আমার মনের সব কথা হয়তো বলা হয় না। অথবা যা বলতে চাই সব বলতেও পারি না। ভেতরের এই যে দ্বন্দ-সংঘাত তাই হয়তো আমার মনেরই কথা হয়ে প্রকাশ পায়। এসব কথা কোনো সময় পরিশিলীতভাবে আবার কোনো সময় হয়তো এলোমেলোভাবে ফুটে ওঠে। তবে প্রকাশের ভঙ্গিমা যাই হোক, একজন লেখক মনের তাগিদেই তিনি তার কথাগুলো প্রকাশ করেন। মনের তাগিদ ছাড়া লেখা যে যায় না, লেখক মাত্রই তা বোঝেন। প্রতিটি লেখকই সৃজনশীল চিন্তা থেকে তার মনের ভাবনাটি প্রকাশ করতে চান। তিনি যে ভাবে জগৎ, সংসার এবং তার চারপাশ প্রত্যক্ষ করেন; তার দৃষ্টির বৈভব দিয়ে তিনি সেটি পাঠকের কাছে মেলে ধরতে চান। তার সৃষ্টিশীল মন, উচ্চাকাঙ্কা এবং ভালোবাসার দরদ দিয়ে তিনি জগৎ, প্রকৃতি ও জনমানবকে চিত্রায়িত করেন। কেউ সুন্দর করে পারেন, আবার কেউ বিফল হন – এটাই স্বাভাবিক। .
আমার মনে হয়, লেখকের সৃষ্টিশীলতা, তার সহজাত প্রবৃত্তিই হবে। একবার এ পথে যাদের আগমন তাদের দংশনের জ্বালা সইতে হয়। এর তাগিদ তাকে দহন করে চলে। অস্থির মন তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে। মনের ভেতরের অগ্নিগিরির লাভায় তিনি ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকেন। সঙ্গীত, চিত্রকলা, কবিতা অথবা যে কোনো নতুন সৃষ্টি ও আবিস্কারের মাধ্যমে স্রস্টার সব জ্বালা নিবৃত হয়।
মানুষের জীবন পাতায় কত স্মৃতি জমা হয়। সব স্মৃতি মনেও থাকে না। আবার অনেক স্মৃতি একেবারেই ভোলা যায় না। পথের বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। নতুন মুখ পুরাতন মুখের জায়গা দখল করে নেয়। চলার পথে নতুন নতুন কাজের অন্তরালে চাপা পড়ে পুরনো সব স্মৃৃতি। ফলে লেখকের মনেও সব স্মৃতি সমানভাবে ধরা দেয় না। বিস্মৃতির অতলে জীবনের অনেক কথা-কাজ ঢাকা পড়ে যায়। আমাদের জীবনের বহু স্মৃতিও আজ হারিয়ে গেছে। ছেলেবেলার সোনালি দিনগুলোর সব কথা আজ মনে করতে পারবো না। ছেলেবেলার সব বন্ধুর নামও মনে নেই। সেইসব হীরন্ময় দিনগুলো নিয়ে লিখতে গেলেও লেখা বেশি এগুতে চায় না। অতীতের ওইসব মধুময় গল্পগুলো বলতে না পারার একটা দহন তীব্রভাবে তখন অনুভূত হয়। সবাই যে এ কাজটি দক্ষতার সাথে পারবেন তা-তো নয়। কারণ এটা যে সক্ষমতার বিষয় এবং অবশ্যই লেখক স্বত্বা ও শক্তিমত্বার ব্যাপার। আমাকেও তা মানতে হয়।
ছেলেবেলার জীবন, পাঠশালার জীবন এবং স্কুল ও কলেজ জীবন, সেইসময়কার সহপাঠিদের সব কথা আমার মনে নেই। আমার শৈশবের সেই নদী নেই, নদীর পাড়ে যে তালগাছটি ছিল, শহরের দক্ষিণে মণিপুরি রাস্তার পাশে আমলকির যে বৃক্ষটি ছিল, আজ সেখানে তাও নেই। নদীর সেই রাশি রাশি জল, জলের ছল ছল খেলা, নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াবার দিন কবেই অতীত হয়েছে। তবু কেন জানি আজো আমি স্বপ্ন দেখি স্রোতস্বীনী নরসুন্দার। কারণ স্বপ্নহীন মানুষের জীবন মৃত। তাই তো তরুণদের কাছে আমার বলতে ইচ্ছে হয়, তোমরা আজ যা দেখছো তা সত্য নয় এবং আমার কাছে যা শুনছো তাও গল্প নয়। একদিন নরসুন্দায় রাশি রাশি জল ছিল। সেই জলের ছোঁয়ায় সতেজ হয়েছিল কিশোরগঞ্জ। আমার স্বপ্ন ; নতুন প্রজন্ম সেই গল্পকেই একদিন বাস্তবতার নিরিখে প্রতিষ্ঠিত করবে।
