ফিচার

রাসায়নিকে ফল পাকানো বিতর্কে লাভ ক্ষতি কার হলো

Md. Sohel Ahmed Khan   জুন ২, ২০১৮

সোহেল আহমেদ খানঃ পবিত্র রমজান মাস শুরুর মুহূর্তে কারওয়ান বাজারে কয়েক হাজার মণ আম ও কলা ধ্বংস করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযোগ ছিল, ফলগুলো অপরিণত অবস্থায় গাছ থেকে পেড়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হয়েছে। একই অভিযোগে রাজধানীতে আরো কয়েকটি অভিযানে ধ্বংস করা হয় প্রচুর পরিমাণ আম। অভিযোগ ওঠে, ওই আম ইথোফেন নামক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) বলছে, ইথোফেন দিয়ে আম বা অন্য ফল পাকানোয় স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, আম পাকাতে ইথোফেন ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকির। কারণ এ থেকে বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে এবং বিএফএসএর বক্তব্য সঠিক নয়। দুই পক্ষের এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান ফল পাকাতে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার নিয়ে তৈরি করে এক ধরনের জটিলতা। ভোক্তাসাধারণ ফল কিনতে গিয়ে ভোগে নানা ধরনের শঙ্কায়। এছাড়াও দেশের কৃষকদের বড় ধরণের লোকসান গুনতে হয়। আমদানী করা ফল যেখানে মাসের পর মাস বাজারে রেখে বিক্রি করা হচ্ছে সে বিষয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই। অথচ দেশিয় ফল নিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক কারন না দেখিয়েই গুজবের উপর ভর করে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহের সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলে আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং দেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আম পাকাতে বিভিন্ন দেশে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ইথিলিন গ্যাস (উচ্চ পিএইচ ও আর্দ্রতায় ইথোফেন যৌগ ভেঙে ইথিলিন গ্যাস তৈরি করে) ‘একটি চেম্বার’ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে পরিণত কাঁচা  ফল পাকানো হয়। এর জন্য বিভিন্ন দেশে ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বাংলাদেশেও মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। তবে কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হবে তার জন্য কোনো নীতিমালা নেই। ফলে ইচ্ছামতো ফল পাকাতে অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে ইথোফেন। এখানে শুধু নীতিমালা নয়, নীতি-নৈতিকতাকেও গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। মূলত রাসায়নিকের এই অবাধ ব্যবহারকেই ক্ষতিকর হিসেবে দেখছে পবা।

আম, কলা, টমেটো সহ ফল পাকাতে বাংলাদেশে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথোফেন  ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের কিছু ক্ষতিকর কারণ থাকায় সরকারিভাবে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানো সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু বিভিন্ন দেশে ‘ইথিলিন চেম্বার’ ব্যবহার করে ফল পাকানো হলেও বাংলাদেশে ফল পাকাতে স্প্রে করে ব্যবহার করা হচ্ছে ইথোফেন। এই পদ্ধতিকে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হিসেবে দেখছে পবা।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য কৃষিপণ্যে বা খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ করতে কৃষি মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির এক সুপারিশে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ফল পাকাতে নির্দিষ্ট ফলের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিক্রয় ও বিপণনের জন্য ইথোফেনসহ অন্য কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের অনুমতি নেই। যদিও দীর্ঘদিন ধরে অন্য দেশের মতো মৌসুমে এবং মৌসুমবহির্ভূত সময়ে বাংলাদেশে টমেটো, কলা, আম ও অন্য ফল আগাম পাকিয়ে বাজারজাত করতে ইথোফেন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রাপ্ত ও বাজারজাত করা তিনটি গ্রুপের মোট ৪০টি পিজিআর (প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটর) সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এর মধ্যে ইথোফেন গ্রুপের রয়েছে ১১টি, যেগুলো ব্যবহার করা হয় প্রধানত ফল পাকাতে। এর মধ্যে রয়েছে রাইপেন-১৫, রাইজার, ইথরেল, হারভেস্ট, প্রমোট, টমটম, ইডেন, প্রফিট, ইভাফন, মিষ্টি ব্রাইট ইত্যাদি।

