একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাসপাতালের ইতিহাসটি অনেকের জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসময়ে আহত মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবায় হাসপাতালটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ বর্তমান প্রজন্মের তরুণসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ এই অনন্য ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে তৈরি ৪০০ শয্যার বাংলাদেশ হাসপাতালটি আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে অবস্থিত ছিল। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম (বীরপ্রতীক) এ হাসপাতালে কমান্ডিং অফিসার (সিও) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
হাসপাতালটিতে ৪-৫ জন মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র কর্মরত ছিলেন। লন্ডন থেকে ডা. মবিন, ডা. জাফরুল্লাহ, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন, ডা. আকতার, ডা. মুর্শেদ প্রমুখ এ হাসপাতালে কাজ করেছেন। ১০-১২ জন ভলেন্টিয়ার আর্মি থেকে এসেছিলেন। সুবেদার লেবেলের ওপরে কেউ ছিলেন না। কোনো ভারতীয় চিকিৎসক এ হাসপাতালে নিয়মিতভাবে থাকতেন না। রোগীদের ঔষধের জন্য আগরতলার উদয়পুরে যেতে হতো ডা. সিতারা বেগমকে। উদয়পুরের ডিসি মি. ব্যানার্জি, আগরতলার এডুকেশন বোর্ডের পরিচালক ড. চ্যাটার্জি মজুমদার এবং ডা. চক্রবর্তী এ হাসপাতালের জন্য প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
এ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার ছিল। প্লাস্টিক দিয়ে থিয়েটারের মেঝে সম্পূর্ণ ঢাকা থাকত। হাসপাতালে শুধু বাঙালি রোগী, আহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধারাই চিকিৎসার জন্য আসতেন তা নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসতেন। জেনারেল রব হেলিকপ্টারে গুলিবিদ্ধ হলে তিনি বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম একাত্তরের জুলাইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশ হাসপাতালে সিও হিসেবে যোগদানের পর গোটা হাসপাতালটিতে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে এসেছিল। তিনি তাঁর মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও সেবা দিয়ে সকলের মন জয় করেন এবং মুক্তিপাগল বাঙালিদের সাহস ও শক্তি জোগান।
বীরপ্রতীক সিতারা বেগমের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার তালতলায়। মো. ইছরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেছার দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সিতারার স্থান তৃতীয়। বাবার আইন ব্যবসার সূত্র ধরে কিশোরগঞ্জ পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কেটেছে। ১৯৬১ সালে সিতারা বেগম কিশোরগঞ্জ এসভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে বিজ্ঞানে PRE-MIDICAL ও ১৯৬৩-৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে ইন্টার্নিশিপ করে চিকিৎসক হন। স্কুলজীবনে তিনি গার্লস গাইডের দলনেতা ছিলেন। অত্যন্ত তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। শিক্ষাজীবনে তিনি ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়নসহ বহু খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে প্রচুর সুনাম ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
চিকিৎসক হওয়ার পর ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ’৭০-এর আগুনঝরা দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন। ঠিক একই সময় তার বড় ভাই স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানী মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম (এসএসজি) (’৭৫-এর ৭ নভেম্বর নিহত) পাকিস্তানের চেরাট (পিন্ডি) থেকে বদলি হয়ে কুমিল্লায় তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে (এসএসজি) যোগ দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি ’৭১ রোজার ছুটিতে দুই ভাই-বোন কিশোরগঞ্জের বাসায় আসেন।
মেজর হায়দার ছুটি শেষ করে ফিরে গেলেন। ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগমের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ’৭১ মার্চের প্রথম সপ্তাহে মেজর হায়দার ক্যান্টনমেন্ট থেকে লুকিয়ে ঢাকায় ফুপার বাসায় দেখা করে সিতারা বেগমকে সেনাবাহিনীতে যোগদান না করার জন্য বলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান না করে কিশোরগঞ্জের বাসায় ফিরে এলেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনে পাকিস্তানিরা বিমান আক্রমণ করল। সিতারা বেগম পালালেন মামার শ্বশুরবাড়িতে। দুই সপ্তাহ পর আবার কিশোরগঞ্জে। এর মধ্যে কুমিল্লা সিএমএইচ থেকে ২-৩টি টেলিগ্রাম এল চাকরিতে যোগদান করার জন্য। বাবা উত্তরে পাঠালেন, সেতারা বেগম অসুস্থ। কিশোরগঞ্জ থাকার পর মিলিটারি আসার মাত্র দুই দিন আগে শহরের ১০-১২ মাইল উত্তরে হোসেনপুর মার নানার বাড়িতে তিনি পালিয়ে গেলেন। শহরে লিফলেট ছাড়া হলো এ পরিবারকে ধরিয়ে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
একাত্তরের জুলাই মাসের শেষের দিকে বীর যোদ্ধা মেজর হায়দার মুক্তিবাহিনীর সদস্য পাঠালেন। এদের সাথে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে কিশোরগঞ্জের গোজাদিয়া ঘাট দিয়ে নৌকায় ৮-১০ দিন পর তারা মেঘালয় পৌঁছান। তারপর সিলেটের টেকেরঘাটে এক সপ্তাহ। সেখান থেকে ট্রাকযোগে শিলং। শিলংয়ে ৪-৫ দিন থাকার পর অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে সব যন্ত্রণা, উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে গোহাটী দিয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মেলাঘরে পৌঁছেন এবং বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগদান করেন।
১৬ ডিসেম্বর রাতে বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে রেডিওর মাধ্যমে ডা. সিতারা বেগম ও তাঁর সহকর্মীরা ঢাকা মুক্ত হওয়ার সংবাদ পান। ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় বদলি হন। এক সপ্তাহ পর ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে এ মহিয়সী নারীর সাহসী আবদানের জন্য তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি তে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে (এলএ) ঢাকায় এলে কোথায় সেই সাহসী নারী? ((Where is that brave lady?) এই বলে সবার উপস্থিতিতে এই বীর প্রতীকের প্রশংসা করেছিলেন। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ১৯৭২-এর অক্টোবরে ক্যাপ্টেন আবেদুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ক্যাপ্টেন আবেদ একজন চিকিৎসক এবং মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।
স্বামী ১৯৭৩-এ উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে গেলেন। তাঁকেও সঙ্গে যেতে হলো। যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তোমরা যারা যুদ্ধ করলে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছো?
বড় ভাই লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার বীর উত্তমের মৃত্যু তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক স্মৃতি। যে গেরিলা কমান্ডারকে হানাদাররা স্পর্শ করতে পারেনি স্বাধীন দেশে তাঁকে ষড়যন্তকারীরা হত্যা করেছে। তার মতে, যেহেতু আমি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম তাই হয়তো প্রাণে বেঁচে আছি। নয়তো অন্য সবার মতো আমাকেও কোনো না কোনো ষড়যন্ত্রের জালে ফেলে হত্যা করা হতো।
প্রবাস জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বড় ভাইকে হত্যার পর দেশের প্রতি তীব্র অভিমান ছিল। দেশের পতাকা দেখলে আমার কান্না আসত।
ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী। বর্তমানে স্বামীসহ আমেরিকায় বসবাস করছেন।
সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছিলেন। তিনি জানান, সুযোগ পেলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে দেশে আসবেন এবং সন্তানদের সময়মতো তিনি দেশে পাঠাবেন।
কিশোরগঞ্জের বাসায় তাঁর ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা এটিএম সাফদার জিতু বলেন, বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। অথচ এ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পায়নি। বিষয়টি দুঃখজনক।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক