অতি সম্প্রতি আমরা রাষ্ট্র হিসেবে উন্নয়নশীলদের কাতারে উত্তীর্ণ হয়েছি। নিঃসন্ধেহে এটি অমাদের জন্য অনন্য এক অর্জন। এই অর্জনকে স্বরণীয় করে রাখতে কয়েকদিনব্যাপী উৎসবে মেতেছিল সরকার ও দেশবাসি। কিন্তু অন্যদিকে যখন দেখি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত দেশের সাধারণ মানুষ তার সমস্ত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তখন বড় আশায় বাঁধা বুক ভেঙে যায়। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!
রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেব যতগুলো অধিকার মানুষের রয়েছে এরমধ্যে অন্যতম হলো চিকিৎসা। এই চিকিৎসা খাতেই এখন চলছে সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তাদের ইচ্ছেমতো যা-তা করে চলেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সারাদেশের সেবা সর্ম্পকিত ধারণা আমাদের সবারই আছে। সময়মতো ডাক্তার পাওয়া যায় না, ওষুধ পাওয়া যায় না, আবার ওষুধ পেলেও তা নিন্মমানের হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাওয়া যায় না। বড় বড় চিকিৎসকগণ বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালে বড় বড় সব মানুষদের সেবা দেন।
যে কারণে সাধারণ মানুষ একটু দ্রুত, একটু নিশ্চিন্ত সেবা পাওয়ার আশায় অনেকটা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দারস্ত হয়। সমস্যা হলো অনেক আশা-ভরসার সেই বেসরকারি হাসপাতালের নৈরাজ্যকর ভয়বহ চিত্র যখন আমাদের সামনে উম্মোচিত হয়, তখন আর আতঙ্কিত না হয়ে থাকা যায় না। গত কয়েক দিনের দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইনগুলোর দিকে একটু চোখ বোলালেই দেখা যাবে এসব চিত্র। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্করসব তথ্য।
গত ২৮ মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাব। মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘ক্রিসেন্ট হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স’ কর্তৃপক্ষকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একইসঙ্গে সেই হাসপাতালে আটজন কর্মচারীকে ৬ মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে হাসপাতালটি সিলগালা করে সেখানে থাকা ২২ জন রোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে পাশ্ববর্তী জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম এই দণ্ডাদেশ দেন।
আপতদৃষ্টিতে শাস্তিটা কম হলেও অপরাধটা কিন্তু গুরতর। জানা গেছে, ‘চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত চুন্নু বেপারীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছিল। পঙ্গু হাসপাতালের সামনে এক দালালের খপ্পড়ে পড়ে তার স্বজনরা চুন্নুকে নিয়ে যান কলেজগেট এলাকার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে প্রায় ১২ ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয় তাকে। এ সময় রক্তক্ষরণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। এর পর বুধবার সকালে তার অস্ত্রোপচার শুরু করে দুই ভুয়া চিকিৎসক।
পঙ্গু হাসপাতালে থাকা রোগীদের মধ্যে চুন্নুর অবস্থার অবনতি হলে গভীর রাতে তাকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এভাবে ভুয়া চিকিৎসকের হাতে পড়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রামের দিনমজুর চুন্নু।
ক্রিসেন্ট হাসপালের শিশু রোগী সামিয়ার মা সাহানা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দেড় বছর আগে সামিয়ার পায়ের সমস্যা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন পঙ্গু হাসপাতালে। ওই সময় সেখানকার এক দালাল শারমিনের পাল্লায় পড়ে তিনি মেয়েকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ডা. আসিফের অধীনে ভর্তি করান। তখন প্যাকেজে মোট সাড়ে তিন লাখ টাকায় ২১ দিনে মেয়েটির পা ভালো করে দেওয়ার কথা বলেন ওই ডাক্তার। কথামতো টাকা পরিশোধ করা হলেও দেড় বছরও সেই পা আর ভালো হয়নি, বরং বর্তমানে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বর্তমানে প্রতারকচক্রটি আবার মেয়ের পা ভালো করে দেওয়ার প্রলোভনে তার কাছে টাকা চাইছে। টাকা না দিলে সামিয়ার পা কেটে ফেলার ভয় দেখানো হয়েছে। ফলে শিশুটি বর্তমানে ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
