[চলতি বছরের শুরুতে কিশোরগঞ্জ আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদযাপিত হয় । বর্তমান রচনাটি সে-উপলক্ষ্যে একজন প্রাক্তন ছাত্রের জবানীতে রচিত।]
১.
ক্লাশে এসে বসতে না বসতেই বাঁশীর তীব্র হুঁইশেল । তখন সকালবেলার টাটকা রৌদ্রে ঝলোমলো উষ্ণ গাছ-গাছালিভরা নিবিড় স্কুল প্রাংগন। সেইখানে ইসহাক স্যারের বাঁশীর আওয়াজে রোজকার ছাত্র জমায়েত- এসেম্বলী । জাতীয় পতাকা ওড়ানো, কোরাসে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ২/১টি হাল্কা অনুশীলন, যাতে শরীরের আড়মোড়া ভাঙ্গে। সেইসাথে প্রতিদিন হাত সামনে প্রসারিত করে শপথ গ্রহণও ছিলো সমবেত কণ্ঠে : “আমি শপথ করিতেছি যে ——-”।
সদ্য ভর্তি-হওয়া শ্যামবর্ণের একটি খর্বকায় ছাত্রকে এমনি এক এসেম্বলীতে বেঞ্চের ওপর তুলে দেওয়া হলো। এই ছেলেটি কিনা শহরের বাইরের এক স্কুল থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে গোটা কিশোরগঞ্জ মহকুমায় দ্বিতীয় হয়েছে : ওই যে হাফ পাতলুন পরা, নীল হাফ শার্ট, পকেটের ওপর লাল সিল্কের সুতোয় ছটফট করছে ২টি দুরন্ত পাখী-ছেলেটিকে দেখে রাখো।
আবার তীব্র হুুঁইসেলের শব্দে ফিরে আসা যে যার শ্রেণীকক্ষে । ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সেই শুরু। সত্তরের অগেকার কথা। উনসত্তরের উত্তাপ কখনও এসে ছুঁয়ে যায় স্কুলের আংগিনা ,শহরের সিনিয়র ছাত্ররা কখনও এসে টেনে বের করে আনে শহরের রাজপথে : তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা,মেঘনা,যমুনা ।
তারপরতো একাত্তর, শহর ছেড়ে সেঁধিয়ে যাওয়া প্রত্যন্ত গাঁয়ের গহীনে;লুকিয়ে পালিয়ে বেঁচে থাকা । বছর ঘুরে ফের স্কুল শুরু নতুন বাস্তবতায় । নতুন নতুন বই, এক নতুন ভোরে নতুন ইতিহাসের পাঠ । এবার এসেম্বলীতে নতুন জাতীয় সংগীত, উড়ছে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। গেমটিচার ইসহাক স্যার আবার তাঁর ছাএদের নিয়ে নেমে পড়েছেন নতুন উদ্যমে। সবুজ ঘাসে-ছাওয়া বিশাল স্কুল মাঠ, তার ওপরে সারাদিনেও বুঝি শেষ হতে চায় না সূর্যরথের পাড়ি। মাঠের একদিকে সার বেঁধে দাঁড়ানো শালমেহগিনির পাতার ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘক্ষণ ধরে ঝুলে থাকে শেষবিকালের মরা আলো । খেলাধূলার মহড়া চলতেই থাকে তখনও। সেই খেলাধূলা ও শরীরচর্চার অনুশীলনেমত্ত ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে পড়ুয়া ছাত্রটি তাল মেলাতে না পারলেও স্কুলের প্রতি বছরের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তার জন্য নিয়ে আসে আনন্দের অফুরন্ত সওগাত।
