শহীদ মো. আমীর হোসেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামের উত্তরপাড়ায়। মো. আমীর হোসেন পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু পকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।
এরপর পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে তিনি নিজ এলাকায় যান। জুন মাসের প্রথমার্ধে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে তাকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। সিঙ্গারবিল, আজমপুর, নবীনগরসহ আরো কয়েকটি স্থানে যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি একাধিক সশস্ত্র যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেন।
২৫ মার্চের পাকিস্তানিদের বর্বর ও কাপুরুষোচিত আক্রমণ মেনে নিতে পারেননি আমীর হোসেন। দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি প্রাণপণ লড়াই করেছেন। জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন দেশমাতৃকার ডাকে একজন অকুতোভয় সৈনিক অকাতরে জীবন দিতে পারে। আমীর হোসেন সারা দেশের গর্ব।
শহীদ আমীর হোসেন কয়েকটি যুদ্ধে হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের মধ্যে রেল যোগাযোগের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলস্টেশন মুক্তিযুদ্ধকালে সামরিক দিক থেকে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর কাছেই ভারতের সীমান্তবর্তী শহর আগরতলা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আখাউড়ার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মজবুত বাংকার ও ট্রেঞ্চ তৈরি করে অবস্থান নেয়। এখানে ছিল তাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। এই এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর ৩ নম্বর সেক্টরের অধীন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নভেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল মিত্রবাহিনীর সঙ্গে অবস্থান নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি। মুক্তিবাহিনীর একটি দলে ছিলেন মো. আমীর হোসেনরা। তাঁরা আখাউড়া পার্শ্ববর্তী আজমপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা দখল করেন। ২ ডিসেম্বর ভোর থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ওপর আবার পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এ সময় তাঁদের ওপর বিমান ও আর্টিলার মাধ্যমে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়। মো. আমীর হোসেনসহ তাঁর সহযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেও পাকিস্তানিদের নতুন আক্রমণ মোকাবিলায় ব্যর্থ হন। তাঁদের দখলকৃত এলাকা হাতছাড়া হয়ে যায়। ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকে তাঁরা আবার পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। দিনভর চলে রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধ। এ যুদ্ধে মো. আমীর হোসেনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। তাঁদের সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ৪ ডিসেম্বর পেছনে পালিয়ে যায়। তবে এজন্য আমীর হোসেনসহ মুক্তিবাহিনীর কয়েকজনকে দিতে হয় চরম মূল্য। মুক্তিবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সুবেদার আশরাফ, মো. আমীর হোসেনসহ আরও কয়েকজন শহীদ ও ২০-২২ জন গুরুতর আহত হন। তাঁদের এ রক্ত বৃথা যায়নি। ৬ ডিসেম্বর গোটা আখাউড়া এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এর ফলে ঢাকা অভিমুখে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা সহজ হয়।
শহীদ আমীর হোসেনকে সমাহিত করা হয় আজমপুর রেলস্টেশন এলাকায়। কয়েক বছর আগেও সে কবরে নামফলক ছিল। এখন নেই।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. আমীর হোসেনকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
শহীদ মো. আমীর হোসেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামের উত্তরপাড়ায়। একসময় ভৈরবের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেউ জানতেন না যে তিনি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর গ্রামের লোকজনও ১৯৮৮ সালের আগে জানতেন না তিনি খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা এটি জেনেছেন ১৯৯৮ সালে।
ব্যক্তিগত জীবনে আমীর হোসেন অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আনসার আলী সরকার। মা মোরশেদা বেগম। তিনি রেলওয়েতে চাকরি করতেন। মো. আমীর হোসেনরা পাঁচ ভাই। দুই ভাই আলী হোসেন ও সাইদুর রহমান মারা গেছেন। জীবিত দুই ভাই মো. তালেব হোসেন ও দ্বীন ইসলাম। গ্রামে অতি সাধারণ জীবনযাপন করছেন তাঁরা। আমীর হোসেন তাঁর পরিবার ও রাষ্ট্রের কাছে বিস্মৃত। তাঁর কোন ছবিও কারো কাছে নেই।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক