মানুষ- সমাজ

ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য মানুষ কেন ত্রাণ পায় না?

নরসুন্দা ডটকম   মে ২০, ২০২০
মানুষ

এম জে এইচ বাতেন : প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবী আজ স্তব্ধ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো আজ পরাজিত এই অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে। বর্তমানে গোটা বিশ্ব ভয়াবহ সময় পার করছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।

সারাদেশে করোনা দুর্যোগে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনকে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যাক্তি উদ্যোগে ও হতদরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে চলছে ত্রাণ বিতরণ কিন্তু এরই মধ্যে ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ আসছে।

প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরও অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খালা বাহিনীর হাতে ত্রাণ লুটপাটকারীরা হাতে নাতে ধরা পরার খবর এসেছে বিভিন্ন মিডিয়াতে। এর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। যে সময়ে মানুষ হাহাকার করছে ত্রাণের জন্য, চোখে দেখছে অন্ধকার সেই ক্রান্তিকালেও ত্রাণ নিয়ে হচ্ছে অনিয়ম।

গ্রেপ্তার, বরখাস্ত, জেল-জরিমানার পরও থেমে নেই অনিয়ম। দুর্যোগে যেখানে মানবিকতা জেগে ওঠার কথা সেখানে উল্টো চিত্র কিছু মানুষ হয়েছেন সুযোগসন্ধানী। শুধু করোনা দুর্যোগে নয়, সব সময় ত্রাণ বিতরণে দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে শুনা যায় প্রচুর অভিযোগ। কেউ কেউ অভিযোগ করছে, গরিব অসহায় যারা সরকারি ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য তারা অনেকেই ত্রাণ পাচ্ছে না অথচ যারা ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য নয় তারা পাচ্ছে।

চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করে কেউ কোন সময় ত্রাণ বন্টন করে না। এবার আসা যাক কেন ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য মানুষজন ত্রাণ পায় না। সরকারি ত্রাণ সাধারণত সরকারি আমলা ও জনপ্রতিনিধিরা মিলে বিতরণ করে থাকে। তাহলে কি জনপ্রতিনিধি আর আমলারা মিলে সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎ করে? আসলে তা নয়,  আত্মসাৎকারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।

কয়েকজন ন্যাক্কারজনক কাজ করে আর সকলেই দুর্নামের ভাগী হন। তাহলে ত্রাণ গুলো যায় কোথায়? কেন ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য লোকেরা ত্রাণ পায় না? এর কারণ হচ্ছে- আত্মীয়করণ, স্থানীয়করণ, দলীয়করণ, দুর্নীতি, বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য। ইউনিয়ন পরিষদের প্রতি ওর্য়াডে যে পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্দ থাকে সেই তুলনায় হত দরিদ্রের সংখ্যা ৩ গুণ বেশী, তবে সব এলাকায় নয়। যার কারণে ওর্য়াডের নির্বাচিত ইউপি সদস্য ত্রাণ বিতরণ করতে হিমশিম খায়।

ত্রাণ বন্টনের আগে ইউপি সদস্য গরিবদের তালিকা নির্বাচনে যেসব বিষয় বিবেচনা করে তা হচ্ছে-প্রথমেই তার নিজস্ব লোকজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, তাকে যারা ভোট দিয়েছিল, ইউপি সদস্য রাজনৈতিক যে দল করে, সেই ধরনের লোকজনদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায় ওর্য়াডে যে গ্রামে ইউপি সদস্যের বাড়ি সেই গ্রামেই শুধু ত্রাণ দেওয়ার জন্য লোকজন নির্বাচন করা হয়।

ওর্য়াডের অন্য গ্রামের গরিব মানুষজন সবাই বাদ পড়ে যায়। এতে ত্রাণ না পাওয়া গ্রামের মানুষজন মনে করে মেম্বার সকল ত্রাণ আত্মসাৎ করেছে। আসলে কোন স্থানেই প্রকৃত অসহায়দের সঠিক তালিকা করে ত্রাণ দেওয়া হয় না। অনেক চেয়ারম্যান রয়েছে যারা জবাবদিহিতা ছাড়া দায়সারাভাবে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ত্রাণ বন্টনের আগে চেয়ারম্যান প্রতি ইউপি সদস্য কতজনকে ত্রাণ দিতে পারবেন তার এটি পরিসংখ্যান দিয়ে দেন। ইউপি সদস্য কাকে ত্রাণ দিল সে কি ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য না অযোগ্য তা বেশীর ভাগ চেয়ারম্যান কোন খবর রাখে না এমকি কোনদিন মনিটরিংও করে না।

