প্রান্তে নয়, কেন্দ্রেই রাজনৈতিক জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম আমি। ১৯৬৯ সালের কথা। তখনও কিশোরগঞ্জে ছাত্রলীগ করি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ঢাকায় চলে এলাম। বিএ পাস করার পর এক ইয়ার লস দিয়ে আইন পড়ব বলে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুকে আমার পরিকল্পনা জানাব বলে গেলাম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে। আমাদের সবার প্রিয় মুজিব ভাই আমার ঢাকায় আসতে চাওয়ায় প্রবল আপত্তি জানালেন। সেই দিনটির কথা আমি আগেও লিখেছি, বলেছিও বহুবার, সভা-সমাবেশ এবং অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়। এর আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু’বার দেখা হয়েছে আমার। সেটি ছিল তৃতীয়বারের মতো প্রিয় নেতার মুখোমুখি হওয়া। বঙ্গবন্ধু বয়োকনিষ্ঠদের সাধারণত তুই করে বলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘না, তোর ঢাকায় আসা চলবে না। তুই সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি হয়ে কিশোরগঞ্জ চলে যা। সেখানে গিয়ে সংগঠন আর আন্দোলনে মন দে।’ আমার মন খারাপ হলো। তখন ঢাকায় এসে রাজনীতি করার জন্য ব্যাকুল আমার মন। সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি না হওয়ার জন্য একটু চালাকি করে বলি, ‘বাড়ি থেকে যে টাকা নিয়ে এসেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই তা শেষ হয়ে গেছে, অন্য কোথাও ভর্তি হওয়ার মতো টাকা নেই।’ বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে নিজের পকেট থেকে ৩০০ টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন। সেই সময় ৩০০ টাকা, অনেক টাকা।
বঙ্গবন্ধু যখন আমাকে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি হয়ে কিশোরগঞ্জে ফিরে যেতে বলছিলেন, তখনই সেখানে এসে ঢুকেছেন তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, “হামিদকে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি করার ব্যবস্থাটা করে দাও এবং বইপত্র কিনে দিয়ে কিশোরগঞ্জ পাঠানোর ব্যবস্থা করো।” অগত্যা কী আর করা, কিশোরগঞ্জে ফিরে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার কাজেই মনোনিবেশ করলাম।
তখন তো বুঝতে পারিনি, আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। এখন বুঝতে পারি, তৃণমূলে ফেরার রহস্য। বঙ্গবন্ধু এভাবেই আমাকে শিখিয়েছিলেন জনগণের কাছে যাওয়ার মাহাত্ম্য। আমার নির্বাচনী এলাকা তো বটেই, পুরো কিশোরগঞ্জে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। কিশোরগঞ্জের এমন কোনো পাড়া-মহল্লা নেই, যেখানকার মানুষজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। সত্তরের নির্বাচনের সময় আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও তাড়াইল নিয়ে। পরে অবশ্য নিকলী ও তাড়াইল আলাদা হয়ে গেছে। আজকাল হাওরাঞ্চলের ওইসব গ্রাম থেকে যখন তরুণরা আমার কাছে আসে, আমি তাদের পুরনো মানুষের কথা জিজ্ঞেস করি। আলাপে-আলাপে জানা হয়ে যায়, আমার চেনা মানুষটি হয়তো ওই তরুণটির বাবা-চাচা, অথবা নিকটাত্মীয় কেউ। তরুণ-তরুণীদের কেউ কেউ জানায়, আমার চেনা মানুষটি তার দাদা, ওই মানুষটি এখন আর বেঁচে নেই। মানুষকে নামধামসহ মনে রাখতে পারাটাও আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শিখেছি। তবে বঙ্গবন্ধুর মতো স্মৃতিধর হতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৬৪ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় দেখার মধ্যে ব্যবধান ছিল বছর তিনেকের এবং দ্বিতীয়বার যখন দেখা হয়, তখন নিমিষেই আমাকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি।
প্রথম দেখা হওয়ার গল্পটাই প্রথমে বলি। সময়টা ছিল ১৯৬৪ সাল। তখন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র আমি। তখনও কিশোরগঞ্জ ছিল মহকুমা এবং আমি মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুজিব ভাই ওই সময় কিশোরগঞ্জ আসেন আওয়ামী লীগের সমাবেশে। নেতার সঙ্গে দেখা করা এবং কথা বলার আগ্রহে আমরা দু-তিনশ’ ছাত্রলীগ কর্মী নিয়ে সমাবেশস্থলে গিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। আমরাও নাছোড়, বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম, নেতা বের হলে প্রয়োজনে রাস্তার মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করব, কথা বলব। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা সফল হয়েছে, আমরা প্রিয় নেতার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলাম সেদিন। তিনি আমাদের উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তায় উদ্দীপ্ত করেছিলেন।
প্রথমবার দেখা হয়েছিল ভিড়ের মধ্যে। অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মধ্যে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমি ছিলাম মুখপাত্র। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সন্ধ্যার আগে আগে তিনি যখন সমাবেশ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন আমরা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য স্লোগান ধরলাম, ‘মুজিব ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে’। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন, আমরাও সমস্বরে অভিযোগ জানালাম, ‘আমরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসেছিলাম আপনার বক্তৃতা শুনতে; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের হলের ভেতরে ঢুকতে দেননি।’
