শহীদ সেলিমের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার কাশিমনগর গ্রামে। সেলিম ১৯৬৮ সালে বাজিতপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৭০ সালে ভৈরব হাজী আসমত কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ‘৭১‘র মার্চ মাসের শুরুতেই তিনি ছাত্র যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। জুনের মাঝামাঝি সময় তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভেতর প্রবেশ করেন এবং একাধিক সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন এই দেশ প্রেমিক সাহসী তরুণ।
একাত্তরে ২০ বয়সী এই তরুণ সেলিম আইএসসি পাস করার পর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জি ডি পাইলট হিসেবে মনোনীত হন। প্রশিক্ষণ নেবার জন্য চিঠি আসে তাঁর কাছে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সেলিম দেশের জন্য যুদ্ধ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেতে উঠে বাঙালি হত্যাযজ্ঞে। ২৭ তারিখ এ খবর পাওয়ার পর টগবগে তরুণ সেলিমের মধ্যে যেন প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে। মাকে বললেন, যে কোনো দিন তিনি তাদের ছেড়ে দেশের জন্য চলে যাবেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্য হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করা সঠিক মনে করলেন বীর প্রতীক সেলিম।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর এলাকার মুক্তিকামী তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে সেলিম বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে। ভারতের মেঘালয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরের সেকেন্ড কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একাধিকবার লড়াই করেন। নভেম্বরে চলে আসেন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার লতিবপুরে। লতিবপুরে ছিল তাঁর সহযোদ্ধা কমান্ডার খায়রুল জাহান বীর প্রতীকের গ্রামের বাড়ি। তারা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ নভেম্বর সকালে তাঁরা শহরের উপকণ্ঠে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। চরপুমদী বাজার থেকে এক রাজাকার শহরের ডাকবাংলায় আর্মি ক্যাম্পে এ খবর পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে শত শত পাক আর্মি আর রাজাকাররা মিলে ঘিরে ফেলে প্যারাভাঙ্গায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দলটিকে। ভোরবেলায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। বিপুলসংখ্যক শত্রু বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা নেই বুঝে সেলিম ও খায়রুল মুক্তিযোদ্ধার ছোট দলটিকে রক্ষা করার জন্য শত্রুদের আটকে রাখার লক্ষ্যে মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে থাকেন এবং সহযোদ্ধাদের সরে পড়ার সুযোগ করে দেন। তাঁর এই অসীম সাহসিকতা ও আত্মত্যাগে ১৫-২০ জনের ছোট দলটি সেদিন রক্ষা পায়। কিন্তু পাক হানাদার আর রাজাকারদের বৃষ্টির মতো নিক্ষিপ্ত মেশিনগানের গুলিতে আহত হন। তিনি ভাবলেন রাজাকারদের হাতে ধরা দিয়ে কাপুরুষোচিত মৃত্যু মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মাণিত করা হবে। তাই তিনি কাল বিলম্ব না কর্রে গ্রেনেড চার্জ করে বসলেন। তারপর পবিত্র ভূমিতে লুঠিয়ে পড়লেন এই বীর যুদ্ধা।
পরের অধ্যায় বড় নির্মম, দুঃসহ ও বেদনাবিধুর। নরপিশাচ, কুখ্যাত রাজাকার-আলবদরের দল ছুটে এসে শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সেলিমের প্রাণহীন দেহটার ওপর। বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় তাঁর দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করল। তারপরও আক্রোশ মিটল না। মৃতদেহ রিকশায় করে পায়ের তলায় চেপে সেদিন সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছিল তারা। ঘুরে ঘুরে শহীদের পবিত্র দেহটাকে নানাভাবে লাঞ্ছিত ও প্রদর্শন করে নগ্ন উল্লাসে মেতে উঠেছিল।
পরে রাজাকার-আলবদররা শহীদ সেলিমের রক্ত দেখিয়ে পথচারীদের বলতে থাকে সেলিমকে ধরেছি। তোমরা সবাই দেখো।
পরদিন কুলিয়ারচরের গ্রামের বাড়িতে সেলিমের নির্মম মৃত্যুর বর্ণনা শুনে মা মোছা. নুর বানুর বিলাপে আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে উঠে।
একসময় নূর বানু নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন, ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। মনে মনে ছেলের লাশের সন্ধান করতেন। সেই লাশ তিনি আর ফিরে পাননি। পরে শোনা গেছে, রাজাকাররা রাতের অন্ধকারে সেলিমের লাশ অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেয়। অনেক খোঁজ করেও তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতার পর শহীদ সেলিম মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। শহীদ সেলিম বীর প্রতীক স্মরণে কুলিয়ারচর উপজেলায় সেলিম স্মৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিকামী জনতা। বর্তমানে সেলিম স্মৃতি সংসদ জেলার শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রতি বছর এ সংগঠন শহীদ সেলিমের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ খেলাষ্ঠুলা ও ক্রীড়াবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। সেলিম স্মৃতি সংসদ প্রাঙ্গণে সেলিমের বিশাল ছবিসহ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে।
শহীদ সেলিম বীর প্রতীকের বাবার নাম মো. আলী আকবর, মাতার নাম মোছা. নূর বানু। তাদের চার বোন ও তিন ভাই। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার কাশিমনগর গ্রামে। সেলিম ১৯৬৮ সালে বাজিতপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৭০ সালে ভৈরব হাজী আসমত কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। শহীদ সেলিমের বাবা দীর্ঘ দিন ছেলের লাশ খুঁজে না পাওয়ায় এবং ছেলে হারানোর বেদনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০১ সালের ২৪ জুলাই তিনি ইন্তেকাল করেন। সেলিমের বোনদের মধ্যে মোছা. শামসুন্নাহার, মোছা. নূরুন্নাহার ও আসমা আক্তার গৃহিণী। ছোট বোন সৈয়দা হোসনে আরা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে চট্টগ্রামে কর্মরত।
বীর প্রতীক সেলিমের মা অসুস্থ মোছা. নূর বানু জানান, একাত্তরের যেসব রাজাকাররা তার ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তারা এখনো জীবিত ও দাপটের সাথে আছে। একাত্তরের এই ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।