লুৎফর রহমান রিটন >>
তখন ক্যাসেটের যুগ। প্রণব ঘোষ তখন সুপারহিট সুরকার। তাঁর সঙ্গীতায়োজনে পর পর বেশ কয়েকটা ক্যাসেট সুপার ডুপার হিট হয়ে গেলো। তিনি চলে এলেন নাম্বার ওয়ান পজিশনে। কিছুকাল পরে বিশেষ করে ডলি সায়ন্তনী নামের মাঝারি মানের এক শিল্পী প্রণবের ডিরেকশনে ‘কোন বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই’ গেয়ে বাজার মাত করে ফেললো। মিল্টন খোন্দকারের কথা-সুর ও সঙ্গীতায়োজনে ‘হে যুবক’ নামের প্রথম ক্যাসেটেই (রঙ চটা জিন্সের প্যান্ট পরা) ডলির উত্থান যদিও, কিন্তু প্রণব ঘোষের সঙ্গীতায়োজনে বেরুনো ‘কোন বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই’-এর মাধ্যমে ডলি পেয়েছিলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা। অবশ্য নিতাইগঞ্জের গানটি আমি প্রথম শুনেছিলাম কাঙালিনী সুফিয়ার কণ্ঠে।
আমি তখন দিনের সিংহভাগ সময় বিটিভি ভবনে কাটাই। ছোটদের অনুষ্ঠান গ্রন্থনা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, নাটক রচনা ও পরিচালনা এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে স্কিড বা নাট্যাংশ এবং গান লিখে জীবিকা নির্বাহ করি। সময়কাল নব্বুই-এর দশক।
সেই সময়কার ঘটনা।
সুরকার প্রণব ঘোষের সঙ্গে তখনো সামনা সামনি আলাপ হয়নি আমার। এক সকালে আমার রঙিন টেলিফোন সেটটি চমৎকার রিংটোনে বেজে উঠলো। অপর প্রান্ত থেকে ‘আমি প্রণব ঘোষ বলছি’ শোনার পর খানিকটা অবাক এবং আনন্দিত হলাম। তিনি বললেন, আপনার লেখা দু’য়েকটা গান আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি ঠিক করেছি আপনার লেখা গান আমি কম্পোজ করবো। আপনি কুড়ি পঁচিশটা গান আমার কাছে নিয়ে আসুন।
আমি তো আকাশ থেকে পড়ি–কুড়ি পঁচিশটা গান!
–হ্যাঁ। ওখান থেকে আমি বেছে নেবো দু’তিনটা।
আমি বললাম, কিন্তু আমি তো এতো গান লিখি না একসঙ্গে! একটা দু’টো লিখি অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে। এতো গান তো আমার নেই দাদা!
–তাহলে চার-পাঁচটা নিয়ে আসুন। শুধু মুখটা হলেই চলবে। মুখ দেখলেই আমি বুঝতে পারবো চলবে কী না।
–কী রকম?
–এই যেমন ধরেন, মেরা জুতা হ্যায় জাপানি মেরা কাপড়া হিন্দুস্তানি টাইপের। প্রথম লাইনটা পড়লেই বোঝা যায় গানটা বাজার পাবে কি পাবে না। গানটা মানুষ খাবে কি খাবে না।
প্রণব ঘোষকে নিরাশ করে খুব নির্লিপ্ত কণ্ঠে আমি বললাম,–কিন্তু দাদা আমি তো এরকম পরীক্ষা দিয়ে গান লিখি না। লিখবোও না। আমি তো গীতিকার হতেই চাই না।
–কেনো? গীতিকার হতে চান না মানে?
–গীতিকারদের কোনো দাম নেই আমাদের সোসাইটিতে। একটা গান গীতিকার লেখেন ঠিকই কিন্তু তাকে কেউ পোছে না। গীতিকার গানটা যখন লেখেন তখন সেটা থাকে গীতিকারের। এরপর সুরকার যখন সুর করেন গানটা তখন সুরকারের হয়ে যায়। তৃতীয় ধাপে শিল্পীর কণ্ঠে সেই গানটা উঠে যাবার পর গানটা হয়ে যায় শিল্পীর। বেচারা গীতিকার তখন অনাদরে অবহেলায় স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকেন আর তাকে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রেখেই তার লেখা গানের ট্রেনটা হুঁইশেল বাজিয়ে চলে যায় দূরের গন্তব্যে। গীতিকারের কথা কেউ মনেও রাখে না। আমি তাই গান লিখতেই আগ্রহী হই না। একটা গান লেখার পেছনে যে মেধা আর শ্রম দিতে হয় সেই একই মেধা আর শ্রম দিয়ে আমি বরং লিখে ফেলি একটা ছড়া। এবং ছড়াটার মালিকানা চিরকালের জন্যে আমারই থেকে যায়। একজন গীতিকারের সেটা থাকে না।
আমার দীর্ঘ বয়ানে খুব অবাক এবং খানিকটা বিরক্ত হলেন প্রণব ঘোষ। বললেন, কিন্তু গীতিকার হিশেবে আমি তো আপনার নামই দেবো।
প্রণব ঘোষ যাতে অপমানিত বোধ না করেন সে কারণে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম আমি–আপনার মতো একজন প্রখ্যাত সুরকার আমার মতো নগন্য এক ছড়াকারকে যে ফোন করেছেন সেজন্যে আমি ভীষণ গৌরব বোধ করছি দাদা। খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। আমি সম্মানিত। আমাকে অহংকারী বা উন্নাসিক ভাববেন না যেনো। আমি সেটা নই। আপনি যে নিরহংকারী উদার একজন মানুষ সেটা আপনার টেলিফোন পেয়েই বুঝতে পেরেছি। আমি জানি অনেক গীতিকার আপনার পেছন পেছন ঘোরে। আপনি সুর করলে একজন গীতিকারের অবস্থান পোক্ত হয়। কিন্তু দাদা আমি যেহেতু গীতিকার হতেই চাই না তাই সুবর্ণ একটা সুযোগ আমার হাত ছাতছাড়া হচ্ছে। কিছু মনে করবেন না দাদা। অধমকে ক্ষমা করবেন।
আমার কথায় হেসে ফেললেন প্রণব ঘোষ। বললেন, অসুবিধে নেই।আমি কিছু মনে করিনি। আপনার স্পষ্ট কথাগুলো ভালো লাগলো। আসেন একদিন। আড্ডা দেই আপনার সঙ্গে। শুনেছি আপনি খুব জমিয়ে আড্ডা দিতে পারেন।
নাহ্। এক জীবনে প্রণব ঘোষের সঙ্গে আড্ডা দেয়াটা হয়ে ওঠেনি আর। হলে ভালো হতো।
২. আমি কখনোই গীতিকার হতে চাইনি। কিন্তু একসময় প্রচুর গান লিখেছি বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যে। আমার সেই গান লেখাটা ছিলো মূলত স্ক্রিপ্ট লেখার অংশের মতোই। বিটিভিতে অসংখ্য অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লিখেছি কিন্তু কোনো স্ক্রিপ্ট আমি সংরক্ষণ করিনি। গানগুলোও তাই সংগ্রহের ব্যাপারে কোনো আগ্রহই ছিলো না আমার। কারণ খুব কাছে থেকে দেখেছি গীতিকাররা হচ্ছে সবচে অবহেলিত একটি ‘প্রজাতি’! গান একটা যৌথ শিল্প হলেও গানটা দুতিনটে ধাপ পেরিয়েই একজন শিল্পীর সম্পত্তি হয়ে যায়। আরো একটু স্পষ্ট করে বলি। অধিকাংশ সময়ই একটি গান জন্মলাভ করে একজন গীতিকারের মেধার শক্তি এবং দীপ্তিতে। গীতিকার গানটা লেখেন প্রথমে। তারপর গীতিকারের হাত থেকে সেটা যায় সুরকারের হাতে। সুরকার সেই কথায় সুর সংযোজন করেন। গানটা তখন সুরকারের হয়ে যায়। এরপর সুরকার গানটা তুলে দেন একজন কণ্ঠশিল্পীকে। কণ্ঠশিল্পী গানটা গাইবার পর গানটা হয়ে যায় সেই শিল্পীর।
যে কারণে আমরা বলি—লতার গান, হেমন্তের গান, মান্না দের গান কিংবা রুণার গান অথবা সাবিনার গান। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার কিংবা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নজরুল ইসলাম বাবু কিংবা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নামটি নিমেশেই চাপা পড়ে যায়। গানটা যখন শ্রোতার কাছে পৌঁছে গেলো, গানটা তখন আর সুরকারের থাকলো না। থাকলো না গীতিকারেরও। হয়ে গেলো শিল্পীর। তো আমি এমন একটা শিল্প নির্মাণে আমার মেধা এবং শ্রম কেনো বিনিয়োগ করবো যেখানে আমার কোনো কৃতিত্বকেই গোণাগুন্তিতে ধরবেন না কেউ? রেডিও-টিভিতে প্রচারিত আমার একটা গান হয়তো জনপ্রিয় হলো। শ্রোতা হয়তো বলবে খুব ভালো গান তো! দারূণ! কে গেয়েছে? অমুক শিল্পী। কিন্তু গানটা কার লেখা?—কেউ সেটা জানতেই চাইবে না। রেডিও-টিভিতে নিজের লেখা গানটা শুনে খুশিতে ডিগবাজি খাবেন গীতিকার—আহা এইটা আমার লেখা! এইটা আমার লেখা!! ব্যস। ঐটুকুই। নিজের বউ-ও জানবে না যে ওটা তাঁর পাশে বসা স্বামীরত্নটি লিখেছে! এমনই নাজুক পরিস্থিতিটা। রেডিও-টিভি-মঞ্চ-চলচ্চিত্র কোনোখানেই গীতিকারকে দুপয়সা দাম দেয় না কেউ।
আরেকটু স্পষ্ট করে বলি। স্বাধীনতার পর আমি যখন লেখালেখিতে এলাম, তখন গীতিকারদের করুণ অবস্থা দেখে যারপর নাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। আশির দশকে আমি যখন বিটিভির জন্যে নিয়মিত অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লিখছি, নাটক লিখছি, নির্দেশনা দিচ্ছি, পরিচালনা করছি কিংবা উপস্থাপনা করছি—তখন দেখলাম সবচে হতভাগা হচ্ছে গীতিকাররা। ওরা টাকা-র নামে যেটা পায় সেটা অনেকটা ভিক্ষার মতো। উদাহরণ দিয়ে বলি। টিভিতে যে গানটি গেয়ে একজন শিল্পী পেলেন তিন হাজার টাকা, সেই গানটির গীতিকার পাবেন তিরিশ টাকা। রেডিওতে কোনো গান পুনঃপ্রচার হলে শিল্পী যদি পান একশো টাকা তো গীতিকার পান তিন টাকা। ওই তিন বা তিরিশ টাকার খ্যাতাপুরি ঘোষণা দিয়ে টেলিভিশন থেকে গানের জন্যে আমি একটা টাকাও নিইনি। শুধু ছোটদের অনুষ্ঠানের জন্যেই আমি কম করে হলেও শ’দুয়েক গান লিখেছি। বিটিভির সঙ্গীত বিভাগের প্রধান কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী কিংবা প্রযোজক শামসুদ্দোহা তালুকদার আমাকে একাধিকবার বলেছেন—আপনি পঁচিশটা গান জমা দিয়ে এনলিস্টেড গীতিকার হয়ে যান। তা নইলে তো আপনি কোনো টাকা পাবেন না গান লেখা বাবদ। আমি বলেছি—আমি ভিক্ষুক নই। লেখক। আপনারা সম্মানির নামে একজন গীতিকারকে অসম্মান করেন। অপমান করেন। আমি সেই সুযোগ আপনাদের দেবো না। দরকার নেই আমার টাকার। বিটিভিকে ওগুলো আমি বিনে পয়সাতেই দিয়ে দিচ্ছি।