এর আগে আগে হয়ে যায় তীব্র উত্তেজনায়-ভরা বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা । দিনশেষে স্কুলের আঙ্গিনায় জড়ো হওয়া ছাত্র-জমায়েতে ফলাফল ঘোষণার শেষ প্রহরটুকু কাটতে চায় না । ছাত্রটির লড়াইতো বরাবর ক্লাশের উপর দিককার মাত্র ২ জনের সঙ্গে।
কেউ একজন সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে গেলেই প্রথম স্থানটি তার হাতছাড়া । সে-রকম অবস্থায় দ্বিতীয় স্থানটি নিয়ে কিছুটা মনমরাভাবেই ঘরে ফিরতে হয়। প্রথম স্থানটি বজায় থাকলে তো মনখুশী, সেই মনমরাভাব কাটিয়ে উঠতে কিংবা মনখুশী আরো খানিক বাড়িয়ে দিতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনটি যেন টনিকের মত কাজ করে । সে যেন ছুটির তোড়ে ভেসে-যাওয়া এক অচেনা খুশীর দিন। বিশাল মাঠের একদিকে শাদালাল শামিয়ানার নিচে টেবিল জুড়ে সার বেঁধে সাজিয়ে-রাখা নানা ধরণের পুরষ্কার ও মেডেল। মাইকে বাজছে গান : মেঘ কালো, আঁধার কালো —- ।
অন্য শিক্ষকরাতো আছেনই ,সবার ওপরে ইসহাক স্যার । নিত্যদিনের হাফশার্টের বুক পকেটে আজ তাঁর শোভা পাচ্ছে বড়সড় আকারের ব্যাজ । কখনও মাঠের এই কোনে দেখা দিলেন তো ফের তাঁকে দেখা গেলো ওই কোনায় ;বাঁশীর হুঁইশেল থেকে বোঝা যায় গোটা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি । সকালের দিকে ১০০ মিটার কিংবা লং জাম্পের মত আইটেমগুলো হয়ে যাওয়ার পর ,বিকেলের নরোম আলোয় রিলে রেস যেন একটি বছরের উৎসবকে আর একটি বছরের হাতে তুলে দিয়ে গেল । সেদিনের দুপুরবেলাটা আনন্দময় হয়ে উঠতো যেমন খুশী তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় । আবার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আন্ত-স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ক্রীড়াবিদ ছাত্রদের নিয়ে স্যার যখন চ্যাম্পিয়ন কি রানার্স আপ হওয়ার গৌরব নিয়ে ফিরে আসতেন সে-আনন্দের ভাগও পেতো ছাত্র শিক্ষক সকলে ।
২.
নতুন বছরে নতুন বইয়ের ঘ্রান এসে ঢেকে দ্যায় পুরনো বৎসরের সব মলিণতা । শিক্ষক পাল্টায়, নতুন নতুন বিষয়, নতুন স্বাদ ও আকর্ষণ নিয়ে ধরা দ্যায় । টিফিন আওয়ারের পর ফের ক্লাশ শুরু হয় । দ্বিপ্রহরের হঠাৎ-নিঝুম স্কুল প্রাঙ্গনে শুকনো শালপাতা ঝরে পড়ে ১টি,২টি । জানালার ফাঁক গলিয়ে চৈত্রের গাঢ় নীল আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘে ছাত্রের মুগ্ধতাবাঁধা পড়ে না । না, ঘুমও পায়না ।কেননা ইতোমধ্যে সেই দৃশ্যে আবির্ভূত হয়েছেন শাদা ধবধবে পা’জামা পাঞ্জাবী-পরা ফর্শা, উজ্জল হাসিভরা মুখে হোসেন আলী স্যার ;অতি সহজ করে তিনি বুঝিয়ে চলেন বিজ্ঞানের ক্লাশ। আবার কোন ক্লাশ নিতে আসেন বারিক স্যার কি শহীদ স্যার কিংবা আলাউদ্দিন স্যার কি সাইদুর রহমান স্যার । কখনওবা পেছন থেকে গুঁড়ি মেরে এসে ঘাড়ের ওপর বিশাল থাবা রেখে ক্লাশের সবচেয়ে ক্ষুদ্রকায় ছাত্রটিকে একেবারে শূন্যে তুলে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ক্লাশসুদ্ধ ছাএদের নিয়ে একচোট হেসে নেন সুশীলবাবু স্যার ।