আমি একসময় আজিমউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেসময়ের কচি মনটা ছিল কোমল এবং সতেজ। জলে যে রঙ ফেলা যায়, জল সেই রঙ ধারণ করে- ঠিক আমরা সেদিন আমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে হীরা-মানিক, চুনী-পান্নার মত শিক্ষা পেয়েছিলাম। তখন থেকে তাই অনুসরণ করতে শিখেছি। কারণ তখনও শিক্ষায় বাণিজ্যিকরণ হয়নি। শিক্ষার্থীদের নিয়ে গিনিপিগের মত এক্সপেরিমেন্ট হতো না। সেসময় আমরা স্কুলে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপন করতাম। আমরাই আবৃত্তি করতাম এবং আমাদের সহপাঠিরা গান গাইতো। আমরা স্কুলে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতাম। সৃজনশীল এসব কাজের শুরুটাই হয়েছিল আমাদের স্কুল থেকে। এসব নান্দনিক কাজের পেছনে থাকতেন আমাদের শিক্ষকগণ। তৎকালে শিক্ষকরা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই মানুষ গড়ার কারিগর। কারণ একজন শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের পথ দেখান, জানার প্রতি তাকে আগ্রহী ও মনোযোগী করে তোলেন। তার মেধাকে বিকশিত করে তোলেন। এ কাজটি যিনি সক্ষম তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো. মতিয়ুর রহমান স্যার। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ, সংস্কৃতিবান ও আদর্শ শিক্ষক। অন্যান্য শিক্ষকরাও ছিলেন তাই। আশরাফ স্যার, অরুণ চক্রবর্তী স্যার, রমজান আলী স্যার, আহাদ স্যার, সৈয়দ ফজলুল বারী স্যারসহ এঁরা সবাই ছিলেন দেবতুল্য। ক্লাস শুরুর আগে প্রতিদিন স্কুল ক্যাম্পাসে সৈয়দ বারী স্যারের সমাবেশ পরিচালনা ছিল আমাদের জন্য আনন্দ ও উদ্দীপনাময়। ওইসব সোনালি স্মৃতির অনেক কিছুই এখন ঝাপসা হয়ে আসছে। তবু কিশোর বেলার স্মৃতিময় সেইসব দিন, শিক্ষকদের স্নেহ- আদর ও সহপাঠিদের সাহচর্য মনের অলিন্দ গলিয়ে ছবি হয়ে ভাসে।
আমাদের বিদ্যালয়ের পাশে রেল লাইনের ধারে নরম ঘাসের বিছানায় অলস বসে থাকার সেই দিনগুলোর স্মৃতি আজ ধুসর হতে চলেছে। আমার সবুজ মাঠ, বাতাবি লেবুর ফুটবল নিয়ে মাতামাতি, লাটাই হাতে ঘুড়ি উড়ানো আর নদীর জলে ধুমধাম ঝাপাঝাপির নিখুঁত বিবরণ দিতে না পারার দহনে আমি আজ পুড়ে মরি। কিন্তু একথা তো একেবারে খাঁটি যে, আমার ছেলেবেলার সোনালি দিনগুলো মিথ্যে নয়- আমার আজ এখানে আসার ভিত, সেখান থেকেই প্রোথিত হয়েছিল। শীতের সকালের মিষ্টি সোনা রোদ মাখা দিনগুলো হয়তো এলোমেলো এবং ছন্দহীন ছিল। তবে এসব দিনের নিষ্কলুস কাজগুলোই ভবিষ্যৎ সোনালী দিনের অংকুর হিসেবে বেড়ে উঠছিল। শৈশবে ও তারুণ্যের প্রাবল্যে আগে কিছুই আঁচ করা যায়নি। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিয়েছি, খেলেছি, কত দিন-রাত কেটে গেছে বেহিসেবে- টের পাইনি। স্কুল জীবনের নিয়মিত পড়াশুনার বাইরে কত ধরণের পাঠ আমার মনের অঙ্গনকে সতেজ-সবুজ করেছে। আমি রঙিন হয়েছি, বিকশিত মন ভালোবাসার চাদরে সিক্ত হয়েছে। আমার উদ্বেলিত হৃদয় নতুন নতুন পথের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছে।