ছোটদের অনুষ্ঠান ছাড়াও বড়দের বিখ্যাত-অখ্যাত বহু ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে কিংবা ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রচুর গান প্রচারিত হয়েছে আমার। অল্পকিছু গানকে ছড়া কিংবা কবিতা হিশেবে আমি আমার বইতে ঠাঁই দিয়েছি বটে, কিন্তু শয়ে শয়ে ওগুলো অগ্রন্থিতই থেকে গেছে। তাতে আমার সামান্যতম আফসোসও নেই। ওগুলো আমি অন দ্য স্পট অনাদরে অবহেলায় অনেকটা দয়ামায়াহীন পরিস্থিতে রচনা করেছিলাম। বিটিভিতে আমি চাকরি না করলেও নিয়মিত স্টাফদের মতোই আমি সকালে রামপুরা যেতাম এবং ফিরতাম বিকেলে বা সন্ধ্যায়। রিহার্সাল বা রেকর্ডিং থাকলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেতো। আমি আমার বেকারত্ব মোচনে বিটিভিকেই বেছে নিয়েছিলাম তখন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান রচনা-গ্রন্থনা-গবেষণা-নির্দেশনা-পরিচালনা কিংবা উপস্থাপনা বাবদ মোটামুটি সম্মানজনক একটা সম্মানি পেতাম আমি। ওই টাকাতেই ‘কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যেতো’ আমার।
বিটিভিতে আমার লেখা প্রচুর গান প্রচারিত হচ্ছে যখন তখন একদিন আমার বাড়িতে এলেন দুজন বিখ্যাত গীতিকার এস এম হেদায়েত এবং শাফাত খৈয়াম। এস এম হেদায়েতের অনেক বিখ্যাত গান আছে। দুটো গানের কথা বলি—‘এই নীল মনিহার এই স্বর্ণালি দিনে তোমায় দিয়ে গেলাম শুধু মনে রেখো’ এবং ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দুজনে’। ওদের দুজনকে সাধ্যমতো খাতিরযত্ন করলাম। ওরা চাইলেন আমি যেনো ওদের ‘বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদের সদস্য হই। আমি রাজি হই না। কিন্তু ওদের আন্তরিক আগ্রহকে অগ্রাহ্যও করতে পারি না। এক পর্যায়ে সদস্য হলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন থেক খুব একটা সায় পাচ্ছিলাম না। কারণ আমি তো গীতিকার হিশেবে পরিচিত হতে চাই না। এস এম হেদায়েত ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা হয় রামপুরা টিভি ভবনে। নিয়মিতভাবেই মাসিক সদস্য চাঁদাটা তিনি আমার কাছ থেকে নিয়ে নেন। গীতিকবি সংসদের একটা রশীদ বই তাঁর পকেটেই থাকে। আমিও বিনা বাক্য ব্যয়ে চাঁদা দিয়ে দিই। এক দুপুরে টিভি ক্যান্টিনে আমি আর হেদায়েত ভাই লাঞ্চ করলাম একসঙ্গে। আমি তাঁকে আমার অতিথি বানালাম। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি আমার কাছে একটা সিগারেট দাবি করলেন। কিন্তু আমি নিজে সিগারেট খাইনা বলে কাউকে ওটা খাওয়াই না, এমন একটা নীতি মেনে চলি বলে সিগারেট খাওয়াতে আমি রাজি হই না। বলি প্রয়োজনে পাঁচটা সেভেন আপ কিংবা ছয়টা কোক খান কিন্তু সিগারেট? একটাও না। আমাকে বাগে আনতে না পেরে ক্যান্টিন ছেড়ে টিভি ভবনে প্রবেশের মুখে মজার একটা প্রস্তাব দিলেন হেদায়েত ভাই—তুমি যদি দামি একটা সিগারেট খাওয়াও(মানে বেনসন) তাইলে তোমার একটা গান সাবিনা বা রুণাকে দিয়া গাওয়াই দিমু।