ছয় বছরের শিশু সামিয়ার চোখে-মুখে আতঙ্ক। কখন না তার ছোট্ট পা-টি কেটে ফেলা হয়! ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকে পায়ের দিকে। আতঙ্কে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে জানতে চায়, ‘মা, ও মা, অরা আমার পা কাইট্টা ফালাইব!’ অবুঝ শিশুসন্তানের এমন কান্না সইতে পারছিলেন না মা সাহানারা বেগম। এতো গেল দ্বিতীয় শ্রেণির হাসপাতাল নামের এক কসাইখানার কথা। এখানেই শেষ নয়, দেশে উচ্চবিত্তদের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত রাজধানী ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোও নানা অনিয়মের মধ্যে দিয়ে নির্বিঘ্নে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। যখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিজান চালায় তখনই বেড়িয়ে নানা তথ্য।
চলতি মাসের ২১ তারিখ রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক ব্যবহারসহ একাধিক অপরাধে ইউনাইটেড হাসপাতালকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা কওে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানিয়েছেন, ল্যাবরেটরিতে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট পাওয়া গেছে। যে তাপমাত্রায় রাখা দরকার তা না রাখায় এসব রি-এজেন্ট বরফ হয়ে যায়। যত রি এজেন্ট ছিল তার প্রায় সবটাই মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া সার্জিক্যাল আইটেমের মধ্যে অস্ত্রোপচারের পর সেলাইয়ে যে সুতা ব্যবহার করা হয় তার বড় অংশও মেয়াদোত্তীর্ণ পাওয়া যায়।
বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে বেশ তোলপাড় হয়। অন্যসব হাসপাতালের চাইতে ইউনাইটেড হাসপাতালে যেখানে চিকিৎসা ব্যায় অত্যাধিক সেখানেও যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আর উপায় কী? কোথায় যাবে মানুষ। এসব থেকে বাদ যায়নি উচ্চবিত্তদের আরেক হাসপাতাল এ্যাপোলোও। তাদের বিরুদ্ধে ও রয়েছে অনুমোদনহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির অভিযোগ। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুমোদনহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির দায়ে রাজধানীর এই হাসপাতালকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা কওে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন- র্যাব এর ভ্রাম্যমাণ আদালত।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, কিছুদিন আগে তারা রাজধানীর নিকুঞ্জ থেকে দোলোয়ার হোসেন (২৯) এবং মঞ্জু (৪৫) নামের দু’জনকে বিপুল মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল, নিম্ন মানের এবং আমদানিনিষিদ্ধ বিদেশি ওষুধসহ আটক করেছিলেন। তারা মূলত এ্যাপোলো হাসপাতালে এসব ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করত। আটক দু’জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তারা অভিযান পরিচালনা করে ফার্মেসি থেকে তিন লাখ টাকার ওষুধ জব্দ করেন। পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। দু’জনকে আটক করার পর এ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের অনেক ওষুধ সরিয়ে ফেলে। কারণ তাদের ভেতরে তো ভয় ছিল।
এতো গেল সাম্প্রতিক সময়ের রাজধানীর স্বস্থ্যসেবার হালচাল। আমার যদি সারা দেশের দিকে তাকাই তাহলে আরো ভয়াবহ চিত্র সামনে আসবে। দৈনিক পত্রিকা কিংবা অনলাইন পত্রিকাগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায় সারাবাংলার সাধারণ মানুষেরা চিকিৎসাসেবা নিয়ে কী নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করছে। মফস্বল শহরের ছোট ছোট ক্লিনিকগুলো সরকারি হাসপাতাল থেকে সঠিক সেবার আশ্বাস দিয়ে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ডাক্তারের সহযোগিতায় মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে রোগী। খোদ রাজধানীতেই যখন প্রাণ রক্ষার নামে অবাদ বাণিজ্য চলছে তখন তা গ্রামগঞ্জে চলা তো আর অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু আমরা সাধারণেরা চাই এসব বন্ধ হোক চিরতরে। আমরা আর দেখতে চাই না সামিয়ার মতো শিশুদের আতঙ্কভরা মুখ, অসহায় মায়ের কান্না। আমরা চাই দিনমজুর চুন্নুদের মতো অতি সাধারণ মানুষদের নিয়ে প্রাণ রক্ষার বণিজ্য বন্ধ হোক।
ফয়সাল আহমেদ : লেখক, সাংবাদিক।