স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমের স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে। একাত্তরে শহীদ সিরাজ এই কলেজের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। কলেজের মূল ফটকের সামনে শহীদ সিরাজের অনবদ্য ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন দেশের অন্যতম দুই কিশোর ভাস্কর্য শিল্পী সুশেণ আচার্য ও শ্যামল আচার্য।
২০০৯ সালে গুরুদয়াল সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ দীপক কুমার নাগ বলেন, অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর জানলাম এই কলেজের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম দেশের অন্যতম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও যুদ্ধজয়ের ঘটনাটি ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর প্রথম আলোতে পড়ে জানতে পারি। বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে শহীদ সিরাজ বীর বিক্রম উপাধি পান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য। সব জেনে কলেজের শিক্ষকবৃন্দের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিই, কলেজের তথা সারা জাতির গর্ব এমন একজন যোদ্ধার নামে কলেজ ক্যাম্পাসে স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করব। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কিশোর শিল্পী শ্যামল আচার্য ও সুশেণ আচার্যের সাথে যোগাযোগ করে ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছি। তবে মনে প্রশ্ন জাগে এ কাজটি এতদিন হলো না কেন?
যুদ্ধের শুরুতেই সিরাজুল ইসলাম সীমান্ত অতিক্রম করে আসামের ইকোয়ান ক্যাম্পে ৩২ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন রণাঙ্গণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের ৮ নভেম্বর অসম সাহসী যোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম পাক হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী দুর্গকে ভেঙে জয়ের আনন্দে যখন আত্মহারা তখনই পিছু হঠা হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন টগবগে এই যুবক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সুনামগঞ্জের সাচনা যুদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ যুদ্ধেই বীরত্বের সাথে শহীদ হয়েছিলেন তিনি।
৮ আগস্ট ১৯৭১। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মেজর বাট ময়মনসিংহের চৌকস ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অগ্রগামী দল (অ্যাডভান্সড পার্টি) গঠন করেন। এ দলের কমান্ডার নিযুক্ত হন সিরাজুল ইসলাম। অগ্রগামী দলের ওপর আদেশ হয়, ঢাকা-সিলেট নৌপথে তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ‘সাচনা বাজার’ শত্রু মুক্ত করার। ঢাকা-সিলেট সড়কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু সিরাজের দল উড়িয়ে দেয়ায় নদীপথে সাচনার মাধ্যমেই পাকবাহিনী সিলেটের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। এ অবস্থায় সিরাজের নেতৃত্বাধীন অগ্রগামী দলের ওপর সাচনা মুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের নেতৃত্বে দলটি দুটি ছিপ নৌকায় সাচনার ২৫ মাইল উত্তর দিক থেকে অভিযান শুরু করে।
শ্রাবণের মেঘে আচ্ছাদিত হালকা বৃষ্টির মধ্যে মেজর বাট, ক্যাপ্টেন বিজয় শর্মাসহ অন্যরা অনাড়ম্বরভাবে দলটিকে বিদায় জানান। অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল হালকা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। দীর্ঘ তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে দলটি সাচনার উপকণ্ঠে পৌঁছে আঁটসাঁট করে মাথায় গামছা বেঁধে কমান্ডার সিরাজের সাথে অন্যরা দীপ্তকণ্ঠে শপথবাক্য উচ্চারণ করেন, ‘মন্ত্রের সাধন, না হয় শরীর পতন।’ ঠিক এ সময় পাক বাহিনী দৈবাৎ ঘটনা আঁচ করে সচকিত হয়ে পড়ে। তারা সুরক্ষিত বাংকারে অবস্থান নেয় এবং অগ্রগামী দলের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিব্রত হলেও কমান্ডার সিরাজ পাল্টা আক্রমণের আদেশ দেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ।
পাকবাহিনী মেশিনগানের সাহায্যে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে চললেও সিরাজের বাহিনী সামনে এগিয়ে চললে পাক হানাদার ও অগ্রগামী দলের দূরত্ব দাঁড়ায় মাত্র ১০০ গজের মধ্যে। সিরাজ বার বার ‘আগাও’, ‘আগাও’ বলে চিৎকার করে তাঁর বাহিনীকে বিপুল বিক্রমে শত্রু শিবিরের আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেন। এক পর্যায়ে যুদ্ধকে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে নিয়ে আসেন। দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ পাক সেনা নিহত হয়। শত্রুর প্রতিরোধ ব্যূহ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লে তারা পালানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। ঠিক সেই মুহূর্তে যুদ্ধজয়ী সিরাজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ অবস্থান ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন এবং স্বাধীনতার স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় ঘটে যায় সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। পলায়নরত শত্রুর ‘কাভারিং ফায়ারের’ একটি বুলেট এসে লাগে সিরাজের চোখে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আহত সিরাজকে চিকিৎসার জন্য মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারে ভারত নেয়ার সময় পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর মরদেহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডের নিকটবর্তী টেকেরঘাটে অবতরণ করানো হয়। সেখানে সন্ধ্যায় খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মযাঁদায় দাফন করা হয়। তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিকে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়।
স্বাধীনতার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার বিশাল সমাবেশে সাচনার নামকরণ করা হয় ‘সিরাজনগর’। বঙ্গবন্ধু সরকার সিরাজকে অসামান্য বীরত্বের জন্য ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করেন।
মৃত্যুর মাত্র নয় দিন পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ সিরাজ তাঁর বাবার কাছে লিখেছিলেন সর্বশেষ চিঠি। সেই চিঠির প্রতিটি কথায় ফুটে উঠেছে দেশপ্রেমের অপূর্ব নির্দশন, রাজাকারদের ক্ষমা না করার আকুলতা। একাত্তরের চিঠি বইতে সিরাজের লেখা চিঠিটি স্থান পেয়েছে।
লেখক: সাইফুল হক মোল্লা দুলু, সাংবাদিক।