হেদায়েত ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে হাসতে হাসতে আমি বললাম—সিগারেট আমি আপনাকে একটা না এক প্যাকেটই কিনে দিচ্ছি কিন্তু রুণা লায়লা কিংবা সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে আমার লেখা কোনো গান গাওয়ানোর বিনিময়ে নয়, ওটা আমি এমনিতেই দিচ্ছি কারণ আপনি নিজেই জানেন না কী অসাধারণ একজন গীতিকার আপনি। অতঃপর দিলাম কিনে নীতিমালা উপেক্ষা করে পুরো এক প্যাকেট বেনসন। ওটা পেয়ে কী যে খুশি হলেন হেদায়েত ভাই! দেখে আমার চোখে জল এসে গেলো। আহারে কী সরল এই মানুষটা! কতো অল্প এই মানুষটার চাইবার রেঞ্জ! কতো সামান্যতেই কতোটা আনন্দিত! অর্থাৎ বঞ্চিত এই মানুষটা অর্থ সংকটে থাকেন বলে বেনসনের মতো একটা ব্রান্ডই তাঁর ধরা ছোঁয়ার বাইরে! রেডিও-টেলিভিশন-চলচ্চিত্র এই মানুষটাকে কেবল ঠকিয়েই যাচ্ছে কারণ তিনি গীতিকার। ভেতরে ভেতরে আমার গীতিকার না হবার প্রত্যয়টি আরো জোড়ালো হয়ে ওঠে। আয়েস করে বেনসনের ধোঁয়া ছাড়ছিলেন হেদায়েত ভাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম—আচ্ছা হেদায়েত ভাই রুণা কিংবা সাবিনা আমার লেখা গান গাইলে আমার কী এমন ঘোড়ার ডিমটা অর্জিত হবে বলুন তো?
আমার বেয়াড়া প্রশ্নে খানিকটা হকচকিয়ে যান হেদায়েত ভাই—কী বললা?
–বললাম, আমার একটা গান রুণা লায়লা কিংবা সাবিনা ইয়াসমিন ধরেন গাইলো, তাতে কী এমন লাভটা হবে আমার বলেন তো?
আমতা আমতা করে হেদায়েত ভাই বললেন—তুতুতুমি তুমি বিখ্যাত অই যাইবা।
–ফালতু কথা কেনো বলেন! আপনার গান তো তাঁরা গেয়েছেন। আপনেরে কয়জনে চেনে? আপনের মতোন বহু গীতিকারের গান তাঁরা গেয়েছেন। কেউ তাঁদের নাম মনেও রাখে নাই। সো আমারেও রাখবো না। আর আমার তো দরকারও নাই আরেকজনের ল্যাঞ্জা হইয়া বিখ্যাত হওনের। ছড়াকার আছি ছড়াকারই থাকি। আর ছড়াকার হিশেবে আমি যে বিখ্যাত সেইটা আমার শত্রুরাও অস্বীকার করে না।
আমার কথায় কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েন হেদায়েত ভাই। আমি জানি আমার কথার মধ্যে কিছুটা ঔদ্ধত্য থাকলেও তাতে সত্যি আছে একশো পার্সেন্ট। সমাজ-সংসার-প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্র কেউই পোছে না একজন গীতিকারকে। ওরা চিরবঞ্চিত। হেদায়েত ভাই সেই বঞ্চিতদেরই একজন। হেদায়েত ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাস শোনার আগেই আমি কেটে পড়ি।তারপর ধিরে ধিরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিই গীতিকবি সংসদ থেকে। লেখক হিশেবে সমাজে এমনিতেই আমি বঞ্চিত শ্রেণীভূক্ত। লেখকদের তুলনায় গীতিকাররা হচ্ছেন তস্য বঞ্চিত। এমতাবস্থায় গীতিকার হয়ে নিজের অবস্থানকে আরো একধাপ নিচে নামিয়ে নিতে ‘মন মোর নহে রাজি’।
