কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চলের বস্তিজীবনের কথকতা সম্ভবত প্রথম উপন্যাসরূপ পেয়েছিল সমরেশ বসুর ‘ বিটি রোডের ধারে ‘ আখ্যানে। এই ধারার অনুবর্তী হয়েও স্বতন্ত্র অভিজ্ঞানে চিহ্নিত হবার যোগ্যতা অর্জন করবার মতো আর একটি উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে লেখা হয়েছিল,যার নাম ‘চার প্রহর’।
লেখক মাহমুদ আহমেদ (১৯২৫-১৯৮৪)। সমাজের নিচুতলায় ঠিক মানুষ হয়েও ‘মানুষের সৎভাই’দের মতো জীবনের যাপিত অধ্যায়গুলো, আশ্রয় যাদের ফুটপাত কিংবা পরিত্যক্ত ও অর্ধনির্মিত বাড়িঘর।জীবননির্বাহের উপায় ভিক্ষাবৃত্তি,চুরি করা অথবা বুটপালিশ করা-তাদেরই জীবননাট্যের নানা উথ্থান -পতনের গল্প ধরা আছে এখানে।
উপন্যাসটির এককত্ব একারণেই যে কলকাতায় বাসরত উর্দুভাষী মুসলমান সমাজ,বিশেষ করে নিচুতলার মানুষগুলোর যাপিত জীবন এর বিষয়। বলাটা বোধহয় অন্যায় হবে না যে এ-বিষয়ে সেদিন পর্যন্ত হয়তো এটাই ছিল প্রথম। জানি না আজও নির্ভেজাল এই সমাজকে নিয়ে বাংলাভাষায় আর কোনো উপন্যাস লেখা হয়েছে কি না?
লেখক মাহমুদ আহমেদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমাদের হাতে নেই। যেটুকু জানা গেছে তা তাঁর অনুজপ্রতিম শান্তিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক উদ্যোগে বললে ভুল হবে না। ১৯৯৬ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর একটি নাতিদীর্ঘ পুস্তক প্রকাশিত হয়, নাম- ‘ উপেক্ষিত লেখক, অপেক্ষিত অবলোকন’। তাতে অন্য কয়েকজন লেখকের সঙ্গে তিনি মাহমুদ আহমদ ও তাঁর লেখালেখি নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখান থেকেই জানা যায়, মাহমুদ আহমদ ছিলেন কলকাতা পার্ক সার্কাস অঞ্চলের বাসিন্দা।৬, সার্কাস রো তাঁর বাসভবন। সেখানেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘পার্কসার্কাস লেখক ও শিল্পীসমাজ’ নামে সাহিত্যিক আড্ডা।
বিমলকৃষ্ণ ঘোষ, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের নিত্য যাতায়াত ছিল সেখানে।মাঝে মাঝে দেখা দিতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। একটা অন্যধরণের সাহিত্যিক আড্ডা গড়ে উঠেছিল মাহমুদ আহমেদকে ঘিরে। একটা অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।দলটার রাতের আড্ডা ছিল সামসী হোটেলের একটি নির্দিষ্ট টেবিল। শোনা যায় হোটেল মালিক মালায়ালী ভদ্রলোক নাকি এই দলটার জন্য নির্দিষ্ট টেবিলটি ফাঁকা রাখতেন।
মূলত অনুবাদক হিসেবেই মাহমুদ আহমেদ সেকালে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। উর্দৃু সাহিত্যিক কিষণ চন্দরের ‘ হাম ওয়াহসী হ্যায়’ গল্প সংকলনটির প্রথম অনুবাদক তিনি। এছাড়া ছিল আরও দুটি অনুবাদ গ্রন্থ ‘অন্নদাতা’, ‘ফুল কি ফুল’। সব বইই ছাপা হয়েছিল সেকালের রুচিশীল প্রকাশনালয় ‘ সাধারণ পাবলিশার্স’ থেকে।
মাহমুদ আহমেদের একমাত্র উপন্যাস ‘চার প্রহর’ প্রথমে লিখিত হয় বড়োগল্প হিসেবে। তখন নাম ছিল ‘ কাল্লুর মা’। বিশ্ব শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে কলকাতায় আয়োজিত প্রতিযোগিতায় এটা প্রথম স্থান পায়।এরপর
‘পার্ক সার্কাস লেখক ও শিল্পী সমাজে’ পঠিত হলে লেখাটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলে।সেই আলোচনায় উপস্থিত পরবর্তীকালের খ্যাতকীর্তি অধ্যাপক হোসেনুর রহমানও।
‘সকাল’,’দুপুর’,’সন্ধ্যা’ ও ‘রাত্রি’- এই চারটি স্তরের সংক্ষিপ্ত বয়ানে এখানে পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হয়ে ওঠে কাল্লু, জরিনা, দুলহীন মা, পরমেশ্বর, রহমতেরা।অসম্ভব মানবিক গুণে ভরা এইসব মানুষের কথা বলতে বলতে লেখক জীবনের অনেক যন্ত্রণার মাঝেই রূপোলি রেখার মতো নিয়ে চলেন মায়েদের মিছিল। এমনই এক মায়ের মুখে বাঁধা হয়ে যায় উপন্যাসের ধ্রুবপদ, ” হাম মা হ্যাঁয়, হাম আপনে বেটে-কো আর জঙ্গমে নেহি মরনে দেঙ্গে।”
প্রধান চরিত্র কাল্লু। জরিনা ও সে একসঙ্গে বড়ো হয়েছে।তারা ভালোবাসে পরস্পরকে।শেষাবধি জরিনার বিয়ে হয় দাগী চোর রহমতের সঙ্গে।দাঙ্গায় গর্ভবতী জরিনা পাশবিকতার বলি হয়,তার সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। সে আর মা হতে পারবে না। আবার কাল্লুর সাথী পরমেশ্বর শৈশবে মাতৃহীন। কাল্লুর মাকেই সে মা জানে, দুলহীন মা। কেননা সে ছোটোবেলায় কাল্লুর মাকে সাজগোজ করা দুলহনের মতো দেখেছিল, তাই দুলহীন মা। সেই দুলহীন মাকেও কাজ দেবার প্রলোভন দিয়ে কেউ ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। কাল্লুর বয়স তখন বারো।আর সে ফিরে আসেনি। গভীর অভিমানে মা-প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলে কাল্লু। কিন্তু চাপা দেওয়া অভিমান একসময় বেরিয়ে আসে। রাস্তায় মিছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। মিছিল থেকে এক মহিলা এসে কাল্লুর কাছে দাঁড়ায়- ” আমন্- কা দস্তখত দিজিয়ে।…. হাম মা হ্যাঁয়, হাম আপনে বেটে কো জঙ্গমে নেহি মরনে দেঙ্গে।”
গভীর রাতে ফুটপাতের নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুমিয়ে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে কাল্লু, ” মা, তুম কাঁহা হো?” এই কাল্লুরই ‘সকাল’,’দুপুর’,’সন্ধ্যা’ ও ‘রাত্রি’ নিয়ে ‘চার প্রহর’। মা চলে গেলে তাঁকে ঠাঁই দেয় বন্ধু পরমেশ্বরের বাবা-” আব তু য়্যাঁহি রহ্ যা। য্যায়সা মেরা পরমেশ্বর, ওয়সা তু ভি।” আর এজন্য কাল্লুকে মুসলমানরা বলে, ” তে একদম মুচি বন গিয়া?” আর ওদিকে পরমেশ্বরের বাবাকে শুনতে হয়,” মুসলমানকো জগা দিয়া!” আবার এই কাল্লু ‘আওয়ারা’। বিয়ে স্থির হয়েও তার বিয়ে ভেঙে গেছে। জরিনা এখন অন্যের বিবি।কিন্তু চোর রহমতের ঘর করতে চায় না জরিনা, ফিরত যায় মায়ের কাছে। পাগলের মতো হয়ে যায় রহমত। কাল্লুর হাত ধরে বলে,” মেরা এক কাম কর্ দে কাল্লু, জিন্দগী-ভর তেরা এহসান মানেঙ্গে।” কী সেই কাজ জানে কাল্লু। কিন্তু জরিনার কাছে গিয়ে কেমন যেন হয়ে যায় কাল্লু, যে কথা সে কোনোদিন বলতে পারেনি, সে কথা বলে ফেলে জরিনাই, “চলো আওর কাঁহি হামলোগ চলে যাঁয়।”
জীবনে প্রথম আওয়ারা কাল্লু তার জীবনে কোনো উদ্দেশ্য ফিরে পেয়েও কাল্লু বলে, ” রহমত ভাই চোরিকা কারবার বিলকুল ছোড় দেগা বোলে হ্যায়!” এভাবেই মানবিক গুণে ভরপুর হয়ে ওঠে কাল্লু। মা চলে যাওয়ার দগদগে ঘা কোন গোপনে কাজ করে চলে যেন।
ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
সেই উৎসর্গ-ভাষ্যটিও চমকে ওঠার মতো-
“কথা বলতে শিখেছি মা’র কাছে
কথা লিখতে শিখেছি যাঁর কাছে
সেই পরমপ্রিয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে।”
উপন্যাসটি পড়তে বসলেই একমাত্র লেখকের ‘লিখতে শেখা’ ভাষাটির স্বাদ পেতে পারেন। গোটা উপন্যাসের সংলাপে একটিও বাংলা বাক্য নেই।বস্তি অঞ্চলের উর্দু এই ভাষা তীক্ষ্ণ অথচ মিস্টি। সংলাপের ভাষার ধার কম্যুনিকেশনের ধার বাড়িয়েছে। আর প্রথম পাতার ছবিতে আমরা বর্ণনার সূত্রটুকু ধরিয়ে দিলাম। ফজরের আজানের একটি বাক্য প্রথম অধ্যায়ে ব্যবহার করে লেখক তার অনুবাদ করে লিখেছেন, ” নিদ্রার চেয়ে উপাসনা শ্রেয়।’ এই সত্যটা জেনেও কেন যে এই সাহিত্যসাধক আর সাবস্বত-উপাসনায় মগ্ন থাকেননি, সে প্রশ্ন বিস্মিত করে, বিষাদগ্রস্ত করে।
লেখক : গৌতম অধিকারী, কলকাতা, ভারত।