বিশাল শালপ্রাংশু দেহ, ধবধবে ধূতি-পাঞ্জাবী পরা ,চকচকে জুতো পায়ে টকটকে ফর্শা সুশীল বাবু স্যার যেন আর সবার চেয়ে আলাদা । ক্লাশ নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পানচর্চিত টুকটুকে ঠোঁটে হরেক রকম স্বাস্থ্য টিপস দিয়ে চলছেন স্যার । কখন বিকাল নেমে আসে;ছায়া ঘন হয়ে থোকায় থোকায় ঝুলে পড়ে গাছগাছালীর শাখায়,একদল পাখী তাই নিয়ে মেতে উঠলে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠে। ক্ষুধায়-নেতিয়ে পড়া ছাত্ররা গেটের মুখে মৃদু কোলাহল করতে করতে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাতেও কি নিস্তার আছে ছাত্রটির ! গেটমুখে জটলার একপাশে দাঁড়িয়ে যে আজিজ স্যার স্বয়ং ! বাড়িফেরা ছাত্রদের মধ্য থেকে নির্ধারিত ছাত্রটিকে আলাদা করে নিয়ে তিনি তখন সোজা টিচার্স কমনরুমে । টানা টেবিল পাতা-দুই পাশে চেয়ারের সারি -টিচার্স কমনরুমও ফাঁকা হয়ে পড়েছে এরি মধ্যে । আবছা আলোয এবার ছাত্রকে নিয়ে ইংরেজি শেখানোর কসরত।
অসীম ধৈর্য আর অপরিসীম আনন্দের সঙ্গে ছাত্রকে পড়িয়ে চলেন : Parts of speech,Voiceআর Narration, শেখান Preposition ও Conjunctionএর ব্যবহার, কিভাবে ইংরেজি শুদ্ধ বাক্য গড়ে উঠে তার গোপন নিয়মকানুন । স্রেফ বিনা পয়সায় পাঠদান । ক্ষুধার্ত ছাত্র পিতৃতুল্য শিক্ষকের উৎসাহ ও আনন্দের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে । কিন্তু স্যার যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন ।
কোত্থেকে পেলেন এই প্রাণপ্রবাহ ,কোথায়ই বা এর উৎস ? দিন তো তার শুরু হয়েছিলো সেই ভোরবেলায়। শহর ছাড়িয়ে,কমপক্ষে ৬/৭ মাইলতো হবেই ,দূর গাঁয়ের নিজ বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে এসেছেন তিনি । সেই পাজামা পাঞ্জাবী পরা একহারা গড়নের আজিজ স্যার সারাদিনের রুটিণ ক্লাশ সেরে এই অপরাহ্ণে কিনা আবার নিয়ে পড়েছেন অজ্ঞাতকুলশীল এক ছাত্রের ইংরেজি দক্ষতা আর একটু মেরামত করার কাজে, তাও কিনা বিনে পয়সায় ! সারাদিন ছাত্রের পেটে যে দানাপানি কিছু পড়েনি সে-কথা ঠিক; কিন্তু স্যারই বা কি খেয়েছেন, কখন খেলেন। স্কুলে রান্না বান্নার বালাই নাই,এমনকি নাই ত্রিসীমানায় কোনও দোকানও।
২/১ খানা বিস্কুট কি সিঙ্গাড়া দপ্তরী যা এনে দিয়েছিলো, তাতেই কিক্ষুন্নিবৃত্তি হয়েছে ! ওদিকে স্যারের মুখের হাসিটি তেমনি অমলিন -সেই যে-হাসিতে দিনের প্রথম প্রহর আলোকিত হয়েছিলো । অপরাহ্ণের পাঠ-দান শেষে শহরের এপাড়া ওপাড়ায় আরো ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর যাত্রা অনেক রাতে ।