৩. ওপরের কথাগুলো আসলে ভূমিকা বা নান্দিপাঠ। গীতিকারদের হেয় বা তুচ্ছ্ব জ্ঞান করার বিস্তর ঘটনা আমার জানা আছে। অতীতের মতো এখনও গীতিকাররা যে অবজ্ঞা অবহেলা আর অসম্মানের শিকার তার আরেকটা নমুনা দেখলাম অতি সম্প্রতি।
ভারতের জিবাংলা টিভিতে সারেগামাপা নামের প্রতিযোগিতামূলক বা সিঙ্গার হান্টিং ধরণের একটি সফল বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কয়েকটি ছেলেমেয়েও চমৎকার পারফরম্যান্সে মুগ্ধ করে চলেছেন দর্শকদের। ঘরে ‘জাদু’ নামের একটি ডিভাইসের কল্যাণে বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলসহ পৃথিবীর নানা দেশের কয়েকশ চ্যানেল আমার রিমোটবন্দি। সেই সুবাদে সারেগামাপা-র একটি পর্ব আমার দেখা হলো।
বাংলাদেশের একটা ছেলে প্রিন্স মাহমুদের কথায় ও সুরে আমাদের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী জেমসের গাওয়া ‘বাবা কতোদিন দেখি না তোমায়’ শীর্ষক গানটা গেয়ে যাকে বলে একেবারে মাত করে ফেললো। জেমসের নাম বললেও ছেলেটা একবারও গীতিকার ও সুরকার প্রিন্সের নামটা উচ্চারণ করলো না। গীতিকার এবং সুরকার হিশেবে এই প্রিন্সের মেধার দীপ্তিতে বর্ণিল আমাদের সঙ্গীতের ভুবনটি। (উপস্থাপকের আগ্রহে ছেলেটা আমাদের বিখ্যাত শিল্পী আইউব বাচ্চুর গাওয়া ‘সেই তুমি কেনো এতো অচেনা হলে’ শীর্ষক গানটাও গাইলো বেশ জমিয়ে। কিন্তু এই গানের গীতিকার এবং সুরকার যে বিখ্যাত আইউব বাচ্চু সেটা বললো না। অর্থাৎ গীতিকার ও সুরকার এখানে উহ্য বা গুরুত্বপূর্ণ নয়।)
সারেগামাপা মাত করা ছেলেটার জন্মেরও আগে থেকেই প্রিন্স মাহমুদ কোটি বাঙালির হৃদয় রাঙিয়েছে। মা এবং বাবাকে বিষয় করে অবিস্মরণীয় দুটি গানের স্রষ্টা(গীতিকার ও সুরকার)প্রিন্সের কীর্তিসমূহ তো অজানা থাকবার কথা নয়। ফুটবল খেলতে আসবে আর ম্যারাডোনার নাম জানবে না তুমি? মেসিকে চিনবে না তুমি?
কেনো এমনটা করলো সে?
কারণ সে এটাতেই অভ্যস্ত। গীতিকারদের অবজ্ঞা অবহেলা বা অসম্মান করলে কিচ্ছু আসে যায় না, এটা অজানা নয় তার। সে মনে করে গানটা জেমসের বা বাচ্চুর। বা অন্য কোনো শিল্পীর। তার মস্তিষ্ক এরকম একটা পাকাপাকি ধারণাকেই ধারণ করে রেখেছে।
আমি গান না লিখলেও গীতিকারদের কেউ অসম্মান করলে বা গীতিকারের প্রাপ্য মর্যাদা না দিলে কোথায় যেনো লাগে খানিকটা। আমাদের গানের ভুবনের অনন্য এক রাজকুমার প্রীতিভাজন প্রিন্সের প্রতি ভালোবাসা ও মমতার নিদর্শন হিশেবেই লিখিত আকারে প্রতিবাদটা জারি রাখলাম।
গীতিকার গান না লিখলে শিল্পী তুমি গাইবে কি?
গীতিকার-সুরকারদের সম্মান করতে শেখো হে শিল্পী।
অটোয়া ০১ অক্টোবর ২০১৮ ।
নোট: বাংলাদেশের খ্যাতিমান ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন’র ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া।