নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ১৮৩০ সালের ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম গন্ধর্বনারায়ণ। গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়নশেষে পিতার প্রচেষ্টায় স্থানীয় জমিদারের সেরেস্তায় মাসিক আট টাকা বেতনে তিনি চাকরি শুরু করেন (১৮৪০)। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল উচ্চশিক্ষা লাভের তীব্র বাসনা। তাই পাঁচ বছর চাকরি করার পর পিতার অমতেই গোপনে তিনি চলে যান কলকাতা। সেখানে পিতৃব্য নীলমণি মিত্রের আশ্রয়ে শুরু হয় তাঁর উচ্চশিক্ষা লাভের প্রাণান্ত সংগ্রাম।
কলকাতায় পড়াশুনার খরচ জোগাতে দীনবন্ধুকে গৃহভৃত্যের কাজ করতে হয়েছে। প্রথমে তিনি রেভারেন্ড জেমস লংএর অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এ সময়েই তিনি দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেন। পরে তিনি ভর্তি হন কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে (বর্তমান হেয়ার স্কুল)। সেখান থেকে জুনিয়র স্কলারশিপ (১৮৫০) পরীক্ষায় পাস করে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজের সকল পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি বরাবর সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করেন।
১৮৫৫ সালে দীনবন্ধু পাটনায় পোস্টমাস্টার পদে যোগদান করেন। এ বিভাগে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে চাকরি করার পর তিনি সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল হন। ১৮৭১ সালে লুসাই যুদ্ধের সময় দীনবন্ধু কাছাড়ে সফলভাবে ডাক বিভাগ পরিচালনা করেন, যার জন্য সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু কোনোও এক কারণে ডাক বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল হগের অপ্রীতিভাজন হওয়ায় সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেলের পদ থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়। পরে ১৮৭২ সালে তিনি ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ইন্সপেক্টর পদ লাভ করেন।
দীনবন্ধু কলেজে পড়ার সময়ই ঈশ্বর গুপ্তের সংস্পর্শে গিয়ে সংবাদ প্রভাকর, সাধুরঞ্জন প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তবে নাটক ও প্রহসন লিখেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন।নীলদর্পণ (১৮৬০) তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক এবং শ্রেষ্ঠ রচনাও। সমকালের নীলচাষ ও নীলকর সাহেবদের প্রজাপীড়ন এবং শাসকশ্রেণীর পক্ষপাতমূলক আচরণ নাটকটির বিষয়বস্ত্ত। নাটকটি তৎকালীন সমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং কৃষকদের নীলবিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং পাদ্রি জেমস লং তা প্রকাশ করে আদালত কর্তৃক অর্থদন্ডে দন্ডিত হন। বঙ্কিমচন্দ্র নীলদর্পণকে আঙ্কল টমস কেবিন-এর সঙ্গে তুলনা করেন। নাটকটি রচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত জাতীয় চেতনার পথিকৃৎ হয়ে আছে। এটিই বিদেশী ভাষায় অনূদিত প্রথম বাংলা নাটক। ১৮৬০ সালে ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে নাটকটি প্রথম ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় এবং ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর এটি দিয়েই শুরু হয় সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনয়।
দীনবন্ধু সমকালীন হিন্দুসমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রহসন রচনা করেও খ্যাতি অর্জন করেন। সমাজের সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিই তাঁর রচনার প্রধান প্রেরণা। চাকরিসূত্রে দেশ-বিদেশ ঘুরে বহুলোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর নাটকের চরিত্র সৃষ্টিতে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক ও প্রহসন হলো: নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩), বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬), সধবার একাদশী (১৮৬৬), লীলাবতী (১৮৬৭), জামাই বারিক (১৮৭২), কমলে কামিনী (১৮৭৩) প্রভৃতি। সধবার একাদশী ও লীলাবতী উচ্চাঙ্গের সামাজিক নাটক। বিয়ে পাগলা বুড়ো ও জামাই বারিক দুটি প্রহসন।
দীনবন্ধুর দুখানি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে দ্বাদশ কবিতা (১৮৭২) ও সুরধুনী কাব্য (২ ভাগ ১৮৭১, ১৮৭৬)। সুরধুনী কাব্য হিমালয় থেকে গঙ্গাদেবীর সাগরসঙ্গমে যাত্রার ছন্দোবদ্ধ বর্ণনা। এতে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জনপদ এবং বঙ্গদেশ ও সমকালীন কলকাতার বিশিষ্ট স্থান ও স্মরণীয় ব্যক্তিদের চমৎকার বর্ণনা রয়েছে।
দীনবন্ধু ছিলেন সমাজকল্যাণনিষ্ঠ শিল্পী। তিনি ছিলেন কৃত্রিমতার বিরোধী এবং সত্যের অনুসারী। জীবন সম্বন্ধে গভীর বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা তিনি কল্পনাশক্তির ন্যূনতাকে পূরণ করেছিলেন। তীক্ষ্ণ সমাজদৃষ্টি, জীবন্ত চরিত্রসৃষ্টি এবং মানবিক সহানুভূতি তাঁর সৃষ্টিকে অমর করে রেখেছে। ১৮৭৩ সালের ১ নভেম্বর তাঁর অকাল মৃত্যু ঘটে।
কৃতজ্ঞতা: বদিউজ্জামান, বাংলাপিডিয়া