেদিন মাথায় এল, কী করব আমি জানি না, কিন্তু লাইনটা প্রজাপতির মতো কাপছে… এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, এখনো মাথায় কাজ করছে ‘এখানে থেমো না তুমি’। মনে হচ্ছে একটা পয়ার পয়ার ভাব আছে। কিন্তু হয়নি এখনো, মনে হচ্ছে এখনো ডানা ঝাপটে চলেছে… অ্যান্ড ইউ নো মাই রাইটিংস অ্যান্ড মি, ইটস রিলেটেড টু ইচ আদার…

সৈকত: পয়ারের প্রসঙ্গে মনে হলো, দীর্ঘদিন ধরে আপনার কবিতা পাঠ করে, যেন স্বভাবকবির মতোই আপনার ভেতরে…
সৈয়দ হক: [বাধা দিলেন] স্বভাবকবি বলে কিছু নেই। একটু আগে বললাম না, কবিতার একটা-দুটো লাইন আসে, এরপর একে বানাতে হয়।

সৈকত: আসলে বলতে চাইছি, বাঙালির চিরায়ত ছন্দ পয়ারে আপনি এত স্বতঃস্ফূর্ত যে, মনে হয় যেন এটা আপনাআপনি চলে আসে। বিশেষ করে আপনার প্রেমের কবিতায়, মনে হয় যেন ভেতরে তৈরিই ছিল, সৈয়দ হক কেবল কাগজে নামিয়ে দিয়েছেন…
সৈয়দ হক: [হাসতে হাসতে] না না, এত সোজা নয়। মনে করো, স্বামী-স্ত্রী খুব সুখী দম্পতি, তাদের ভেতর স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসা বইছে। এই স্বাভাবিকতা কিন্তু উপর থেকে, ভেতর থেকে কিন্তু অনেক পরিশ্রম আছে, শ্রম-ঘাম-সাধনা অনেক কিছু আছে। তেমনি একটি রচনা অনেক পরিশ্রমের ফসল। যেমন ধরো, ‘এই মণিহার আমায় নাহি সাজে…এরে ধরতে লাগে…’ মনে হয় কত সহজ কিন্তু এটা ভাবতে যে কত পরিশ্রম গেছে- যেমন সুখী দম্পতি দেখলে মনে হয়, বাহ, বেশ আছে দুটিতে। এটি কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এর জন্য সচেতন প্রচেষ্টা আছে, নানা করণকৌশল আছে। রচনার ক্ষেত্রেও তাই, বাইরে থেকে যত সহজ মনে হয়, ভেতরে কিন্তু ততখানি পরিশ্রম আছে।

সৈকত: যদিও আপনার অনেক রকম কবিতাই আমরা পাঠ করেছি, কিন্তু মনে হয় হয় প্রেম বা ভালোবাসা আপনার কবিতার বেসিক জায়গা। বিশেষত এই বয়সে, আমাদের সমাজে যাকে বলা হয়, জপ-তপ করার সময়…
সৈয়দ হক: বাংলা কবিতার মূল রসই হচ্ছে প্রেম। এটা রাধাকৃষ্ণ থেকে এসেছে। এর একদিকে যেমন প্রেম আছে, অন্যদিকে আছে কাম। একদিকে দৈহিক আছে, অন্যদিকে মানসিক আছে। তবে এর ভেতরে বিরহ-বিচ্ছেদের তাপটা বেশি ধ্বনিত। যেমন রাধাকৃষ্ণরÑ তাদের কিন্তু সর্বক্ষণের সংসার নয়, মাঝে মাঝে, কখনো সখনো…। প্রতিটি জাতিরই কিন্তু কল্পনার একটা মহা নীলনকশা থাকে। বাংলা কবিতায়ও এর প্রধানতম নীলনকশা হচ্ছে রাধাকৃষ্ণ। যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা, জীবনানন্দের কবিতা পড়ি, তখন দেখি কোথাও না কোথাও এই মহা নীলনকশার একটা ছায়াপাত আছে। আমার কবিতায়ও এটা করেছি। আরেকটা জিনিস যেটা ফিরিয়ে এনেছি, তা হলো কাম। বাংলা কবিতা থেকে কামভাবটা চলে গিয়েছিল। এর কারণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রথমদিকে দেহ-চুম্বন এসব নিয়ে সনেট লিখলেও পরের দিকে নিজেকে গুটিয়ে পরে বিমূর্ত স্তরের দিকে চলে গেছেন। এরপর বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’য় প্রথম দেখেছি দৈহিক ক্ষুধার চিৎকার। যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ অন্ন দাও অন্ন দাও বলে, তেমনি ক্ষুধার্ত যৌবন চিৎকার করে- আমাকে সঙ্গ দাও, আমাকে তৃপ্ত করো, আমাকে উষ্ণতা দাও। এই জিনিসটা অনেকটাই দূরে চলে গিয়েছিল বাংলা কবিতা থেকে। যেজন্য আমি খুব সচেতনভাবে কিছু কামজ কবিতাও লিখেছি। তাই তুমি যে বললে স্বভাবকবির মতো, তা নয়, এখানে আমার সচেতন কাজ রয়েছে। মূলত আমি মিস্ত্রি তো। ধরো এখানে কিছু কাঠ আছে বা কিছু কাঠের টুকরো পড়ে আছে- কিছু তো বানাতে হবে। কারণ হাত তো নিশপিশ করে।

