জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে নিত্য-নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণ তাপমাত্রা, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, উপকূলীয় ও হাওর এলাকায় বন্যা, অকাল বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়া, এসবের ফলে দেশে মোট খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়াসহ দেশের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার মতো সমস্যা লেগেই আছে। সেইসাথে নদী ভাঙনের কারণে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কমছে কৃষিজমি, বসত- ভিটা হারিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা। এর সবচেয়ে বড় শিকার তৃণমুলে বাস করা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যার বেশির ভাগ অংশই কৃষক, বর্গাচাষি ও শ্রমিক।
শত প্রতিক’লতার মাঝেও নিম্ন আয়ের এই সাধারণ মানুষেরাই বদলে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতির চাকা। আমাদের দেশ নিম্ন আয়ের থেকে মধ্যম আর মধ্যম আয়ের থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যাত্রায় মূখ্য ভূমিকা কিন্তু রাখছে এই তারাই। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, আকাশের রুদ্রমূর্তিকে উপেক্ষা করে এই কৃষক- শ্রমিক উৎপাদন করে বলেই আমরা নিশ্চিন্তে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। গত কয়েক বছরে অসংখ্য কৃষক শুধুমাত্র ক্ষেতে- খামারে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন বিদ্যুতস্পৃষ্ঠ হয়ে। এদেরই শ্রম- ঘাম আর জীবনের বিনিময়ে সরকার মাথা উচু করে বলতে পারে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
যাদের জন্য আমাদের এই সফলতা সেই সোনার কৃষকরাই আজ মহা দুঃচিন্তায় দিন-রাত পার করছেন। তাদের কপালে ঝুলে আছে মামলার খড়গ। সম্প্রতি দেশের গণ্যমাধে প্রকাশিত কৃষিঋণ সার্টিফিকেট মামলা সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রায় দুই লাখ কৃষক মামলার জালে আটকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এই মামলাগুলো করেছে। টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েই মামলা করেছে ব্যাংকগুলো। এ সংক্রান্ত সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এই ব্যাংকটি একাই ৮১ হাজার ৫৫৫ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭০ কোটি টাকা। আমরা জানতে পারি, এসব মামলায় এমন অনেক বর্গাচাষি অন্তর্ভুক্ত, যাদের নিজের জমি নেই, অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে জীবনধারণ করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যম‚ল্য না পেয়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া কৃষিঋণের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যার্থ হয়েছেন অসংখ্য বর্গাচাষি। অনেকে আবার পাঁচ হাজার টাকার ম‚ল ঋণ নিয়েছেন, যা ১০ থেকে ১৫ বছরে সুদে-আসলে বেড়ে দ্বিগুণ বা তার বেশি হয়ে গেছে। ফলে অর্থ পরিশোধ করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে ভ‚মিহীন কৃষকদের জন্য। সেইসাথে মামলা থাকার কারণে নতুন করে তারা কোনো ব্যাংক ঋণও নিতে পারছেন না। ফলে অর্থ পরিশোধের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
গেল বছর এমন চিত্র আমরা হাওরে দেখেছি। ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতে হাওরের ফসল ডুবে যাওয়ায় কৃষক সর্বশান্ত হয়েছেন। যে কারণে তারা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। উপরন্তু এর বাইরে এনজিও কিংবা মহাজনের কাছ নেয়া ঋণও তারা পরিশোধে ব্যার্থ হয়েছেন। সে সময়টায় কোনরকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই তাদের জন্য ভয়ানক অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। অবশ্য তখন আমরা, দেশের জনগণের পাশপাশি নানা উদ্যোগ নিয়ে সরকারকেও তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে একটি পত্রিকা বলছে, বর্তমানে দেশে প্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার কৃষক মামলার জালে বন্দি। জনপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য দেশের কৃষকের নামে এখনো এই সার্টিফিকেট মামলা ঝুলছে। এদের মধ্যে আবার ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭২ জন কৃষকের নামে, যারা অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে গ্রেফতারের ভয়ে অনিশ্চিত জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বছরের পর বছর এই মামলাগুলি ঝুলে আছে। চলতি বছর মে মাসেই নতুন করে ৩৪১টি মামলা হয়েছে কৃষকদের নামে। হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর গড় পাওনার পরিমাণ মাত্র ৩০ হাজার ৬৬৭ টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৭৫ জন কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫১৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
তবে কৃষকরা যে ইচ্ছাকৃত ব্যাংকঋণের টাকা পরিশোধ করছেন না বিষয়টি এমন নয়। বর্তমানে অন্যান্য পণ্যের সাথে কৃষি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্য উৎপাদন করে প্রত্যাশিত লভ্যাংশ অর্জনে ব্যার্থ হচ্ছেন তারা। গণমাধ্যমের বদৌলতে প্রায় সময়ই আমরা দেখতে পাই ধান, আলু, টমেটো, বেগুন, করলা, দুধসহ নানা কৃষি পণ্যের নেয্যমুল্য না পেয়ে তা সড়কে ঢেলে প্রতিবাদ করছেন কৃষক। বাজারে পণ্যের দাম চড়া থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়াদের কারণে তারা পণ্যের ন্যায্যম‚ল্য পান না। সঙ্গত কারণেই ব্যাংক থেকে গ্রহণ করা ঋণের অর্থ যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে।
যেখানে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে, অল্প কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠি বা গুটিকয়েক ব্যাক্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা, কয়েকজন মিলে ভাগ করে নিয়ে নিচ্ছেন একেকটি ব্যাংকের মালিকানা। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ টাকা পরিশোধ না করায় চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে ব্যাংকগুলো। ক্রমে ক্রমে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বাইরে চলে যাচ্ছে ব্যাংক খাত। নানা উদ্যোগ নিয়েও এখাতে সফলতা আসছে না, শেয়ার বাজারের মতো এ খাতটিও দিনকে দিন সাধারণ মানুষের আস্তার বাইরে চলে যাচ্ছে। সেখানে মাত্র ৫১৬ কোটি টাকার জন্য প্রায় দুই লক্ষ কৃষকে নিত্য হেনস্তা শিকার হতে হচ্ছে! অথচ এরাই কিন্তু সচল রাখছে রাষ্টের অর্থনীতির চাকা। এর দায় কিন্তু ঋণগ্রহনকারী কৃষকের একার নয়, ঋণপ্রদানকারী ব্যাংকগুলোর রয়েছে। তারা শুধু ঋণ বিতরণ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করেছে। অথচ যদি ঋণ বিতরণের সময় ঝতকি নিরূপণ করে কিংবা পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে এবিষয়ে ফলোআপ করা হতো, তাহলে হয়তো এ পরিস্থিতির মুখে তাদের কাউকেই পড়তে হতো না।
উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায়, বিশ্বব্যাপি জলবায়ুর প্রভাবে আক্রান্ত বাংলা কৃষককে বাঁচাতে কৃষিঋণ সংক্রান্ত সকল সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করত সমস্ত কৃষিঋণ মওকুফ করতে হবে। সেইসাথে এনজিও ঋণের সুদের হার কমাতে হবে, দাদন বা মহাজনী ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আপদকালীন সময়ে তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তিতে কৃষকদের ঋণ দেওয়ার সময় ঝতকি নিরূপণ করে দিতে হবে যাতে তারা আর ঋণের জালে আটকে না যায়। তবেই জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাণ বাজি রেখে লড়াই করে দেশ গঠনে কাজ করতে সহজ ও সহায়ক হবে কৃষকদের জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলার কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে মানুষ, উন্নত হবে বাংলাদেশ।
ফয়সাল আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক ।