শহীদ মোহাম্মদ বদিউল আলমের পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার উত্তরপাড়া গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহসী ছিলেন। ছাত্রজীবনে এক ধরনের নীরবতা তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল। অন্য দশজন ছাত্রের চেয়ে তাঁকে চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান হিসেবে মনে করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বদিউল আলম অংশ নিতে পারেননি। বদিউল আলমের সহযোদ্ধা ছিলেন কাজী কামাল উদ্দীন (বীর বিক্রম)। কিছুদিন আগে তিনি মারা গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি জনাদশেক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যাচ্ছিলাম সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন কীভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটা সার্ভে করতে। মেজর খালেদ মোশারফ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) আমাদের পাঠিয়েছিলেন। ঢাকায় আসার পর আমাদের সঙ্গে যোগ হলো বদি (মোহাম্মদ বদিউল আলম)। বদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল, কিন্তু এনএসএফ করত বলে ওর ইন্ডিয়ায় যাওয়ার সাহস ছিল না।
‘আমরা যখন পিরুলিয়া থেকে রওনা হলাম, তখন আকাশ মেঘলা ছিল। আমাদের দুই নৌকার একটিতে ছিলাম আমি, বদি, জুয়েল ও আরো দুজন। সবাইকে আমি স্টেনগান নামিয়ে রাখতে বলি। কিন্তু বদি তা করেনি, তাঁর কোলের ওপরই রেখে দিয়েছিল স্টেনগানটা। আমাদের নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই সামনে নৌকার মতো কিছু একটা দেখলাম। নৌকাটা আমাদের নৌকা দুটির দিকে এগিয়ে আসে। সর্বনাশ, ওই নৌকায় পাকিস্তানি মিলিটারি। বদি আমার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে না। স্টেনগান তুলে ব্রাশফায়ার করে। পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দেয়। বদি পানিতে পড়ে গিয়েছিল। জুয়েলের ডান হাতের তিনটা আঙুল গুলিতে জখম হয়। আমার সবাই একটা নৌকাতে ফিরছিলাম।’
সিদ্ধিরগঞ্জের অপারেশন শেষ পর্যন্ত বদিউল আলমরা করতে পারেননি। কয়েক দিন পর তাঁরা অপারেশন করেন ধানমন্ডিতে। এই অপারেশন করে তাঁরা বিখ্যাত হয়ে যান। কাজী সালাউদ্দীন লিখেছেন: ‘আমাদের একটা টার্গেট ছিল ধানমন্ডির পাকিস্তান আর্মির একটা ক্যাম্প। আমরা সেখানে আক্রমণ করার পর অনেক সংঘর্ষ হলো। অপারেশন শেষে আমরা যাচ্ছিলাম আমাদের আস্তানার দিকে। পথে গাড়িতে আমরা অ্যামিউনিশন ভরি ম্যাগজিনের ভেতরে। আলম (হাবিবুল আলম বীর প্রতীক) গাড়ি চালাচ্ছিল। আলম হঠাৎ বলে উঠল, ‘কাজী ভাই, চেকপোস্ট’। গাড়িতে ছিলাম আমরা ছয়জন। বদি, হাবিবুল আলম, রুমী (শহীদ শাফী ইমাম রুমী বীর বিক্রম), সেলিম, স্বপন (কামরুল হক স্বপন, বীর বিক্রম) এরাসহ আমি।
‘আমরা ছিলাম ধানমন্ডির ৪ কি ৫ নম্বর রোডে। দুই দিকেই ছিল চেকপোস্ট। আমরা ঢুকে গেলাম চেকপোস্টের লাইনে। আস্তে আস্তে গাড়ি এগোতে থাকল। আমরা স্টেনগান নিয়ে প্রস্তুত। আলম গাড়ির স্পিড বাড়াতে থাকল। এর মধ্যে এক পাকিস্তানি সেপাই বলে উঠল, ‘রোকো, রোকো’। আমি ফায়ার শুরু করলাম। রুমী ফায়ার শুরু করে গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে। স্বপন ও বদি ডানদিকে ফায়ার করতে থাকে।’
মোহাম্মদ বদিউল আলম ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের শিক্ষার্থী ছিলেন। একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিও করতেন। তিনি যে ছাত্রসংগঠনের যুক্ত ছিলেন, সেই সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এতে যোগ দেওয়ার মনস্থির করেন। কিন্তু ভারতে যাননি। মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকায় ফিরলে তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ক্র্যাক প্লাটুনের বেশির ভাগই ছিলেন তাঁর পরিচিত। ধানমন্ডির অপারেশনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে তিনি শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মোহাম্মদ বদিউল আলমকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫০। গেজেটে তাঁর নাম মোহাম্মদ বদি। বদি নামেই পরিচিত ছিলেন।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক