জ্বলন্ত একাত্তরে সেনাবাহিনীর যে বীর বাঙালি সদস্যরা মহান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধ ও মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর ভিত্তি কাঠামো তৈরি করেছিলেন, রণাঙ্গণে লড়েছিলেন বীরদর্পে, তৎকালীন মেজর ও পরবর্তী সময়ে লে. কর্নেল এটিএম হায়দার বীরউত্তম তাঁদের অন্যতম। বাঙালিদের মধ্যে শুধু এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। ডিসেম্বরে প্রথম ঢাকা বেতার ও টিভি থেকে ঘোষণা পাঠ করেন, আমি মেজর হায়দার বলছি- মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নির্দেশ…।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ৬ নভেম্বর দিবাগত ভোররাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লে. কর্নেল এটিএম হায়দার এসএসজি বীর উত্তম এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)।
মো. ইসরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেসার পুত্র এটিএম হায়দারের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে, ১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দারের স্থান দ্বিতীয়। পাবনা বীণাপানি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন।
তারপর লাহোরের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে পরিসংখ্যানে এমএসসি প্রথম পর্ব সমাপ্তির পর সামরিক বাহিনীতে কমিশন্ড পদে মনোনীত হন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি প্রথমে কাকুলে ট্রেনিং নেন এবং কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োজিত হন। চেরাটে এমএসজি (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) ট্রেনিংয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে একজন দক্ষ গেরিলা কমান্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কমান্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। কমিশন প্রাপ্তির পর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান মুলতান ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৫-২০ দিন পর পুনরায় কুমিল্লায় নিয়োগ করা হয়।
মার্চ মাসের প্রথম দিকে ঢাকায় সামরিক ছাউনিতে তাঁবুর মধ্যে কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে তাঁকেও অন্তরীণ রাখা হয়। মার্চ মাসের ২১-২২ তারিখে তাঁকে আবারো কুমিল্লা সেনানিবাসে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে পাঠানো হয়। এটা ছিল বাংলাদেশে প্রথম পাকিস্তানি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন।
সম্ভবত ২৬-২৭ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পতনের দিন সকাল ১০টায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পালিয়ে যান। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে গেছে। তিনি চতুর্থ বেঙ্গলের অন্য অফিসারদের সঙ্গে সেখানে মিলিত হন। সেখান থেকে তেলিয়াপাড়া, পরে ভারতের মতিনগর হয়ে আগরতলার মেঘালয়ে যান। তখন দুই নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল মেঘালয়ে। হায়দার এখানে প্রথমে একটি স্টুডেন্ট কোম্পানি গঠন করেন। তিনি নিজেই কোম্পানিকে গেরিলা ট্রেনিং প্রদান করতেন।
পরবর্তী সময়ে দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে তিনি নিয়োজিত হন। মেঘালয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো, বিস্ফোরক ও গেরিলা প্রশিক্ষণসহ শপথও তিনি করাতেন। ৭ অক্টোবর ‘কে ফোর্স’ গঠনের পর মেজর হায়দার দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় তিনি ভারতীয় কমান্ডো ও ৬-৭ জন সৈন্য নিয়ে কিশোরগঞ্জে আসেন এবং কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তারেরঘাট ব্রিজ, মুসুল্লি রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুসংহত করেন। তিনি বিশেষ গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীতে অবস্থিত বড় ব্রিজটি ধ্বংস করেন মে মাসের শেষ সপ্তাহে। ডিসেম্বর মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পতনের পর ঢাকায় পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের আগে মিত্রবাহিনীর হাই কমান্ডসহ হেলিকপ্টারে তিনি ঢাকার অদূরে ডেমরা পর্যন্ত আসেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি স্বচক্ষে অবলোকন করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল হায়দার ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানিদের আত্মসর্মপণের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি এবং এ কে খন্দকারই ছিলেন বাঙালি অফিসার, যাঁরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মুক্ত বাংলাদেশে রেডিও প্রথম চালু হলো। মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী ঘোষক হিসবে ঘোষণা করলেন যে, এখন জাতির উদ্দেশে কিছু বলবেন সেক্টর ২-এর কমান্ডার ইনচার্জ মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মেজর হায়দার তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুরু করলেন। বললেন: আমি মেজর হায়দার বলছি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক।…তারপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন, সকল গেরিলার প্রতি আমার নির্দেশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোথাও যেন আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এলাকায় এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে দায়িত্ব না নেবেন, ততদিন পর্যন্ত গেরিলাদের যার যার এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি আমার আবেদন, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও দালালদের ধরিয়ে দিন। নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না।
ওই দিন দুপুর থেকে মেজর হায়দার ইস্কাটনে লেডিস ক্লাবকে সেক্টর-২ সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলেন।
১৯৭২ সালে মেজর থাকা অবস্থায় জনাব হায়দার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ১৩ ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৪-এ তিনি লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অষ্টম বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৫-এর প্রথম সপ্তাহ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি ছুটি কাটান। ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের রুমা সেনানিবাসে যোগদান করেন।
১৯৭৫-এর ৬ নভেম্বর দিবাগত ভোররাতে শেরেবাংলা নগরে সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে ব্রিগেডয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে লে. কর্নেল হায়দার এসএসজি বীর উত্তম নিহত হন।
পাক হানাদাররা যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, এমন একজন বীরকে তার দেশেরই কতিপয় সেনার হাতে নিহত হতে হয়। চিরকুমার তুখোড় মুক্তিযোদ্ধা হায়দারকে পিতা কর্তৃক স্থাপিত কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে হায়দার কিশোরগঞ্জ যাওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। কিশোরগঞ্জে এলেন ঠিকই তবে ঘাতকের নির্মম বুলেটে রক্তাক্ত লাশ হয়ে।
কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত বাঙালি জাতির এ বীর যোদ্ধা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ প্রজন্মের অনেকেই তাঁর নামটি পর্যন্ত জানে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না।
প্রসঙ্গত, লে. কর্নেল হায়দার বীর উত্তমের বোন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম বীর প্রতীক। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম বীর প্রতীক বলেন, স্বাধীন দেশের বীর সেনানী ভাই এটিএম হায়দারের অবিশ্বাস্য মৃত্যুই তাঁর জীবনে সবচেয়ে দুঃখময় স্মৃতি। সিতারা বেগম দুঃখ, অভিমান ও হতাশায় বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী।
জনাব হায়দারের একমাত্র ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা এটিএম সাফদার জিতু কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টির পৈতৃক বাড়িতে আলাপকালে জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর ভাই-বোনের অবদান জাতি মর্যাদার সাথে স্মরণ করলে পরিবারের দুঃখ থাকত না। কিন্তু জাতীয় দিবসসহ অন্যান্য দিবসে তাদের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। এটি জাতি হিসেবে আমাদের এক ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে নতুন প্রজম্ম সত্যিকার অর্থেই বঞ্চিত হবে।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।