সৈকত: বলছিলাম, এই বয়সেও আপনার কবিতায় এত তীব্র প্রেম ও কামের রহস্যটা যদি…
সৈয়দ হক: জীবনকে আমি ভালোবাসি। প্রতি মুহূর্তে জীবনকে উপভোগ করতে চাই। এই তাড়না এবং প্রেরণা আমাকে অক্ষয় যৌবনে রেখেছে এটা তোমরা বলতে পারো। কিন্তু আমি মনে করি এটা আমাকে সপ্রাণ রেখেছে।

সৈকত: প্রত্যেক লেখক-শিল্পীর মধ্যেই বিশেষ ধরনের মৃত্যুচেতনা কাজ করে। এক্ষেত্রে আপনার কোনো বিশেষ ভাবনা?
সৈয়দ হক: মানুষের জীবনে জন্ম কোনো ঘটনা নয়। মৃত্যুই ঘটনা। কারণ জন্মকালে তার কোনো বোধ থাকে না, একটা সময় বোধ কাজ করে, তারপর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। জন্মদিন উপলক্ষে আমার একটা কবিতার বই প্রকাশ হচ্ছে। সেখানে এ বিষয়ে আমার সাম্প্রতিক ভাবনাগুলো আছে।
[হক ভাই তাড়া দিচ্ছেন। শেষ করতে হবে। এরই ফাকে এলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। হক ভাইয়ের আশি বছরে পদার্পণ, তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য সম্পর্কে কিছু বলার অনুরোধ করলাম।]
আনোয়ারা সৈয়দ হক: মনে হলো সময়টা খুব দ্রুত কেটে গেল। এই সেদিন যেন শুনলাম হক সাহেব পঞ্চাশে, তারপরই যেন ষাট, সত্তর। এখন চোখের পলকে আশি হয়ে গেল। তাতে মনে হচ্ছে আমাদের সবকিছু ফুরিয়ে যায়নি। অন্য আট দশটা পরিবারের মতোই আমাদের জীবন কেটেছে। তবে আমাদের সময়গুলো খুব দ্রুত হারিয়ে গেছে। তবে ক্রিয়েটিভ মানুষকে বুঝতে হলে, ক্রিয়েটিভ মন দরকার। আর সম্পর্ক গিভ অ্যান্ড টেইক ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর ৮০ বছর আমার কাছে একটি সংখ্যা মাত্র। সময়টা খুব দ্রুত চলে গেছে।
সৈকত: একটা বিরাট সময় আপনি কাটালেন। বিপুল সৃষ্টি করলেন। আপনার অবর্তমানে পৃথিবী বিশেষভাবে আপনার কোনো কাজ মনে রাখুক- এমন কি কখনো মনে হয়েছে?
সৈয়দ হক: ভাবিনি, সত্যিই কখনো বিশেষভাবে ভাবিনি সৈকত। তবে মাইকেল মধুসূদন একটা কথা বলেছেন না, রেখো মা দাসেরে মনে। তিনি কিন্তু আর কিছু চাননি। এটা আমারও কথা। এই যে পৃথিবীতে ছিলাম, দেশ মানুষ সাহিত্যের কিছু সেবা করে গেলাম- সেজন্য এই দাসেরে মনে রেখো।

(সৈয়দ হকের ছবি: সংগ্রহ)

%e0%a6%b8%e0%a7%88%e0%a6%95%e0%a6%a4-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ac

সৈকত হাবিব: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।

About the author

নরসুন্দা ডটকম

Leave a Comment