শুভ্র দাঁড়ি টুপিতে নিরন্তর পথচলায় কখনো বসেন প্রেস ক্লাবে, কখনওবা অ্যাম্বিশন্ কম্পিউটার্সে। সফেদ পাঞ্জাবির বুক পকেটে শোভা পায় কলম। বয়স ৮৫ ছুঁই ছুঁই করলেও বার্ধক্যের ছাপ নেই চোখে মুখে। সত্য ও ন্যায়ের পথে আপোষহীন একজন আদর্শ কলম সৈনিক হিসেবে সমাদৃত আলহাজ্ব এম এম রশীদ ভূইয়া সারাজীবন মানবতার গান গেয়ে গেছেন। আলোকিত সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জগতে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। মহান পেশা শিক্ষকতার পাশাপাশি জীবনের আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে নির্ভীক কলম সৈনিক হিসেবে দেশ ও জাতিকে দিয়ে গেছেন সত্যের সন্ধান।
এই মহান মানুষটি পাকুন্দিয়া উপজেলার নারান্দি ইউনিয়নের আগরপাট্টা গ্রামে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহন করেন।
পিতা মোহাম্মদ আলী ও মাতা আয়শা খাতুনের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করে পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠেন ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৬১খ্রি: থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। চরদেওকান্দি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৯৮খ্রি: সালের ৩১শে অগাষ্ট শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহন করেন এবং সে বছরই তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পুরষ্কার লাভ করেন।
একটি সুন্দর, আদর্শ, সভ্য সমাজ বিনির্মাণে তিনি হাতে কলম তুলে নেন। কোদালিয়া এস আই উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে সংবাদপত্রের চিটিপত্র কলামে লেখালেখি থেকেই সাংবাদিকতার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। সাংবাদিকতায় তাঁর হাতেখড়ি হয় ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক অর্ধ-পাকিস্তান পত্রিকায়। তারপর একে একে দৈনিক নাজাত, ঢাকা, (থানা প্রতিনিধি) ১৯৫৮, দৈনিক পয়গাম, (মহকুমা প্রতিনিধি) ১৯৬৫, দৈনিক সংগ্রাম (মহকুমা প্রতিনিধি) ১৯৭০, দৈনিক আজাদ (থানা প্রতিনিধি) ১৯৭১, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা (থানা প্রতিনিধি) ১৯৯২, দৈনিক আজকের দেশ, কিশোরগঞ্জ (স্টাফ রিপোর্টার) ১৯৯৪-বর্তমান এবং বিভিন্ন অনলাইন দৈনিকেও তিনি কাজ করছেন। আপাদমস্তক একজন সাংগঠনিক মানুষ হিসেবেও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা।
কিশোরগঞ্জ প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠায় দিয়েছেন অক্লান্ত শ্রম, ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক, পাকুন্দিয়া প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বর্তমানেও বহাল আছেন। বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে তিনি পবিত্র হজ ও ২০১৬ সালে ওমরা হজ পালন করেন।
পাকুন্দিয়া শিক্ষক সমিতির থানা ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন কালে শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে তিনি অনেকাংশে বেগবান করেন।
সংগঠনের সভাপতি পাকুন্দিয়া হোসেনপুর আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মরহুম শামসুল হক গোলাপ মিয়ার সাথে তিনি ১৯৭৪ সালে নভেম্বর মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন এবং বন্যা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের জন্য ত্রান তহবিলে এক হাজার টাকার চেক প্রদান করেন। তখন বন্ধবন্ধুর বলেন “গোলাপ মিয়া, আমার শিক্ষকরা অধিকাংশই হতদরিদ্র। তাদের টাকা তুমি কেন নিয়ে এলে?” এই কথা বলে বঙ্গবন্ধু মরহুম শামছুল হক গোলাপ মিয়া ও এম.এ.রশীদ ভূইয়াকে বুকে টেনে নেন পরম মমতায়।
উপজেলায় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন এবং বর্তমানে সুনামের সাথে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
For men may come and men may go, But I go on for ever. আলফ্রেড টেনিসনের এই অমোঘ বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি সবসময় সমাজ, দেশ ও জাতিকে দিতে চেয়েছেন অনেক কিছু। সততা ও নিষ্ঠার সাথে তিনি তুলে ধরেছেন সমাজের অসংগতি, অসমবন্টন ও দুর্নীতির চিত্র। অন্যায়ের সাথে তিনি কখনো আপোষ করেন নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আলোর ফেরি করে বেড়িয়েছেন পথে প্রান্তরে, গ্রামান্তরে। স্বার্থান্বেষি মহলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন লর্ড একটনের বাণী “Step Towards the truth & kill the false.”
গ্রামীণ বাংলার কৃষিকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তার লেখনীতে। তুলে ধরেছেন, পাকুন্দিয়ার উর্বর মাটি ও চরাঞ্চলের রবি শস্যের ভান্ডারকে। তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক এগারিসন্দুরের ঈশাখাঁর কিংবদন্তী কাহিনী ও তৎকালীন স্থাপত্য শিল্পকে। পরিচয় করে দিয়েছেন বিশ্ব দরবারে। পাকুন্দিয়ার রাস্তা ঘাট পুল-কালভার্ট এর দৈনদশা তুলে ধরে পরিত্রানের উপায় খুঁজেছেন নিরন্তর।
তাঁর কলমে বেজে উঠেছে মানবতার সুর। দুর্দশাগ্রস্থ, মুমূর্ষু মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তুলে ধরেছেন ঘটনার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সংবাদপত্রকে বলা হয় একটি জাতির দর্পন। তাই প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিকতায় রশিদ ভূইয়া ডজন খানেক সংবাদপত্রে কাজ করার বিরল অভিজ্ঞতা সকল সাংবাদিকদের কাছে অনুকরণীয়। A pen is mightier than a sword.
জীবন যৌবন বাজি রেখে সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় ও অন্যায় অত্যাচারের লাগাম টেনে ধরতে কলম যুদ্ধে অবতীর্ন হয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন নিরলস। বন্ধবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তিনি তার মেধা, দক্ষতা ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে অবদান রাখছেন এই বয়সেও।
তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননা। বাংলা ১৪০২ খ্রিষ্টাব্দে এড. হাবিবুল হক সাহিত্য পদক, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ/৯৮ জেলা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, ২০০০ খ্রিঃ শুরুক পদক ২০০৩ খ্রিঃ কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব কর্তৃক সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট, নারী উদ্যোগ কেন্দ্র কিশোরগঞ্জের সম্মাননা। কিশোরগঞ্জ রিপোটার্স ক্লাব এর সম্মাননা। দীর্ঘ ৬২ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে জাতির ক্লান্তি লগ্নে সংকট সংগ্রামে থেমে থাকেনি তার কলম এবং আমৃত্যু কলম সৈনিক হিসেবে সমাজ ও জাতিকে অনেক কিছু দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়। “দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যারা দুর্জয়ে করে জয়, তাদের পরিচয় লিখে রাখে মহাকাল।” কবি সুফিয়া কামালের এই সত্য ভাষণের পথ ধরে আলহাজ্ব এম এ রশীদ ভূইয়া বেঁচে থাকবেন মানুষের অন্তরে, ইতিহাসের পাতায়।
লেখক: তরীকুল হাসান শাহীন, প্রভাষক (ইংরেজী) হাজী জাফর আলী কলেজ ও সাংগঠনিক সম্পাদক,উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরী,পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।