মানুষ- সমাজ

সিস্টেম লসের ছেচল্লিশটি কালো গোলাপ ।। আফজল হোসেন আজম

নরসুন্দা ডটকম   আগস্ট ১২, ২০২০
গোলাপ

১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস। শোকে মুহ্যমান জাতির ছেচল্লিশ বছর অতিক্রান্ত। দূর্ভাগ্য জাতির। কতিপয় বিপদগামী কুলাঙ্গার ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে। পলাশীর আম্রকাননে যে সূর্য আমরা হেলায় হারিয়ে ছিলাম তার উদয় দেখতে লাগলো দু’শো বছর। আর সেই সৃর্যোদয়ের ঊষালগ্ন মাত্র চার বছরে গোধূলির অনামিশায় ডুবে গেল।

১৯৭১ এ দ্য ডেইলী টাইমস এর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলো স্বাধীনতার দাম যদি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করা হয় তবে বাঙ্গালীদের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কেউ স্বাধীনতা কিনতে পারেনি। একসাগর রক্তের আলপঁনা আঁকা মানচিত্র বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। আবার সেই আলপঁনাতে মিশে গেল জনক হত্যার রক্ত। বড় বিচিত্র ব-দ্বীপ। দ্বি-জাতিত্বত্ত ও দ্বি-ধর্মের উপাত্ত দিয়ে এই মানচিত্রটাকে খন্ডিত করা হয়েছে বার বার। ধর্মের আফিম আর বেজেতের কচু খাওয়ানো হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। তেঁতুল খুঁজেনি কেহ। একটি মানুষেই জন্মেছিল এদেশে। যিনি চুয়াল্লিশ বছর জাতীয়তাবাদের আদর্শিক ডাক দিয়ে স্বাধীন একটি দেশ দিয়ে গেছেন। অথচঃ আতুঁরঘরে মেরে ফেলা হয়েছে মহান মূলনীতির সংবিধান, স্বাধীনতা, পতাকা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এর মূর্ত প্রতীককে। মাঝিবিহীন নৌকার প্রায় অর্ধশতাব্দী। আজ ভাববার সময় এসেছে। স্বাধীনতা আর মানবিক রাষ্টের অর্থ খোঁজার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মানেই বাংলাদেশকে হত্যা।বাংলাদেশকে হত্যার ছেচল্লিশ বছর। স্বাধীনতার স্বাদ কী পেলো এ জাতি আর কী হারালো। ছেচল্লিশটি কালো গোলাপ ছাড়া আর কিছু আসলেই পেলো সতের কোটি বাঙ্গালি?

প্রাচীন গ্রীকের ম্যানিয়াল সাম্রাজ্য তলিয়ে আছে ভূ-মধ্য সাগরে। বাঙ্গালি জাতিস্বত্তা তলিয়ে যেতে কতোক্ষন লাগবে। ইতিহাসের পাতা আর পর্যটকদের পদচিহ্ন ছাড়া ম্যানিয়াল সভ্যতা বা সাম্রাজ্যে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপ আমেরিকা ডিউক প্রথা নিয়ে যে রেঁনেসার জন্ম দিলো তা আধুনিক ভারতবর্ষে তথা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতে দেখছি না। সামন্ত রাজারা পুঁজিবাদ শোষন দূর্নীতি ধর্মবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের পিছে ছুটছে তো ছুটছেই।  জনগনের দেশ হলো না কোনটাই। পেন্সিলে স্কেচ করা মানচিত্র হলো মানবিক ইরেজার দিয়ে মুচা হলো না জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা লুন্ঠন শোষন। যে মহান আদর্শকে বুকে নিয়ে তিরিশলক্ষ মানুষ জীবন দিলো তার প্রতিফলন নেই। সবাই যার যার অবস্থানে স্বঘোষিত ডিউক। আইনসভার ভিতরে পুঁজিবাদ,সিভিল প্রশাসনের লালফিতা কালো টাকার কাছে বন্দী, মিউনিসিপাল ও বিভিন্ন স্থরের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো দূর্নীতির বরপুত্র। শিক্ষা ও চিকিৎসায় অবাধ বানিজ্যনীতি। টিকাদারভিত্তিক কমিশনের প্রমোশন নামকাওয়াস্ত উন্নয়ন। মেধারবিকাশ ব্যাংক একাউন্টে জব্দ। টাকা ছাড়া চাকুরি নাই, তৈলমর্দন ছাড়া প্রমোশন নাই। স্বাধীন মানচিত্র শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীবিভাজনের অযুত নিযুতের অংকে শুভংকরের ফাঁকিতে পড়েছে। প্রকাশ্যে জাতি দু’ধারা ত্রি-ধারাতে বিভক্ত।

এমনি কথা ছিলো না, হবার ছিলো না। ৭১ এ এদেশে এলিট পরিবার ছিলো ২২ টি। ২০০৯ পর্যন্ত তা দাঁড়ালো ২৩ হাজার। ২০২০শে দাঁড়ালো ৫৭ হাজার। এদের কোষাগারে ৮০% রাজকোষ। বাকি সাড়ে ষোল কোটি মানুষের হাতে ২০% সম্পদ। বড় বিচিত্র এদেশ। পরিসংখ্যানের মাথা আর শোষকের ছাতার তলে রক্তমাখা মানচিত্র। এই যদি হয় স্বাধীনতার মানে তবে সব পুঁজিপতিদের খাদ্যমেন্যুতে রক্ত রাখলে মন্দ কি? পশুদের খাদ্য হিসেবে রক্ত আর মাংসোই প্রিয়। ৭৫ এ মৌলিক জাতীয়তাবাদ হারালো যে জাতি সে জাতি সিস্টেম লসের জাতি। এখানে অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে ডাকা আর পুঁজিবাদের সাপলুডু খেলা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। কৃষক, শ্রমিক,জনতা এদেশের উৎপাদক মালিক নন। মালিকানাস্বত্ত চেয়েছিলেন একটি মানুষেই। তিনি ইতিহাসের রাখালরাজা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী পিতা মুজিব।

তিনি জানতেন, যে জাতির রক্তে কাল কালান্তরে মীরজাফরের উত্তরসূরিরা আছে সে জাতিকে মুক্তি দিতে হলে ঘর থেকেই চোরের খনি সরাতে হবে। আর রাষ্ট্রকে তুলে দিতে হবে রাষ্ট্রের মালিকদের হাতে। তাইতো কৃষক,শ্রমিক, জনতার বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তিনি।

যা বলছিলাম সিস্টেম লসের এ ব-দ্বীপে তাই আজো সাধারণ জনগন রাষ্ট্রের মালিক হতে পারেনি। প্রবৃদ্ধি যেখানে এগারো বারো পার্সেন্ট মাথাপিছু গড় আয় বার্ষিক একলক্ষ পঁছাত্তর হাজার টাকা সেখানে আপনার আমার টাকা কই গেলো? সবই সিস্টেমের খেলা। এ খেলাই বন্ধ করতে মাঠে নেমেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন- ‘আমি নামবো গ্রামে গ্রামে। এদেশে সুদখোর ঘুঁষখোর মুনাফাখোর কালোবাজারিরা থাকতে পারবে না। আমি দেখবো চোরের শক্তি বেশি নাকি ঈমানদারের শক্তি বেশি।’

তাই কাল হলো। জীবন দিলেন স্বপরিবারে। আর এভাবেই আজ পর্যন্ত ছেচল্লিশ বছর সারেংবিহীন নৌকার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ কালো গোলাপের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর পর। আমাদিগকে তবু আশাহত হলে চলবে না। শহীদের রক্তেভেজা এ মাটি একদিন সোনার বাংলা হবেই। কোনো একদিন তা সফল হবেই। আর তা হলেই সতেরকোটি মানুষের বাংলা হবে নিজেদের। বুক ফুলিয়ে বলবে আগামী প্রজন্ম আমি বাঙ্গালি, এদেশ আমার। আমি মানুষ। এ পৃথিবী সমগ্র মানবজাতির।


আরও পড়তে পারেন….

আলিফ আলম এর রেসিপি
সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হবে ।। তাহ্ নিয়া কাদের

About the author

নরসুন্দা ডটকম