কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পুরাতন কোর্ট রোডের সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের পেছনে এ. কে. এম রফিকুল হকের পৈত্রিক বাড়ি। তিনি কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি বন্ধুদের নিয়ে কীভাবে যুবকদের সংগঠিত করে পাকিস্তানিদের পরাজিত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকেন। বন্ধু সহযোগী আতিকুর রহমানকে (ভৈরবে পাক হানাদারদের গেরিলা আক্রমণ করতে গিয়ে নিহত ‘শহীদ আতিক’) নিয়ে বিভিন্ন প্রচার অভিযান চালান।
একাত্তরের ২৬ মার্চ ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যার পর মেজর শফিউল্লাহ জয়দেবপুর থেকে প্রথমে ময়মনসিংহে এবং ৩০ মার্চ তার হেড কোয়ার্টার কিশোরগঞ্জে স্থানান্তর করেন। ১ এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ আজিম উদ্দিন হাইস্কুলে তিনি অবস্থান করেন। পরদিন খবর আসে মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তিনি শফিউল্লাহর সাথে কথা বলতে চান। শফিউল্লাহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে যান। কথা বলার পর পরিকল্পনা নেওয়া হয় যুক্তভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট অঞ্চল মুক্ত করার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হেড কোয়ার্টার কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া টি গার্ডেনে ৩ এপ্রিল স্থানান্তর করা হয়। এ সময় রফিকুল হকসহ কয়েকজন মেজর সফিউল্লাহর সাথে যেতে আগ্রহী হন। কিন্তু সহপাঠী সবাইকে জড়ো করতে পারেননি।
পরে রফিকুল হক ও আতিকুর রহমান মোটর সাইকেলযোগে শহর ও আশপাশের বাসায় সবাইকে খবর দিয়ে ১৭ জন তরুন সমেত ১৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় মেজর সফিউল্লাহ সাথে দেখা করেন। কিশোরগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মো. খসরুজ্জামান চৌধূরী দলটিকে যেতে সহযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেন। পরে ১৭ তরুনের দলটি ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এ কে এম রফিকুল হক আসামের ইন্দ্রনগরে প্রশিক্ষণ শেষ করে মেজর মতিনের অধীনে ৩০ জনের একটি দলের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে প্রথম অপারেশনে অংশ নেন। তাঁরা সেদিন সিলেটের বড়লেখা চা-বাগানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলের ওপর আক্রমণ করে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন।
প্রশিক্ষণ শেষে এক সন্ধ্যায় অর্পিনগরে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মূল ক্যাম্প ভারতের জালালাবাদে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন জনাব সাদী (তৎকালীন এমপি)। রফিকুল হককে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন গণবাহিনীর (মুক্তিযোদ্ধা) একটি দলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দলটির কাজ ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে কাজ করার। রফিকুল হকের নেতৃত্বে জুন মাসে দলটি সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের একটি জায়গায় তাদের পুঁতে রাখে। মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ ধ্বংস হয়। ওই বিস্ফোরণে পাকিস্তানি এক ক্যাপ্টেন ও দুই সেনা নিহত হয়।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় মাদারীপুর নামক স্থানে অগ্রগামী দলটির ক্যাম্প ছিল। যুদ্ধজয়ের কৌশল হিসেবে পরে তা প্রত্যাহার করে ভারতের আমলসিদ (বিওপি) ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। পরে তিনি সিলেটের আটগ্রাম উপজেলায় ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সিলেটের কালীগঞ্জ বাজারে রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে ১৭টি রাইফেল ছিনিয়ে নেন তাঁরা। ২১ জুন সরিফপুর বাজারের পার্শ্ববর্তী রেলসেতু ও বরাক নদীর মাটির বাঁধের অংশবিশেষ বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করেন। এর ফলে সিলেটের সঙ্গে জকিগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২৯ জুন তাঁরা জকিগঞ্জের আটগ্রাম অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। দুজন জীবিত তাঁদের হাতে ধরা পড়ে।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি তিন নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। ডিসেম্বরের শুরুতে তাঁরা মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আখাউড়া আসেন। আখাউড়া যুদ্ধে জনাব রফিকুল হক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। কিন্তু যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় বসবাস করেন। তিনি সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে সম্প্রতি অবসরে গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শিরিন সুলতানা। তাঁদের এক ছেলে ইসতিয়াক বিন রফিক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছেন। এক মেয়ে জেবিন রাফিয়া শশী ফার্মাসিস্ট স্বামীসহ আমেরিকায় আছেন।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।