এইটুকু সময়ের দেখায় বঙ্গবন্ধু আমাকে মনে রাখতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন দেখা হলো, দেখামাত্রই আমাকে চিনতে পারলেন তিনি এবং নাম ধরে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন। অথচ সময়টা ছিল প্রতিকূল। তিনি ছিলেন বন্দি এবং রাতের বেলা আমরা ট্রেন থামিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সম্ভবত ১৯৬৭ সালের প্রথম দিকের কথা এটি, সিলেটে গিয়ে গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। খবর পেলাম, পুলিশ তাঁকে বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেনে করে সিলেট থেকে ময়মনসিংহে নিয়ে যাবে। ততদিনে বঙ্গবন্ধু বাংলার অন্য সব নেতাকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছেন। এর আগের বছর ৭ জুন জীবনবাজি রেখে ছয় দফা ঘোষণা করে শাসকদের কাছে যেমন নিন্দিত হয়েছিলেন, তেমনি আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বাংলার অধিকার আদায়ের প্রতিভূতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এবং তিনিও দাবির পক্ষে জনমত গঠনের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো সিলেট গিয়েছিলেন।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের পরিস্থিতি ছিল সংকটাপন্ন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে আহূত বিরোধীদলীয় সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল যোগ দেয়। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র নিয়ে সেখানে বিভিন্ন দলের নেতারা আলোচনা করেন। আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই ফেডারেল পদ্ধতির সংসদীয় সরকার এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে এসেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেন। ওই দাবিনামা তখনও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো সভায় গৃহীত সুপারিশ ছিল না। ওই দাবি উত্থাপনের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা তো বটেই, তাদের পূর্ব বাংলার তাঁবেদাররা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তারা মুহূর্ত দেরি না করে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করা শুরু করেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক হলেও বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উপস্থাপন করেছিলেন তার ব্যক্তিগত সুপারিশ হিসেবে। কয়েক সপ্তাহ পরই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ছয় দফাকে অনুমোদন করিয়ে নেন। ছয় দফার মূল বক্তব্য ছিল- প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ছয় দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় উত্তর দেওয়া হবে। ছয় দফা ঘোষণার পর কারান্তরীণ করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন এবং মোট সাড়ে ১১ বছর জেলে কাটিয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দু’বার। শুনেছি ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য।’
আমরা দারুণ উদ্বুদ্ধ ছিলাম তখন। সিলেট থেকে বঙ্গবন্ধুকে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হবে কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে– এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা চার-পাঁচ হাজার ছাত্র জড়ো হয়ে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন অবরুদ্ধ করে ফেললাম। সন্ধ্যা থেকেই আমরা স্টেশনে জড়ো হচ্ছিলাম। রাত ১২টায় যখন ট্রেনটি এলো, তখন স্টেশনে তিলধারণের জায়গা নেই। আমরা তো মুজিব ভাইকে না দেখে, তার বক্তৃতা না শুনে ট্রেন যেতে দেব না। তাকে রাখা হয়েছিল ফার্স্ট ক্লাসের একটি কামরায়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আমরা কয়েকজন সেখানে গেলাম। ‘হামিদ’ বলেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বুঝলাম, একবারের দেখাতেই নেতা আমার নামটি মনে রেখেছেন। আমরা একটি হ্যান্ড মাইকেরও ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। সেই মাইক হাতে ট্রেনের বগির দরজায় দাঁড়িয়ে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি ১০-১২ মিনিট বক্তৃতা করলেন। সবশেষে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আন্দোলন চালিয়ে যা, জয় আমাদের হবেই।’
সত্তরের নির্বাচনে জয় আমাদের হয়েছে। ওই নির্বাচনের সময় মুজিব ভাই গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটি বুঝতে পারলাম। সত্তরের জানুয়ারি মাসে কিশোরগঞ্জে একটা জনসভা করেছিলাম আমরা। ততদিনে আমি ছাত্রলীগের সভাপতি পদ থেকে বিদায় নিয়েছি। লোকজনকে বলি আওয়ামী লীগ করি, কিন্তু কোনো কমিটিতে আমার জায়গা হয়নি। সভাপতির পদে না থাকলেও ছাত্রসংগঠন পুরোটাই আমি নিয়ন্ত্রণ করি। ওই জনসভার আগে কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ একটা মিটিং ডাকল। জনসভার জন্য অভ্যর্থনা কমিটি করা হলো। আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম আবদুস সাত্তার অ্যাডভোকেটকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হলো। আমাকে করা হলো সদস্য সচিব। জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সেই প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো আমার। বঙ্গবন্ধুর মতো বাগ্মীর সামনে বক্তৃতা দেওয়া একটা দুঃসাহসের কাজ। বঙ্গবন্ধু শুনলেন এবং পছন্দও করলেন। বোধ হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে, সাধারণের ভাষায় যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টাকেই পছন্দ করেছিলেন তিনি। তাই সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়েছিলেন।
সত্তরে আমিই ছিলাম আওয়ামী লীগের সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী। বঙ্গবন্ধু অবশ্য প্রথমে আমাকে এমপিএ (মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেমব্লি) নির্বাচন করতে বলেছিলেন। আমি ভাবলাম, ইলেকশন যদি করিই তাহলে এমপিএ কেন, এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) ইলেকশনই করব। বঙ্গবন্ধুকে আমার এ ইচ্ছার কথা জানাতেই তিনি বললেন, মেসবাহ উদ্দিন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক জজকে আমার নির্বাচনী এলাকা (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-নিকলী-তাড়াইল) থেকে এমএনএ নির্বাচনের জন্য মনোনীত করে রেখেছেন। মেসবাহ উদ্দিন সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে পরে আমাকে সত্তরের নির্বাচনে প্রার্থী করা হয় এবং বয়স বিবেচনায় তৎকালীন পাকিস্তানে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ এমএনএ প্রার্থী।
কিশোরগঞ্জে সত্তরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জনসভার পর এপ্রিল মাসে ঢাকায় এসেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। এবার আমাকে দেখেই তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। সেই হাসি যেন থামেই না। ভাবলাম, আমার কাপড়-চোপড়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি-না। তিনি যত হাসতে থাকলেন, আমার অস্বস্তিও তত বাড়তে থাকল। হাসতে হাসতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুর জজ মারা গেছে। আমি কি আর তোর কথা না রাইখা পারি। তুই তো আমার দাদা।’ বঙ্গবন্ধুর দাদার নাম যে শেখ আবদুল হামিদ সেটা তখনও আমার জানাই ছিল না।
জজ সাহেব নেই, তাই বঙ্গবন্ধু যে আমাকেই মনোনয়ন দেবেন, এই খবর আব্বাকে জানালে তিনি খুবই অবাক ও যুগপৎ খুশি হয়েছিলেন। আমার আব্বা হাজী মো. তায়েবউদ্দিন সর্বদাই চাইতেন তার ছেলেরা সমাজের নেতৃত্ব দিক। আমার বড় ভাই মো. আবদুল গণি ছিলেন আমাদের ইউনিয়নের বিডি সিস্টেমে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আব্বার পক্ষপাত ছিল আমার প্রতি। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার ছেলে হামিদ, মিঠামইনের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধেও তিনি সূক্ষ্ণভাবে আমার পক্ষই নিতেন। ১৯৬৪ সালে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আদলে মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মাধ্যমে আইয়ুব খান বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হন। সেই সময় আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক ছিল গোলাপ ফুল এবং ফাতেমা জিন্নাহর হারিকেন। আমার বড় ভাই গোলাপ ফুলের নির্বাচন করছেন, আমি হারিকেন। একই দিনে দুই ভাই ভোটারদের নিমন্ত্রণ করলাম। এখন ভাই তো আমাকে ছাড় দেবেন না। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের লড়াইয়ে আব্বা মধ্যস্থতা করে বললেন, গণির যেহেতু আয়-রোজগার আছে, সে তার মেহমানদের অন্য কোনোখানে খানাদানা করাক, হামিদ বাড়িতেই আয়োজন করবে। মাছ-ভাত দিয়ে আমি ৭-৮ শত লোকের মেহমানদারি সেরেছিলাম সেদিন এবং আব্বা নীরবে আমাকে সমর্থন করেছিলেন।
সত্তরের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধুর মনোনয়ন পাওয়ার পর আব্বারও সমর্থন পেলাম। বঙ্গবন্ধু আব্বাকে আমার নির্বাচনী খরচ দেওয়ার জন্য বলে দিলেন। আব্বা আমাকে দুই কিস্তিতে ৫০ হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া প্রায় ছয় মাস নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সময় পঞ্চাশ-ষাটজন লোকের, কোনো কোনো সময় একশ’-দেড়শ’ লোকের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হতো। আমি বঙ্গবন্ধুকে ধরেছিলাম আরও কিছু টাকা দেওয়ার জন্য বলে দিতে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, নির্বাচনের জন্য এত টাকা লাগে না। তবে বঙ্গবন্ধু ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীর জনসভায় আমার জন্য ভোট চাইতে গিয়েছিলেন। কোনো কোনো জায়গায় নৌকা থেকেও বক্তৃতা করলেন এবং বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলাম। নির্বাচিত হলেও স্বাধীনতার আগে সংসদে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমাদের। তবে সত্তরের ওই নির্বাচন আমাকে বঙ্গবন্ধুর মতো এক মহান নেতার আরও কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিল এবং তার কাছ থেকে শিখলাম, রাজনীতি হচ্ছে মানুষের মনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা। মানুষও আমাকে প্রতিদান দিয়েছে, আমার মতো প্রান্তবর্গীয় একজন সাধারণ মানুষ তাই দু’বার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিরল সুযোগ পেয়েছে।
লেখক :গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। নোট: লেখাটি দৈনিক সমকাল থেকে নেয়া হয়েছে।