একচিলতে শহরের ঝলোমলো আলো সামান্য কয়েক গজ পেরুলেই ফুরিয়ে যেতো; তারপর তো ঝাঁপিয়ে পড়তো গ্রামবাংলার আদিম অন্ধকার । এবড়ো থেবড়ো সেই পথে (যশোদলগামী রাস্তা তখনও পাকা হয়নি) শুধু তারার আলো । টর্চ একটা রয়েছে বটে, কিন্তু দূরপাল্লার সাইকেল যাত্রায় তা ব্যবহারের সুযোগ কোথায় ? কিন্তু দ্যাখো পরদিন সকালবেলা ঠিক হাজির আজিজ স্যার, মুখ ভরা সেই হাসিটুকু ! এই শেষ বেলায় খটোমটো ইংরেজি বোঝার ফাঁকে কখন যে ক্ষুধা উবে গেছে ছাত্রটির, অপার্থিব আলোর একটা বলয় স্যারকে যেন ধীরে ধীরে ঘিরে নেয়;বিস্ফারিত চোখে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে ছাত্র ।
আওয়াল স্যার কি ঠিক এর বিপরীত ধরণের ? না, তাই বা বলা যাবে কি করে, হাসছেন না বলে ! কেননা প্রাইভেটে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ছাত্ররা জানে ক্লিন-শেভড সৌখিন মানুষটির সযত্নে ছাঁটা গোঁফের নিচে চেপে-রাখা অধরোষ্ঠ কতখানি মেকি । সামান্য আনুকুল্যে নির্মল হাসিতে কতবার যে খসে পড়েছে মুখের সেই কৃত্রিমতা ।
স্যার ছিলেন বলেই কি “মুক্তোর মত হস্তাক্ষর” শব্দ ক’টি বেঁচেছিলো ব্যাকরণের পাতায় ? ওইরকম হস্তাক্ষরে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির জটিল জগতে তিনি ছাত্রদের নিয়ে পাড়ি জমাতেন । এক সহজ আনন্দ ও অনায়াস দক্ষতায় । তাঁকে ধরতে হলে যেতে হতো সেই ভোরবেলায় ।
সেই তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরুর দিকটায়, তখনও তিনি কুমার;থাকেন নরসুন্দার ওই পাড়ে বয়লা গাঁয়ের এক ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনের কোঠায় । সেই ছোট্ট কোঠায় বিছানার একপ্রান্ত গুটিয়ে শুরু হতো অংকের পাঠদান । রোদ চারদিকের জড়তা শুষে নিয়ে দরোজার পাশের গাছটি বেয়ে উঠে দাঁড়ালে ছাত্র দ্রুত খাতা-পত্র গুটিয়ে উঠে পড়তো ।
অনতিবিলম্বে স্যার গোসল সেরে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তেন স্কুলের পথে । শাদা প্যান্ট,শাদা শার্ট,কব্জীতে চেনে বাঁধা ঘড়িটি- ঝকঝকে স্মার্ট প্রতিদিন একরকম। আরো পরে স্যার উঠে এলেন তাঁর পুরান থানার বাসায় , নতুন সংসার সাজিয়ে । এবার বাসার সামনের ঘরটায় কয়েকটি ছাত্র নিয়ে এক একটি ব্যাচে পড়ানোর পালা ।
ততদিনে অংক ও বিজ্ঞানের জগত আরো জটিল হয়ে উঠেছে-বেরিয়ে আসছে আরো অনেক গলিঘুঁজি । স্যার কিন্তু এবার আরো পরিণত, আরো দক্ষতার সঙ্গে কোন বিষয় না বুঝতে পারলে বারবার বুঝিয়ে, একটুও বিরক্ত না হয়ে বা রেগে না গিয়ে তাঁর ছাত্রদের তৈরি করে তুলছেন। কতইবা তার মূল্য, সামান্য টাকায় তা কি পরিমাপ করা যায় !
[এই স্যার ও স্যারপত্নীই যে উত্তরকালে তাঁর ছাত্রের বিবাহের কনে পর্যন্ত যোগাড় করেদিয়ে ছাত্রকে জীবনের দায় থেকে উদ্ধার করেছিলেন সেই গল্প না হয় শতবর্ষের এই স্মৃতিচারণায় সমৃতির ঝাঁপিতে তোলা থাক ।]
বরং দেখা যাক শহীদ স্যার কেন এই ছাত্রটিকে টেনে আনলেন নাটকের মঞ্চে । সেইসঙ্গে আরো একদল ছাত্র-বড় ও ছোট বিভিন্ন ক্লাশের । হতে পারে তিনি ভেবেছিলেন, আর যা হোক এই ছাত্রটি অন্তত: স্টেজে উঠে ছড়া কবিতার দীর্ঘ পংক্তি কিংবা ডায়ালগ ভুলে যাবে না । সে এক এলাহী কান্ড -জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে স্কুলে । শহীদ স্যার লিখেছেন কবি নজরুলের ছোটবেলা নিয়ে চমৎকার নাটক-দুখু মিয়া ।
সাব্যস্ত হলো ছাত্রটি রূপ দেবে দুখু মিয়ার চরিত্রে । দুখু মিয়াকে ফুটিয়ে তোলার জন্য নাটকে রয়েছে নজরুল-কৈশোরের দুরন্তপনার অনেক ক’টি দৃশ্য-রয়েছে কয়েকটি গান দুখু মিয়ার লিপে;আরও নজরুলের বিখ্যাত ছড়া -“বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া !” চারিদিকে রীতিমত সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। বদলে গেলো স্কুলের রোজকার রুটিন । রোজ স্কুল ছুটির শেষে কোন একটা শ্রেণীকক্ষে মহড়া চলতে লাগলো দিনের পর দিন ।
শহীদস্যার পরিচালনা, নির্দেশনাসহ সবকিছু দেখভাল করছেন । তাঁর উত্তেজনা,উৎসাহ সবাইকে টেক্কা দিয়েছে । তাঁর ফর্শা মুখ একেকবার টকটকে লাল হয়ে উঠছে -ঘামে ভিজে পিঠের ওপর লেপ্টে আছে ৬৫/৩৫ টেট্রনের শাদা শার্ট, পরণের নীল প্যান্ট পায়ের দিকটায় খানিকটা মুড়িয়ে নিয়েছেন তিনি । সেই নাটক একেবারে বাজিমাত করলো সেবার -দুখু মিয়াতো রীতিমত হিট। আন্ত স্কুল প্রতিযোগিতায মঞ্চস্থ হলো সে নাটক; কথা উঠলো এই নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে পাঠানো যায় কি না ।
আর একদিন, বৃষ্টির কারণে দু’ক্লাশ আগেই ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। ছুটির ঘন্টা বাজবার অল্প আগে দফতরী পাঠিয়ে খোদ হেডস্যার ডেকে পাঠিয়েছেন। সেই গম্ভীর,রাশভারী হেডমাস্টার মতিউর রহমান স্যার -দূর থেকে প্রতিদিন চোখে পড়ে তিনি তাঁর কামরায় নিরবে কাজ করছেন । কখনও দেখা যায় গলাবন্ধ কোট ,পরিষ্কার পাতলুন আর জুতোয় প্রায়-নি:শব্দ আওয়াজ তুলে ক্লাশ চলাকালে স্কুলের লম্বা করিডোর ধরেহেঁটে যাচ্ছেন । প্রতিদিনের সেই চেনা ভঙ্গীর চেনা মানুষ-কিন্তুু কত অচেনা ! তাঁর সুপরিসর সেই কক্ষে মাঝেমধ্যে যে যাওয়া হয়নি এমন নয় ।
শেষ যাওয়া হয়েছিলো জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পাবার মিষ্টি নিয়ে , হেডমাস্টারস মেত অন্যান্যদের অপ্যায়ন করার সুবাদে। চারিদিকের আলো এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্যারের ঘরটায়,সাথে লাগোয়া তাঁর একচিলতে ব্যক্তিগত বারান্দা । সেই বারান্দা থেকেই শুরু অনেক যত্নে গড়ে-তোলা এক টুকরো বাগান : গোলাপ, গন্ধরাজ, বেলী, রঙ্গন আর পাতাবাহারের সমাবেশ -এর শেষ প্রান্ত স্কুলের গেট অবধি ছুঁয়েছে ।
বাগানের বেড়ায় আহ্লাদে লতিয়ে উঠছে -মাধবীলতা ও অপরাজিতার ঝাড়। একটু বাইরে দাঁড়ানো কৃষ্ণচুড়ার ঝলোমলো কয়েকটি ডাল এসে ঝুঁকে পড়েছে বাগানের দিকে। অমন রাশভারী, গুরুগম্ভীর স্যার কিনা তাঁর পাঁজরের কাছে পরিচর্যা করছেন অমন অপরূপ বাগান । তাই তো !
