মানুষ- সমাজ

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামে-আন্দোলনে বিশ্বস্ত : মেহের আফরোজ চুমকি

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮

১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটি আমার পরিবারের জন্য একটি শোকাবহ ও বেদনাদায়ক দিন। সেদিনটি ছিল আমার বলা যায় সর্বস্ব হারানোর দিন। সেদিনে আমার বাবাকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তিনি এই কালীগঞ্জের মানুষ ছিলেন। এই মাটিকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। এই মাটির মানুষকে ভালোবাসতেন। এখানকার মানুষের ভালো কিছুর জন্য নিরন্তর ভাবতেন তিনি। কিন্তু এই মাটিতেই ঘাতকের নির্মমতায় ঝরে যায় তার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু।

আমি তখন চট্টগ্রামে। আমার স্বামীর সঙ্গে। রাতেও আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। রাতটা ছিল বিনিদ্র। পরিবেশটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল আমার চোখের সামনে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে চলছিল দেশব্যাপী হরতাল। সকালে নাশতার সময় একটা ফোন এলো আমার স্বামীর ফোনে। তিনি অফিসে গেলেন। ভাবলাম, অফিসের ফোন পেয়েই বুঝি তার বাইরে যাওয়া। কিছু সময় পরেই ফিরলেন। টেবিলে বসলেন। টেবিলে নাশতা সাজানো। নাশতা না খেয়ে উঠে বাথরুমে গেলেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। উঠে তার পেছনে পেছনে বাথরুমের কাছাকাছি গেলাম। ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনছিলাম। বড় কোনো অঘটনের আশঙ্কায় মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল।

আমি জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? তিনি কান্নাচাপা কণ্ঠে বললেন, বাবার শরীর ভালো না।

আমি এই কয়েকটি কথার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই বুঝে যাই। আর কিছু বলতে পারি না। হরতাল চলছে। গাড়িঘোড়া তেমন চলছে না। তাই অনেক কষ্টে রাতের ট্রেনে ঢাকায় আসি। কমলাপুর রেলস্টেশনে বাবার এক বন্ধু আমাদের নিতে এসেছিলেন। এখান থেকেই শেষবার আমাকে বিদায় দিয়েছিলেন।

৭ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী লেন। এখানে বাবার প্রাণহীন দেহটা রাখা। আমি ওই সময় কেবল মাকে দেখতে চাইছিলাম। মা কোথায়? ভাইবোন কোথায়? দোতলায় সবাই কাঁদছে। আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। আমাদের সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সেদিনের অমন পরিবেশে যেন আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।

বলা হয়, কারও মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে মানুষ শোক ভুলে যায়। কিন্তু আমরা ৪০ দিনেও ভুলতে পারলাম না। সবাই আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করছে। আমাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়িটা কেমন নীরব হয়ে যাচ্ছে। আমি অনুভব করি, আমাদের জীবনের কী বিরাট বটবৃক্ষ আমরা হারিয়েছি। এই নির্মল ছায়া আর কোনোদিন পাব না। কী করব ভাবতে পারছিলাম না। এই ঘটনায় ছোট ভাইবোনরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। সেই কঠিন সময়ে মা আমাদের আগলে রেখে নতুন করে বাড়িতে পরিবেশ সৃষ্টি করলেন। নিজের সব দুঃখ চাপা দিয়ে আমাদের স্বাভাবিক করে তুললেন।

বাবাকে হারানোর আজ ৩৪ বছর পার হলো। আজ চার বছর হলো মা-ও এই পৃথিবী ছেড়ে আমাদের এতিম করে চলে গেছেন। বাবার মৃত্যুর পর আমার মা খুব শক্তভাবে সংসারের হাল ধরলেন। বাবার আদর্শে আমাদের ছয় ভাইবোনকে গড়তে লাগলেন। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল। মামলা চলছিল। কঠিন সময় তখন। বাবা তেমন অর্থকড়িও রেখে যাননি যে, তা দিয়ে আমরা কিছু একটা করতে পারি। জায়গা-জমি বিক্রি করে সংসার চালানো, মামলা পরিচালনা করছেন মা। একদিন মামলার রায় হলো। ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। ফাঁসি হওয়ার কথা। কিন্তু হলো না। এতে ক্ষুব্ধ হলো জনসাধারণ। স্বৈরাচারী এরশাদের সাধারণ ক্ষমায় খুনিরা ছাড়া পেয়ে গেল।

আমার বাবার যে এত পরিচিতি, তা বেঁচে থাকতে আমরা বুঝতেই পারিনি। আমাদের সেই ধারণাও ছিল না। আমরা বাবার পরিচয়ে কখনও কিছু চাইনি। প্রয়োজনও পড়েনি। আমরা আমাদের মতো বেড়ে উঠতে চেয়েছি।

আমার দাদি তখন প্রচণ্ড অসুস্থ। রক্তের প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু আমরা কোথায় রক্ত পাব? কেউ একজন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে যেতে বলল। আমরা জানি না, কীভাবে রক্ত সংগ্রহ করতে হয়। আর আমাদের কেনই-বা তারা রক্ত দেবে? কিন্তু তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বললাম, তারা আমাকে রক্ত দেবে?