কলেজে পড়ার সময়টাও ছিল একটা হীরন্ময় জীবন। এসএসসি পাশ করি ১৯৬৪ সালে। এক বছর গ্যাপ দিয়ে ১৯৬৫ সালে গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হই। সেসময়টা ছিল অনেকটা বিহঙ্গের মত। অভিভাবকদের কড়া শাসন নেই,প্রায় স্বনিয়ন্ত্রিত অনেকটা স্বাধীন জীবন। সেসময় কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন মোহম্মদ ওয়াসীমুদ্দিন স্যার। তিনি কলেজটিকে একটি আদর্শ কলেজে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসময় বাংলার শিক্ষক জিয়াউদ্দিন আহমেদ, নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, ইংরেজির রফিকুর রহমান চৌধুরী, সি এল রায়, নুরুল হক, আতিকুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকের কথা মনে হলে এখনো মনে শক্তি পাই। জিয়াউদ্দিন স্যারের কাছ থেকে সাংবাদিকতা ও লেখা-লেখির অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলাম। প্রানেশ স্যার আমাদেরকে আধুনিকতার পরশ মাখিয়ে দিয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলাম। আমার জীবনে এ এক সুখ-স্মৃতি। গুরুদয়াল কলেজের এসটি, জিআর, সিএস হলের ক্লাসরুম এবং বিশাল মাঠের সাথে মিশে আছে জীবনের সুখ,সংগ্রাম, সাফল্য-ব্যর্থতার বহু রোমাঞ্চর স্মৃতি। ছাত্র রাজনীতির কথা যদি বলি, তখনকার দিনে রাজনীতি মানে কর্তৃত্ববাদিতা নয়। বরং তা ছিল সহযোগিতা আর ভালোবাসার চাদরে আবৃত। আমরা খুঁজে নিতাম সৎ, সুন্দর, মার্জিত রুচির পরস্পরকে ও আদর্শই ছিল আমাদের সম্মিলিত হওয়ার অবলম্বন। আমরা তখন শিক্ষকদেরও সাহায্য পেতাম। তাঁরা ছিলেন এক একজন নিষ্ঠাবান ও আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা যোগ্য নেতৃত্ব বেঁছে নিতে সবসময় সৎ, চরিত্রবান, মেধাবী ও সংস্কৃতিবানদের প্রতি রায় দিতেন।
আমার কেন জানি সেসব দিনের কথা এখন প্রায়ই মনে পড়ে। আমার এখন বয়স হয়েছে। অতীতের সবকিছু ঠিকঠাক মনে করতে পারি না। অনেক কথা মনে হলেও মনের মত করে উপস্থাপন করতে পারি না। তবু শৈশব-কৈশোরে ফিরে যেতে ভালো লাগে। মনে হয়, আমারও শৈশব-কৈশোর ছিল। কৈশোরের উদ্দামতা ও চপলতায় ভর করে প্রকৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতাম। সে সব উদ্দামতার রাজত্বে কেবল আমারই কর্তৃত্ব ছিল। ছুটে বেড়াতাম, খেলতাম পিছনে ফিরে তাকাবার কিছুই ছিল না। অতীত দিন আজ বহুদূরে ফেলে এসেছি। সাংবাদিকতা ছেড়েছি বেশ আগেই। এখন আমি লেখালেখি করি। এর মধ্যে আমার বেশ ক’টি বইও প্রকাশিত হয়েছে। আগে ভাবতেও পারিনি আমার কোনোদিন বই প্রকাশিত হবে। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে একুশের বইমেলায় আমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হবে। কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরিতে আমার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হবে। হয়েছেও। লেখালেখির কারণে বেশ ক’টি পদকও লাভ করেছি। তাইতো দায়টাও বেড়েছে। দায়বোধের কারণে এখনো লেখার কাজটা অব্যাহত রেখেছি। আমার চারপাশ-সমাজ, মাটি ও প্রকৃতির সাথে সখ্যতা করেই বেঁচে আছি। কারণ এটা বোধের যেমন সচেতনতারও এমনকি অন্তরের দরদের ব্যাপারও। এ বোধ যাদের নেই তাদের কথা আলাদা। একজন লেখকের বেলায় তাই। লেখক তার মনের কথা, তার অভিজ্ঞতার কথাই লেখেন। এবং তিনি অবশ্যই এর দায় নিয়েই লেখেন।
লেখক পরিচিতি : মু আ লতিফ, সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক, কিশোরগঞ্জ।