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। চারিদিক নিঝুম। এবার কালো মেঘ স্কুলের মাঠের ধারের শালবন, শহরের রাস্তা ও শীর্ণকায় নরসুন্দার ওপর ঝুলে-থাকা আকাশ ছেড়ে হুড়মুড় করে নেমে আসবে । নিস্তব্ধ কক্ষে স্যারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছাত্র । স্যার গলা খাঁকারি দিয়ে বসতে বলেন । তারপর ধীর গলায় স্পষ্ট উচ্চারনে বুঝিয়ে বললেন ডাকার উদ্দেশ্য । কি,না আন্তস্কুল রচনা প্রতিযোগিতায় স্যার প্রতিযোগী হিসেবে এই একটি ছাত্রের নাম পাঠিয়েছেন । স্যার অনেকটা সময় নিয়ে রচনার বিষয়বস্তু, লেখার কলাকৌশল ইত্যাদি বুঝিয়ে বললেন। পরেআরো কয়েকবার লেখা ও সংশোধনের পর সেই রচনা প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়েছিলো । সম্ভবত: তৃতীয় পুরস্কারটি জুটেছিলো সেই রচনার ভাগ্যে । হেডস্যারের প্রশ্রয়েই স্কুলের আঙ্গিনায় ছাত্রদের সমূহ দুর্বলতা নিয়ে দিনের পর দিন ঝুলেছে দেওয়াল পত্রিকা । আর একবার উঁচু ক্লাশের ছাত্রাবস্থায় সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে চাঁদা তুলে রীতিমত প্রেসে-ছাপা একুশের সংকলন প্রকাশের আগে (জীবনের প্রথম মূদ্রিত সংকলন) স্যারের কাছে সংকলনের নাম চাইতে গেলে তিনি নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেস সে-নাম: “আমের বোলের ঘ্রানে রক্তলাল একুশে এসেছে আবার ফিরে।”
৩.
আজিজ স্যার তো না হয় নিশিফেরা সাইকেলগামী ,সেই যেন “ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী ”। অন্যান্যরা ? অন্যান্য আরো স্যার আসতেন শহরের বাইরে থেকে-শহীদ স্যার আসতেন, ইসহাক স্যার আসতেন । শহর প্রান্ত থেকেও আসতেন কেউ কেউ ।কোর্ট রোড থেকে আসতেন রমজান আলী স্যার, তারাপাশা থেকে যেতেন বশির স্যার । পায়ে হেঁটেই আসতেন তাঁরা, যেতেনও ওইভাবে । মানানসই পোশাক,কারুরই ২/৩ প্রস্থের বেশি নয় । কারুর হাতে ছাতা । শেষ বিকেলের মরা আলোয় যখন তাঁরা বাড়িমুখো তখনও তাঁদের অভিযোগহীন , প্রশান্ত মুখের কান্তি সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে ।
ধূলোমলিন পথটি মাড়িয়ে বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা, ক্লান্তির ছাপটুকু হয়তোবা ঢাকা পড়েছে রাতের অন্ধকারে, দিনের আলো তাকে খুঁজে নেবে তার সাধ্য কি ! আর ফেরার বাড়িটি ? বাড়ি তো নয়, কায়ক্লেশে বেঁচে-থাকা মাথা গোঁজার ঠাঁই মাত্র। (পড়া বুঝে নেওয়ার কাজে) এক সকালবেলা এক স্যারের বাড়ি গিয়ে দেখা গেলো-–একটিমাত্র ঘরের মধ্যে এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে একে একে জেগে উঠছে;উঠে পুকুরের ধারে চলে যাচ্ছে । ঘরে একটিমাত্র খাট(তক্তপোষ),ওপর থেকে ঝুলছে মশারী । মাটির মেঝে থেকে উঠে আসছে ঠান্ডা হিম। উঠানের এককোনে একটি চালায় খোলা উনুনে নাড়ার আগুনে ভাত চাপিয়েছেন স্নেহময়ী জননী – স্বামী তাঁর একটুপর খেয়েদেয়ে স্কুলে রওয়ানা হবেন, ২টি ছেলে যাবে মাদ্রাসায় । উঠোনে দাঁড়িয়েই খাতা খুলে পড়া বুঝে আসতে হয়েছিলো সেদিন । আর একবার ঈদের দিন বিকেলে সহপাঠীদের সঙ্গে আরেক স্যারের বাড়ি বেড়াতে গিয়েও দেখা গেলো এখানেও একটিমাত্র কামরায় থমকে আছে নিরুৎসব আরো একটি সংসার ।
৪.
ছবির পর ছবি , এলোমেলো , পারম্পর্যবিহীন । এ-যেনো শাদা কালো যুগের ছবি ,জমেছে অযত্নের ধূলো । কে-ই বা দেখে এ-সব ! এইসব ছবির গল্প, ভাবনা, ট্রিটমেন্ট এখন শুধু সময়ের ভার । যুগের চাহিদায় এর দাম ও আবেদন ফুরিয়েছে ।
শতবর্ষ উৎসব যেন এক নিস্তব্ধ শোকসভা , এক মৌন মর্গ । ইসহাক স্যার নাই, শহীদ স্যার নাই,ব শীর স্যার নাই, সাইদুর রহমান স্যার নাই, শীলবাবু স্যার নাই,মতিউর রহমান স্যার নাই । নাকি আছেন তাঁরা , মিশে আছেন ছাত্রদের প্রতিদিনের কথায়, বলায়, দেখায়, লেখায় ! যেভাবে কারিগর সক্রিয় তার কারুকর্মের সম্পূর্ণতায়, শিল্পী যেমন বেঁচে থাকেন তাঁর শিল্পের ছায়ায়, মায়ায় ।
নাকি এও এক কল্পনা বিলাস । সত্যিই কি ছিলেন তাঁরা, জীবনে কি সত্য ছিলো সেই দিনগুলি! আজ তাঁর ক’জন ছাত্র বেছে নিয়েছে তাঁদের জীবন ,সে-জীবনের কথা ভেবে ছাত্ররা কি শিউরে উঠেনি ? নাকি যুগধর্ম মেনে সবাই নিজেদের হালনাগাদ করে নিয়েছে। আর করুণাভরা চোখে পিছু ফিরে,এই শতবর্ষের প্রাক্কালে যেন বাড়ি বদলানোর ফাঁকে পেছনের পুরনো জানালাটি খুলে একবার ,শেষবার বুঝতে চাইছে সেইখানে জমেছে কতটুকু অন্ধকার; কার দায় তাতে কতখানি অথবা আদৌ কি কোন দায় আছে কিনা !
ঢাকা ১৩.০১.২০১৬খ্রি.
সৈয়দ কামরুল হাসান: গল্পকার।