কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে মুহাম্মদ আইনউদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি। একাত্তরে তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতার পর যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। ১৯৯৬ সালে কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত হন। মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইনউদ্দিন তখন ময়মনসিংহে জিওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ও অবদানের জন্য তিনি বীর প্রতীকে ভূষিত হন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সুখ্যাতির কথা দেশের মুক্তিপাগল মানুষ সারা জীবন স্মরণ করবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। প্রথমে গঙ্গাসাগর সাবসেক্টরের অধিনায়ক, পরে ‘কে’ ফোর্সের অধীন নবগঠিত নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি অনেক যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশও নেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বনর্না শোনা যাক তাঁর কথায়, ‘মনতলা (ভারত) ক্যাম্প থেকে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি সোনামুড়া (ভারত) গেলাম। ২৩ নভেম্বর সেনামুড়ায় যে ভারতীয় সেনারা প্রতিরক্ষা নিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে আমি দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হই। বাংলাদেশের ভেতরে আরও দুটি দল (কোম্পানি) আগে থেকেই অবস্থান করছিল। আমাকে নির্ভয়পুর (ভারত) যেতে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুমিল্লা দখল করতে বলা হলো। সেখানে যাওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে আমাকে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তার মাঝে চিওড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে বললেন।
‘৩ ডিসেম্বর চিওড়া গেলাম। পৌঁছানোর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনো রকম প্রতিরোধ না করে পেছনের দিকে চলে গেল। তারা চিওড়া বাজারের উত্তর দিকে ডিফেন্স নিয়েছিল। ৫ ডিসেম্বর সকালে বালুতুফা (কুমিল্লা শহরের পূর্ব পাশে) গিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা বালুতুফায় যেখানে পৌঁছাই, সেখান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডিফেন্স ছিল কয়েক মাইল দূরে। সেখানে ছিল পাকা বাংকার। আমি ভাবলাম, পাকিস্তানি সেনারা পাকা বাংকারে ডিফেন্স নিয়ে আছে। অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।
‘এরপর পাকিস্তানি সেনাদের পেছন দিয়ে আমরা ৬ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করি। কুমিল্লা শহরের পূর্ব দিক দিয়ে ঢুকে পশ্চিম দিকে ৭ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে পৌঁছালাম। মুক্তিযোদ্ধাদের কনভয় যখন পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন শহরের হাজার হাজার জনতা আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসতে থাকে। আমি ভাবলাম, এ সময় যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করে, তবে ভিড়ের ভেতরে তা সুষ্ঠুভাবে প্রতিহত করা দুরূহ হয়ে পড়বে। এ কথা চিন্তা করে আমি কনভয়ের সামনে এসে জনতাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং সামনে না আসতে অনুরোধ করলাম।
‘ওই দিনই আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরে ভারতীয় হাইকমান্ড থেকে আমাদের জানানো হয়, সেনানিবাস আক্রমণ করতে হবে না। এ নির্দেশের পর আমি সেনানিবাস আক্রমণের পরিকল্পনা বন্ধ করি।
মুহাম্মদ আইনউদ্দিন পাকিস্তান নেসাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সাত দিন আগে থেকে বদলির কারণে ছুটিতে ছিলেন। তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। তিনি তখন কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসেই ছিলেন। ২৬ মার্চের পর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান এবং চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।
প্রতিরোধ যুদ্ধে মুহাম্মদ আইনউদ্দিনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অ্যান্ডারসন খাল সেতুসংলগ্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ২৯ মার্চ দুপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কনভয় খালের কাছে পৌঁছালে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে ২ নম্বর সেক্টরে সাবসেক্টর অধিনায়ক হিসেবে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘কে’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নব-সিন্দুর (আজমপুরের বিপরীতে) মনতলা (আখাউড়ার বিপরীতে) এবং কসবা এই তিনটি সাব সেক্টরের দায়িত্বে তিনি একাধিক সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১০ অক্টোবর তিনি নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। ৮ ডিসেম্বর কমান্ডিং অফিসার থাকা অবস্থায় কুমিল্লা শহর দখল করেন। কুমিল্লা শহর মুক্ত করতে ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ানের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন গেনানা। ১৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার আতিফ সেই আত্মসমর্পণের নেতৃত্বে ছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে মেজর জেনারেল আর ডি হীরা ও মুক্তবাহিনীর পক্ষে মেজর আইনউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়াও তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালাচরা চা বাগান দখল যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর তিন সদস্যকে জীবিত এবং দুই ট্রাক পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যের লাশ শহরে নিয়ে আসেন। আগস্ট মাসে তিনি গঙ্গাসাগর যুদ্ধ, আখাউড়া যুদ্ধ,কসবার যুদ্ধ ও আশুগঞ্জের যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রক্তাক্ত যুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল।
স্বাধীনতার পর তিনি নবম ইষ্ট বেঙ্গল নিয়ে ১৯৭২ সালে ৩ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে চলে যান। তখনও পাকিস্তানি বিহারিরা আত্মসমর্পণ করেনি। পরে তাদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন। ১৯৭২-র ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন পাকিস্তানি কারগার থেকে। ১৯৭৪ সালে তিনি লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে কর্নেল। ১৯৮১ সালে ব্রিগেডিয়ার এবং ১৯৯২ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত তিনি রংপুর সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। পরে সেনা সদর দপ্তরের পরিচালক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মুহাম্মদ আইনউদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগ তিনি অভিযুক্ত হন ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তাকে চাকরিচ্যুত (বরখাস্ত) করেন। তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। ১৯৯৯ সালে বরখাস্ত প্রত্যাহার করে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে তাঁকে চাকুরি থেকে তাঁর অবসরের তারিখ পরিবর্তন করে স্বাভাবিক অবসর দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালের পর তিনি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করতেন। তাছাড়া হাবিব ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও লিগেল অ্যাডভাইজার ছিলেন। বর্তমানে অবসর সময় কাটাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী নাজমা আক্তার চৌধুরী। মেয়ে আরিফা জেবিন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা, আজরা জেবিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত, আছমা জেবিন বিদেশে আছেন। একমাত্র ছেলে মো. ফখরউদ্দিন বিবিএ শেষ করে ব্যবসা করছেন।
মুহাম্মদ আইনউদ্দিন বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে করি দেশটা স্বাধীন না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা কী হতো? একাত্তরে অধিকাংশ মানুষ দেশে ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। কিন্তু যারা দেশে থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক কিংবা আপস নেই।
বর্তমানে তিনি ঢাকার মহাখালীর ডিওএইচএসে বসবাস করছেন। তাঁর বাবার নাম সুরুজ আলী , মা চান বানু।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।