কৃষি মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ফল পাকাতে ইথোফেন ব্যবহারের উপযুক্ততা, মানুষের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিরসন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণের লক্ষ্যে পুষ্টি ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিআরসি) সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় ইথোফেনের রেসিডিউ বা অবশিষ্টাংশ নিরূপণে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মাঠপর্যায় থেকে ফলের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে বিভিন্ন মাত্রায় (২৫০-১০০০০ পিপিএম) প্রয়োগ করা হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, টমেটোসহ বিভিন্ন ফলে ইথোফেন প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইথোফেনের অবশিষ্টাংশ যা থাকে তা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত/অনুমোদিত মাত্রার (২ পিপিএম) নিচে চলে আসে, যা মানবদেহের গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যেই বিদ্যমান। মানবদেহের প্রতি কেজি ওজনের জন্য দৈনিক ০.০৫ পিপিএম পর্যন্ত ইথোফেন গ্রহণ করা যায়। সুতরাং ইথোফেনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিরাপদ।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক (পুষ্টি) ড. মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘এটা তো পরীক্ষিত বিষয়। সরকারি কমিটিই এই কাজগুলো করছে। এই পরীক্ষায় এফএও ও ডাব্লিউএইচওর অনুমোদন রয়েছে। তার পরও তারা (পবা) কিভাবে উল্টো কথা বলছে সেটা বোঝা মুশকিল। আর এ কারণে কারো কঠিন কোনো রোগ হয়েছে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ তারা অনুমাননির্ভর কথা বলে যাচ্ছেন।’ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনায় বলছে, ইথোফেন মূলত একটি গাছের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক। তবে একটু উচ্চ পিএইচ ও আর্দ্রতায় ইথোফেন ভেঙে ইথিলিন গ্যাস তৈরি করে, তা দিয়ে ফল পাকানো হয়। সঠিক উপায় ও মাত্রায় ব্যবহার করা হলে ইথোফেন ১০০ শতাংশ নিরাপদ, কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে না। পৃথিবীর সব দেশসহ বাংলাদেশেও এটি অনুমোদিত। বিষয়টি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের রাসায়নিক দূষক, টক্সিন ও ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ প্রবিধানমালা ২০১৭-তে অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির দাবি, পরিপক্ব হওয়ার আগে ফলে রাসায়নিক ব্যবহার করা উচিত নয়। যারা এটা করে তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। তবে যেহেতু অপরিপক্ব ফলে উল্লিখিত রাসায়নিক ব্যবহার করলেও ক্ষতি নেই তাই এটি খেলে ক্ষতি নেই। অবশ্য এসব ফলে পুষ্টির পরিমাণ যথেষ্ট কমে যায়। সেটাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর আপত্তির বিষয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. মাহফুজুল হক বলেন, ‘উনারা তো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। উনারা বাইরে থেকে যেটুকু বোঝেন তাতেই কথা বলেন।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘পবা সব সময় ফলে রাসায়নিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর স্পষ্ট বক্তব্য, আগে কোনো কিছু নিরাপদ প্রমাণ করে পরে তার প্রচার করতে হবে। কিন্তু বিএফএসএ তা করেনি। কারণ ইথোফেন ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই তা ইথিলিন চেম্বার তৈরি করে তবেই ব্যবহার করতে হবে, যা করে অন্য দেশগুলো। আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয় স্প্রে করে। এভাবে ব্যবহারে সমস্যার সম্ভাবনা অবশ্যই থেকে যাচ্ছে। কারণ কিভাবে কতটুকু ইথোফেন ব্যবহার করা হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। নীতিমালা ঠিক না করে বিএফএসএ এভাবে নির্দেশনা দিয়ে ঠিক কাজ করেনি।’তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে বিএফএসএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে একবার দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ-প্রযুক্তি বিভাগের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘ইথিলিন মূলত গাছের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়। তা দিয়ে ফল পাকালে সেটি আইনত অপরাধ। এ ছাড়া এর যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে মাত্রা ঠিক থাকছে না। এ কারণে মানবদেহে নানা রোগ যেমন পাকস্থলী, ফুসফুস, লিভার ও কিডনিতে নানা জটিল অসুখ সৃষ্টি হয়।’

জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধানে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ  (বিএফএসএ) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) কে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে একটি সভা করবে। সেখানে দুই পক্ষ উপস্থিত হয়ে নিজেদের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার পর এই সমস্যার সমাধানে একটি পথ বেরিয়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল ভারতে ইথোফেন ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু ভারতের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস রেগুলেশনস, ২০১১-তে বিভিন্ন ফল পাকাতে ইথোফেন ব্যবহারে নির্দিষ্ট মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আম পাকাতে সর্বোচ্চ ২ পিপিএম পর্যন্ত ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইথোফোন ব্যবহারে আরো বেশি সতর্ক। সেখানে আমে সর্বোচ্চ ০.০৫ পিপিএম পর্যন্ত ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া আছে।

এদিকে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে শাক সব্জিতে ফল এ ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে দীর্ঘদিন মজুত করার জন্য। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়েছে ফরমালিন শুধু আমিষে কাজ করে সব্জিতে কোন কাজ করে না। মাছে ফরমালিন দিতে হলে কমপক্ষে ছয়দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে। একবার ভিজিয়ে রাখলে ফরমালিন কোন কাজ করবেনা। কার্বাইড স্প্রে প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়েছে কার্বাইড স্প্রে করে কি ভাবে? কার্বাইড নিয়ে যে ব্যক্তি কাজ করবে তার স্বাস্থ্যে ক্ষতি হতে পারে পারে কিন্তু পাকা ফলে এর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পরতে পারে না। ফলে যদি ফরমালিন দিয়েই মজুদ করা হয় তাহলে আমদানী করা ফল প্রায় ৪-৫ মাস বাজারে থাকছে তা নিয়ে কেউ কোন কথা বলছে না কেন? বা ভ্রাম্যমান আদালত আমদানী করা ফল ধ্বংস করছে না কেন? আর ভ্রাম্যমান আদালতে যে সকল পুলিশ, র‌্যাব বা ম্যাজিষ্ট্রট কাজ করছেন তারা এই সকল কেমিক্যাল বিষয়ে কতটা অভিজ্ঞ তাও ভেবে দেখা জরুরী বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন। সমন্বয় না করেই দেশি ফলগুলি ধ্বংস করে আমদানীকৃত ফলের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়ে কার লাভ করা হলো? গুজব ছড়িয়ে যে আম এবং কলা ধ্বংস করা হলো তাতে দেশের কৃষকদের যে পরিমান ক্ষতি হলো তার দায়ভার বহন করবে কে? সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে আরও সচেতন দৃষ্টি দিবেন বলে দেশের কৃষকদের আশা।

 

About the author

Md. Sohel Ahmed Khan