যে ত্রাণ কার্ড নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আসে, সে যেই হোক তাকেই ত্রাণ দেওয়া হয়। এখানে আরো জবাবদিহিতার প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যাণ ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। সেই হিসাবে দেশে এখন গরিব মানুষ আছে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ। এরই মধ্যে আবার করোনা সঙ্কট যোগ হয়ে ত্রাণ পাওয়ার মানুষজনদের পাল্লা হচ্ছে ভারী।

এছাড়াও ধনী ও দরিদ্র জেলার বরাদ্দের বৈষম্যের কারণে যোগ্য মানুষজন ত্রাণ পাচ্ছে না। এবার বাংলাদেশে ধনী ও দরিদ্র জেলার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো- সবচেয়ে ধনী তিনটি জেলার নাম নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুর। ২০১৪ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ তিনটি জেলার জনসংখ্যা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জে প্রায় সাড়ে ২৯ লাখ, মুন্সিগঞ্জে প্রায় ১৫ লাখ এবং মাদারীপুরে ১২ লাখ ১২ হাজার। এ তিনটি জেলার গড় দারিদ্র্য নারায়ণগঞ্জে ২ দশমিক ৬ শতাংশ, মুন্সিগঞ্জে ৩ দশমিক ১ শতাংশ এবং মাদারীপুরে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তিনটি জেলার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে গরিব মানুষের সংখ্যা ৭৬ হাজার ৭০০, মুন্সিগঞ্জে ৪৬ হাজার ৫০০ এবং মাদারীপুরে ৪৪ হাজার ৮০০।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব তিনটি জেলার দারিদ্র্যের হার হচ্ছে কুড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮, দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ এবং বান্দরবান জেলায় ৪০ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১১ সালের আদমশুমারি এবং ২০১৬ সালের দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে গরিব তিনটি জেলার অবস্থা জেনে নেওয়া যাক। কুড়িগ্রামে মোট ২০ লাখ ৬৯ হাজার মানুষের মধ্যে গরিব ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫২; দিনাজপুরে ৩১ লাখ ৯ হাজার মানুষের মধ্যে গরিব প্রায় ২০ লাখ এবং বান্দরবানে প্রায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার মানুষের মধ্যে গরিব ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৮। গত সাড়ে তিন বছরে এই পরিসংখ্যান কিছুটা বদলালেও অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়।

বৈষম্য দূরীকরণে কোনো পদক্ষেপ কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। বরং বৈষম্য বৃদ্ধি সব সময় থেকেই যাচ্ছে। তা না হলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শুধু গোপালগঞ্জের মাত্র ১২ লাখ মানুষের জন্য মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশ আর রংপুর বিভাগের ২ কোটি মানুষের জন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ হওয়ার কথা নয়। এই থেকে সহজেই বুঝা যায়, ত্রাণ বণ্টনে কতটুকু আর্থিক বৈষম্য করা হয়েছে।

তদরুপ ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল গ্রামের মানুষজন সমান ধনী নয়। সকল অসহায় মানুষ ত্রাণ কার্ড পায় কি না তাহা ইউনিয়নের অভিবাবক চেয়ারম্যান দেখবাল করে নিশ্চিত করার প্রয়োজন।সবসময় দেখা যায় দুর্যোগের সময় তরিগরি করে গরিব দু:খী মানুষের তালিকা করা হয়। এতে প্রকৃত গরিব বাদ পরে যায়।

প্রকৃত গরিবদের তালিকা করতে হলে পূর্ব থেকেই সঠিক পরিসংখ্যান করে রাখতে হবে এবং পরিসংখ্যান মতে বরাদ্দ দিতে হবে। সরকারের উচিৎ সমাজে পিছিয়ে পড়া, সুবিধা বঞ্চিত, হত দরিদ্র অসহায় মানুষজনদের সঠিক তালিকা করে তাদের জীবনের মান উন্নয়ন করা।তা না হলে গরিব গরিবেই থেকে যাবে। অনিয়ম দুর করা যাবে না। যার ফলে জনজীবনে নেমে আসতে পারে চরম দুর্ভোগ।

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।


আরও পড়তে পারেন….
আমার দু’আনার নাট্যজীবন ও বালুরঘাটের নাট্যচর্চা : তুহিন শুভ্র মন্ডল
আমাদের গ্রামে যদি রাক্ষস না থাকত ।। সৌরভ চক্রবর্তী

About the author

নরসুন্দা ডটকম