সংস্কৃতি ডেস্কঃ নভেম্বর ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলে ১০ লাখেরও বেশী মানুষ মারা গেল। কি বীভৎস আর ভয়ংকর সেই ধ্বংসযজ্ঞ। সেই ক্ষত শুকানোর আগেই ১৯৭১ সালের মার্চে সারা দেশে নিরীহ-নিরপরাধ বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। স্রেফ মাটি দরকার তাদের। তাই নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে ওরা রচনা করেছে সভ্যতার অন্যতম বীভৎস গণহত্যা। বিশ্বের মানুষ যার অল্পই জানতে পারছে। সেটাও জীবন বাজি রেখে সাইমন ড্রিং, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের মত কয়েকজন অকুতোভয় সাংবাদিকের তথ্য সংগ্রহ থেকে। ওদিকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখো বাঙ্গালী শরনার্থী অকল্পনীয় দুর্যোগে পার করছে প্রতিটি মুহুর্ত, কলেরাসহ প্রাণঘাতী সব রোগে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার নারী-শিশু-বৃদ্ধ।
সে সময়েই ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ইংল্যান্ডে ‘রাগা’ নামক এলবাম রেকর্ড করছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সেতার কিংবদন্তী পন্ডিত রবি শংকর। তিনি এন্থনি মাসক্যারেনহাসের ধারাবাহিক রিপোর্ট থেকে অসহায় দেশবাসীর নিদারুণ কষ্টের খবর নিয়মিতই পাচ্ছিলেন । মে মাসের এক রাতে খাবার খেতে খেতে সহশিল্পী ও বিটলসের আরেক কিংবদন্তি জর্জ হ্যারিসনকে তিনি বলে ফেলেন মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা দুঃখের কথা। ভারতে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের মধ্যে পন্ডিত রবিশংকরের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজনও ছিল। বড় কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক ছিল শরর্নার্থী বিশেষ করে শিশুদের না খেতে পেয়ে রোগে শোকে মরে যাওয়ার এই বাস্তবতা সহ্য করা।
সবকিছুই হ্যারিসনকে খুলে বলার পর তিনি রাজি হয়ে গেলেন। সামনে ব্যাডফিঙ্গার ব্যান্ড এবং জন লেননের ‘ইমাজিন’ অ্যালবামে বাজানোর ব্যস্ত শিডিউল তবুও হ্যারিসন রাজি হলেন কোন এক দূরদেশের অজস্র মানুষের অসম্ভব কষ্টের গল্প এবং বন্ধু রবিশংকরের হাহাকার সহ্য করতে না পেরে। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের সেই রূপকথার মত কিংবদন্তী কনসার্ট বাস্তবায়িত হয়েছিল স্রেফ এই দুই মহান শিল্পীর জন্য। সারা বিশ্বে তার পরিচয় বিখ্যাত রক ব্যান্ড বিটলসের লিড গিটারিষ্ট হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি কেবল তাই নন, সমাদৃত দুঃসময়ের এক অকৃত্রিম বন্ধু বলেই। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু, আমাদের বন্ধু জর্জ হ্যারিসন। একাত্তরে তার কণ্ঠে গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি আলোড়ন তুলেছিলো সারা বিশ্বে। সেই গান দারুণ ভূমিকা রেখেছিলো বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরিতে।
৬০ এর দশকে তরুণদের মাঝে দুনিয়াজোড়া যে বিদ্রোহ ও নানান অস্থিরতার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী বহ্ণিশিখা জ্বলে উঠেছিলো গানের দল হিসেবে বিটলস ছিল তারই প্রতিচ্ছবি। সংগীত দিয়ে পুরো একটা প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তারা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগনের উপর পাকিস্তানের নির্মম অত্যাচার বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য ও শরনার্থিদের জন্য অর্থযোগান দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক এর ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন এ অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্যা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
হ্যারিসন বাংলাদেশ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারতেন না ভালোভাবে। সেটা সম্ভবও ছিল না তার পক্ষে। উচ্চারনটা ব্যাংলাদেশ ব্যাংলাদেশ হয়ে যেত। কিন্তু সেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারনেই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস। গলায় অসামান্য মমতা ঢেলে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট গানটা গেয়েছিলেন তিনি। একটা অজানা অচেনা দেশের মানুষের জীবন বাঁচাবার জন্য। অকল্পনীয় আকুতি ছিল তার কণ্ঠে। শুধু গান দিয়েই না, বন্ধু রবিশংকরের সাথে হ্যারিসনের ঐকান্তিক চেষ্টায় নিউইয়র্ক এর বিখ্যাত মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সেই কনসার্টে যোগ দিয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, ক্লাউস ভুরম্যান, ড্রামার জিম কেল্টনার, গিটারিস্ট ডন প্রেস্টন, রিংগো স্টার, বিলি প্যাটারসন, ও লেওন রাসেলসহ তৎকালীন সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামক এই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন তারা কোন পারিশ্রমিক ছাড়া।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্ববরেণ্য শিল্পীরা একই মঞ্চে এক হয়েছিলেন নৃশংসতা আর বর্বরতার বিরুদ্ধে ঘৃণা আর প্রতিবাদ জানাবার জন্য লাখো মানুষকে বাঁচাতে মানবতার ডাকে। ৪০ হাজার দর্শকের সামনে একের পর এক অসামান্য গান তারা গেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য, মৃত্যুমুখে থাকা লাখো বাঙ্গালীর জন্য…। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, “প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে । পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন । আমাদের বাদন শুধুই সুর নয় এতে বাণী আছে । আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই । তবে বাংলাদেশে আজ যে তীব্র যন্ত্রণা বেদনা ও দুঃখের ঘটনা ঘটছে আমাদের সংগীত দিয়ে আমরা তা আপনাদের উপলব্ধি করাতে চাই । আমরা তাদের কথাও উপলব্ধি করাতে চাই যারা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছে।
ইউনিসেফের সহায়তায় আয়োজিত এ কনসার্টের মাধ্যমে ২০০০০ ডলার সংগ্রহের কথা ভেবেছিলেন হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের অসামান্য দুঃখগাঁথা শুনে এগিয়ে আসেন হাজারো দর্শক, আড়াই লাখ ডলার উঠেছিল এই কনসার্ট থেকে। যা অসামান্য অবদান রেখেছিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে…।
১৯৭১ সালে নিতান্তই অচেনা একটা দেশের মানুষের জন্য যে অসামান্য ভালোবাসা আর মমতা দেখিয়েছিলেন এই মহাপ্রান। সেই ভালোবাসার ঋণ কখনই শোধ করতে পারবো না আমরা, পারবে না বাংলাদেশ। জর্জ হ্যারিসন যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আপনাকে অতল শ্রদ্ধা…