মানবতার কবি ও নদী প্রেমিক মীরন রশীদের অকাল মৃত্যুতে স্মৃতিচারণমূলক এই লেখাটি কবির প্রিয়জন লেখক, আফজাল হোসেন আজম রচনা করেছেন। নরসুন্দা ডট কম এর পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করা হলো।- সম্পাদক।
কবি মীরন রশীদ না ফেরার দেশে চলে গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে। গত ১২ অক্টোবর ২০১৮ খ্রি. হঠাৎ স্ট্রোক করলেন কবি। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার সাথে সাথেই হৃদক্রিয়া বন্ধ! থেমে গেল জীবন নদ। মানবতার জায়গা থেকে কবিতা লিখতেন যিনি, বৃক্ষের সু-শীতল ছায়ায় বসে আর বৃক্ষরোপন করতেন দেদারে। স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের মৃত ও গতিরুদ্ধ সাতশো নদ-নদীকে কিভাবে নব-যৌবনা করা যায়।
তাঁর স্বপ্নের ভিশন কাগজে কলমে সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। নিষিক্ত হতে দেয়নি বিধি। স্বপ্ন ডানাগুলো ঝড়ে ভেঙ্গে পড়লো। মৃত্যুনামক কালো থাবায়। কবির স্বপ্নকে থামতে দিলে চলবে কি? চলবে না। কবিতো নিজের জন্য ডাক দেয়নি। সুন্দর একটি প্রাকৃতির বিশ্ব ছিল তাঁর স্বপ্ন সাধনা।
যুগে যুগে সাহিত্য ও সভ্যতা বির্নিমানে ক্ষনজন্মা কবি, লেখকগণ ও পরিবেশবাদীরা আসে ঘড়ির কাঁটার মতো। বর্তমান গ্লোবাল বিশ্বে প্রকৃতি যেখানে ধূসর পান্ডুলিপি, শিল্পায়নে, নগরায়নে সেখানে কলম সৈনিকেরা বসে থাকলে চলবে কি? বসে থাকেনি কবি মীরন রশীদ। মানবতার শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্রফল ছিল উনার কবিতায়।
প্রকৃতির বৈচিত্রতা রক্ষার আহবান ছিল ছড়ায় ও ছন্দে। নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও। অপঘাতে সাধারন শ্রমজীবী, সাধারন মানুষ সমাজব্যবস্থার দৃষ্টতায় সময়ের হাতে বন্দী, আইনের হাতে জিম্মি। এই স্বত্তা ও সিগ্ধতার না দ্বাম্ভিক ভাষ্যে শিল্পায়িত করার প্রয়াস খোঁজেন একজন স্বার্থক কবি ও সমাজ সেবক। সেই অর্থে সদ্য প্রয়াত মীরন রশীদ অনন্য।
মুজিববাদ এর দর্শন ছিল বুকে। ছাত্রনেতা হতেই মূত্যু অবধি চাইতেন মুক্ত সমাজ, মুক্ত ন্যায় বিচার। যা আমাদের সাংবিধানিক দ্বায়বদ্ধতা ও বটে। খোঁজতেন কালচক্র আর মানুষের জীবনচক্রের মধ্যে অন্বয় ও ব্যতয়সূত্রটা। আজ কালের চাকা উন্মুক্ত যন্ত্রের মতো ঘুরছে আর তার হাতেই আমাদের সাবির্ক যাপন। মানবতার মৃত্যু যেন মেশিনে গোনা হচ্ছে বা বুঝানো হচ্ছে। মানুষের মৃত্যু পণ্য উৎপাদনের এক বিশেষ উপায়। পথবাসী নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবন প্রণালী, ধনাঢ্যদের বিলাস ঘড়ি পরিমেয় কালের গতি মূলতঃ একটি নিষ্টুর আবহ তৈরী করে। যা মৃত্যু বলে অখ্যায়িত।