কর্তব্যরত ডাক্তার আমায় রীতিমতো ধমক দিলেন। বললেন, কেন দেবে না? আপনার বাবা কী ছিলেন আপনারা জানেন না? তিনি রেড ক্রিসেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তাকে মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। রেড ক্রিসেন্টের মানুষও তাকে সমীহ করতেন। সত্যিই রেড ক্রিসেন্ট অফিসে গিয়ে তাই দেখলাম।

১৯৯৬ সাল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। জাতির পিতার কন্যা কখনও ভুলে যাননি, দুঃসময়ে কারা তার পাশে ছিলেন। তাদের মধ্যে আমার বাবা ময়েজউদ্দিন অন্যতম, তিনি এটা জানতেন। এ কারণে তিনি আমার মাকে পার্লামেন্টে এমপি হওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু আমার মা তার কথা রাখতে পারেননি। তিনি সবিনয়ে জানিয়েছেন, এই বয়সে এতবড় গুরুদায়িত্ব পালন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। দায়িত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে কাজ করতে হবে। মায়ের এই অপারগতার কারণে আমাকে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে ‘৯৬ সালে বসার সুযোগ করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি মনে করি, বাবার যে দেশপ্রেম ছিল তারই পুরস্কার আমি পেয়েছি। সেই ‘৯৬ থেকে ২০১৮- রাজনীতির মাঠে দীর্ঘ ২২টি বছর পার করলাম। কখনও পিছু হটিনি। সময়ে-দুঃসময়ে দলের সঙ্গে থেকেছি। ‘৯৬ সালে সংরক্ষিত আসনে এমপি। ২০০৮ সালে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ। সেখানেও আমি এমপি নির্বাচিত হলাম। ২০১৩ সালে আবার নির্বাচনে জেতা। সর্বোপরি আজ কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রী আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে সংযুক্ত হলেই বাবার কথা মনে হয়। মনে হয় তিনি যেন দূর থেকে আমার এসব কাজের সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন। উৎসাহ প্রদান করছেন। নির্বাচনের মাঠেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। কালীগঞ্জবাসী আমার বাবাকে ভোলেননি। তাই বাবার মৃত্যুর ২৪ বছর পর আমাকে বাবার কথা মনে করে ফিরিয়ে দেননি।

মাঝেমধ্যে কঠিন সময় আসে। মনে হয় কিছুই যেন পারব না। তখন বাবারই আপন কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পৃথিবী থেকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে কাউকে সরিয়ে দিলে তারই পরিবারের কাউকে না কাউকে আল্লাহ মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেন। যেমন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো একে একে করে যাচ্ছেন।

আমার বাবা বলতেন, গাজীপুর-নরসিংদী পাশাপাশি হলেও যোগাযোগে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। নৌকা ছাড়া যাতায়াত করা যায় না। এখানে যদি একটা ব্রিজ করা যায়, তাহলে এতদঞ্চলের মানুষ ভোগান্তির হাত থেকে বেঁচে যায়। আমার সৌভাগ্য, ১৯৯৬ সালে এমপি হয়ে বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি। এখন শহীদ ময়েজউদ্দিন সেতু হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ চলাচল করে। বাবা কালীগঞ্জকে সুন্দরভাবে সাজাতে চাইতেন। দুস্থ নারীদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার কথা ভাবতেন। মাতৃমৃত্যু রোধে কালীগঞ্জে তিনটি মাতৃসদন স্থাপন করেছেন তিনি। বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী করতে চারতলা প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণ করেছেন। শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি নারী শিক্ষা নিয়ে ভাবতেন। পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে ভাবতেন। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু কীভাবে কমানো যায়, এ নিয়েও তার বিস্তর চিন্তা ছিল।

আমার আরও সৌভাগ্য যে, আমার বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো আমার সময়ে এসে সম্পন্ন করতে পারছি। ছয়তলা ট্রেনিং সেন্টার করেছি। সেখানে মেয়েরা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বাবার মৃত্যুর ৩৪ বছর পর এই ট্রেনিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এ কথা ভেবে আমাকে বারবার আপ্লুত করে যে, বাবার একান্ত ইচ্ছাগুলো আমার মাধ্যম দিয়ে পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন, এখান থেকে পিছিয়ে পড়া নারী, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে কাজ করতে পারি। এসব মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। অন্তত ভালো কিছু করার চেষ্টা তো করতে পারছি।

বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে সারাজীবন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার পরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়েও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। ‘৭৫-পরবর্তী সময়ে আমাদের ৭ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী লেনের বাসায় গোপনে বৈঠক করেছেন। তৎকালীন ছাত্রলীগকে সহযোগিতা দিয়েছেন। আমি আবার বলব, বিশ্বস্ততার পুরস্কার মানুষ একসময় না একসময় নিশ্চয় পায়। তাই প্রত্যেকের উচিত, যেখানে আছে, সেখান থেকে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হবে। সর্বশেষ মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে থেকে যেন ভালো কিছু কাজ করে যেতে পারি।

মেহের আফরোজ চুমকি

প্রতিমন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংসদ সদস্য। সূত্র: সমকাল।

About the author

নরসুন্দা ডটকম