নদ-নদীর বেলায়ও তাই। আমাদের বিশ্বরক্ষার ঔষধি খুঁজতে হবে। যা মিডিয়ার বাহিরে থেকে খুঁজতেন কবি মীরন রশীদ। ডায়েরির পান্ডুলিপি আর হৃদয়ের জমাটবাঁধা শ্বাস। বৈ আর কি? তাইতো অকাল প্রয়াণ। আমাদের ঔষধি খুঁজতে হবে। মানবতার দায় থেকে। সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে কাব্যিক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কল্পকাহিনী, শিশুতোষ সব ক্ষেত্রেই বিচরণ ছিল।
স্পষ্টভাষী মৌখিক কথাসাহিত্য ছিল উনার শ্রেষ্ঠ গুন। আধুনিক তরুণ লেখকরা যেমন সংস্কারমুক্ত, পাঠকেরাও তেমনি বিশ্বায়িত ও প্রতিশ্রুতিশীল। কবি বিনে আজ নদী বিষয়ক পত্রিকা-“রিভার বাংলা”র অস্তিত্ববাদ বা সংশয়বাদ তৈরী হচ্ছে। অচিরেই সময়ের হাত ধরে এসব লাগব হবে। কালের পুত্র কন্যারা তা সামলিয়ে নিবে। নদ ও জীবন থেমে থাকে না। নিয়ম গড়াই হয় ভাঙ্গার জন্য। সময়েই ভেঙ্গে দিবে। আর সোনার হরফে কেউবা পূরণ করবে প্রয়াত কবির স্বপ্ন।
পরিশেষে কবির অকাল প্রয়ানে এইটুকুই বলতে চাই যে, মানুষেই শিল্প। মানুষের স্বাভাবিক আচরণ প্রক্রিয়া, কর্ম -শিল্পের প্রধানতম উপকরণ। মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষের দূরত্বকেই কেবল মাপা যায়। মানব জীবনের মর্মবানী উপলব্ধি করা যায় না। অর্জন করা যায় না মনুষত্বের বিপুল ঐশ্বয্য।
শিল্পের আদি উৎস হচ্ছে মানুষ। মানুষের শক্তি, কর্ম, সুন্দর্য্য, প্রেম, আকুতি, আর্তি, সত্যবোধ, অন্বয়, ব্যতয় আর অভিপ্রেরণা নিয়েই সৃষ্টি হয় শিল্প প্রসাদ। মানুষ তাঁর হৃদপৃন্ডের ফুল্পুধারার উপরে নির্মাণ করে সভ্যতা। এক্ষেত্রে বস্তুবাদীদের স্থান কোথায়? ভাববাদীরাই ত্রাতা। যুগে যুগে ভাববাদী মানুষেরাই অগ্নিবীণা হাতে তোলে নিয়েছেন অসুরের বেসুর কন্ঠ স্তব্ধ করে দিতে। মানুষের সত্যাগ্রহের শুভ অস্তিত্বইতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে সম্পদ রক্ষা করে যেতে হয় মৌলিক উত্তরাধিকার সূত্রে। ইতিহাস কালের কোন পল্পবে কখন যে কোথায় দোলা দেয় কে জানে?
মানুষের নিজ নিজ চিন্তায় একটি চেতনার বীজকন্যা লুকিয়ে আছে। সবাই তা নিষিক্ত করে যেতে পারে না। কবি মীরন রশীদ বিহনে আজ আমরাই তার স্বত্তার নিষিক্ততার উত্তরাধিকার। তাই তার অপ্রকাশিত লেখা ও স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভাল থাকুন কবি তারার দেশে। আমাদের জন্য লোকেশন খোঁজুন। আপনার আত্মার মুক্তি ও পরিবার পরিজনের সুখ সমৃদ্ধি কামনা করে শেষ করছি।
আফজাল হোসেন আজম : কবি ও লেখক, তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ।