শিল্প- সংস্কৃতি

তোমাকে খোলা চিঠি প্রিয় ইরফান : তুহিন শুভ্র মন্ডল

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ২৯, ২০২০
ইরফান
একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই, যে সমস্ত সিনে অভিনেতার নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে তাদের আমি ভালবাসি, পছন্দ করি। হতে পারে আমি নিজে যেহেতু থিয়েটারের সাথে সংযুক্ত বা যৎসামান্য কিঞ্চিত অভিনয়ের সুযোগ পাই সেটা একটা কারণ হতে পারে। হতে পারে না, সেটাই কারণ।
অমিতাভ বচ্চন (প্রথম জীবনে কলকাতায় নাটকে অভিনয় করেছেন) আমার খুব প্রিয় অভিনেতা। তার সাথেই নাসিরুদ্দিন শাহ, পরেশ রাওয়ালরা আমার খুব পছন্দের। আমরা শাহরুখ খানকে দেখে, ওর অভিনয়ে গা ভাসিয়ে, ওর প্রেম নিবেদনের ধরণে রোমাঞ্চিত হয়ে আমরা বড় হয়েছি।একটা সময় শাহরুখের আমি অন্ধ ভক্ত ছিলাম।বয়স বাড়ার সাথে একটু অন্ধত্ব কাটলেও তার ছবি ফ্লপ হলে বুকের বাঁদিকে এখনও চিনচিন করে।

যখন শুনেছিলাম শাহরুখ থিয়েটার করতো তখন তার প্রতি ভালবাসা আরও বহুগুন বেড়ে গিয়েছিল। আর ইরফান তুমি তো সরাসরি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার শিক্ষার্থী ছিলে।ফলে তোমার প্রতি আমার একটা বেঁকে যাওয়া অর্থাৎ ইনক্লাইনেশন প্রথম থেকেই ছিল। তোমার প্রতি ভালবাসা আমার অন্তহীন। কিন্ত আজ এভাবে কেন কাঁদালে ইরফান?

অনুরাগীদের এভাবে কাঁদাতে হয়? গোটা পৃথিবীতে তোমার অসংখ্য গুণমুগ্ধদের কাঁদিয়ে এভাবে চলে যেতে হয়? তিপ্পান্ন পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কোন বয়স বিল্লু? এই নামই তো ছিল তোমার বিল্লু বারবারে? হ্যাঁ, ঠিক নিউরো এন্ডোক্রিন টিউমার ছিল তোমার।তুমি অসুস্থ ছিলে।ক্যানসারও হয়ে গিয়েছিল।তাতে কি! জীবনের প্রতি বরাবরের আশাবাদী তুমি তো সে সবকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলে।এবার কেন পারলে না?
তোমার চলে যাওয়ার খবর যখন পেলাম তখন এই লকডাউনের মধ্যেও জরুরী কাজে একটি সীমান্তে। ফোনেই পেলাম খবরটা।কলকাতা থেকে এক বন্ধু দিল খবরটা। বিশ্বাসই করিনি।বরং বলা ভাল বিশ্বাস করতে চাইনি।বলেছিলাম ফেক নিউজ না তো! কিন্ত তারপর সোস্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায় তুমি। দেখলাম তোমার প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা যেখানে তুমি 1984 সালে থিয়েটারের স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলে তারাও তাদের ফেসবুক পেজে যখন তোমার গভীর দুঃখজনক মৃত্যু সংবাদ দিল তখন ভেঙে পড়লাম মনে মনে।

এই খবরটা পাওয়ার জন্যই কি আজ সূর্য উঠেছিল ইরফান? 1967 সালের 7 জানুয়ারি রাজস্থানের টঙ্ক জেলায় বাবা জাগিরদার খান আর মা বেগম খানের সংসারে তোমার জন্ম। আর 29 এপ্রিল 2020 মৃত্যুর আলপনা এঁকে নিলে নিজ ললাটে।এসব শুনে কি স্থির থাকা যায়? মাঝের বছর গুলোতে তুমি রাজস্থান থেকে মুম্বইতে এলে।টিভি সিরিয়াল চানক্য, ভারত এক খোঁজ, চন্দ্রকান্তা ইত্যাদিতে তুমি পরিচিত মুখ হয়ে উঠলে।

তারপর বলিউড, হলিউড মিলিয়ে তোমার ঈশ্বরপ্রদত্ত অভিনয় প্রতিভায় মাত করে দিয়ে হয়ে উঠলে তারকা।একটা সত্যিকারের তারকা যার পা সবসময় এই গ্ল্যামার সর্বস্ব দুনিয়ায় থেকেও ছিল মাটিতে। ছিলে একজন বড় মনের মানুষ। সালাম বোম্বে(1988) দিয়ে বলিউডে শুরু।পরের দিকে হাসিল(2003), মকবুল(2004), লাইফ ইন এ মেট্রো(2007),পান সিং তোমার(2011), দ্য লাঞ্চবক্স(2013), হায়দর(2014), পিকু(2015) তে উল্লেখযোগ্য অভিনয়ের ধারা দেখাও তুমি। অভিনয় তো নয় একেবারে পুরো মাখন।এতেই তুমি রেহাই পেলে না। এমন সহজ অথচ সুগভীর অভিনয় শৈলি যার তাকে কি হলিউড না ডাক দিয়ে পারে? তাই আন্তর্জাতিক সিনেমাতেও তোমার জয়জয়কার।দ্য ওয়ারিয়র(2006), দ্য নেমসেক(2006), আকাদেমি পুরষ্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র স্লামডগ মিলিয়নিয়ার(2006), দি অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান(2012), লাইফ অফ পাই(2012) তালিকাটা দীর্ঘ।
ভারত সরকার 2011 সালে তোমাকে দিল দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’।
আমি যাদের পছন্দ করি তাদেরকে আমি আতিপাতি করে খুঁজি। তাদের জীবন বৃত্তান্ত পড়ি। আমার ভালো লাগে। সেই মানুষটাকে ভিতর থেকে জানতে ইচ্ছে করে।আমি কিন্ত জানি ইরফান তুমি ক্রিকেটার হিসাবেও বেশ ভাল ছিলে। ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে সি কে নাইডু ট্রফি একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম ও মাইলস্টোন। সেখানে অনুর্ধ তেইশ সি কে নাইডু ট্রফির চূড়ান্ত টিমে তুমি মনোনীত হয়েছিলে।কিন্ত অর্থের অভাব বাদ সাধলো। অথবা এটাও জানি যে তোমার অমন গভীর আর উজ্জ্বল চোখ দুটো নিয়ে কি লিখেছিল স্ম্যাশহিটস? তোমার প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘রোগ'(2006)-এ। তোমার অভিনয় দেখে স্ম্যাশহিট লিখলো ‘ইরফানের চোখ তার শব্দের চেয়েও জোরে কথা বলে এবং পর্দায় যতক্ষণ তাকে দেখা যায় তিনি অভিনয় শিল্পী হিসাবে তার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন’।

ইরফান খান,

মন ভাল নেই একেবারেই।এতদিনের প্রিয় অভিনেতার এভাবে এই বয়সে চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারে? প্রিয় ইরফু, তোমার চলে যাওয়ায় চলচ্চিত্রের দিকপালরা শোকগ্রস্ত, বেদনাহত। তাইতো তোমার বন্ধু চিত্র পরিচালক সুজিত সরকার যখন টুইট করে তোমার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার এই মর্মস্পর্শী খবরটা দিল তারপর থেকেই অমিতাভ বচ্চন, কামাল হাসান, অক্ষয় কুমার, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া প্রমুখরা একের পর এক মন খারাপ করা টুইট করতে লাগলেন।

কিংবদন্তী অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন লিখলেন ‘গভীর দুঃখজনক খবর।এই শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়।’ আর তোমার বন্ধু শাহরুখ! বিল্লু বারবার সিনেমায় অভিনয়ের সময় থেকে যার সাথে তোমার সিনেমার সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধুত্ব সেই সিনেমার মতোই।যে তোমার লন্ডনে চিকিৎসা করতে যাওয়ার আগে তোমার বাঙালী স্ত্রী সুতপা সিকদারের একটা ফোনে সব কাজ ফেলে তোমার বাড়ি চলে গিয়ে তোমার হাতে তুলে দিল তার লন্ডনের বাড়ির চাবি। যাতে তোমার কোন অসুবিধে না হয়। যাতে লন্ডনেও নিজের বাড়ি মনে করে থাকতে পারো।
কি লিখলো সে আজ?  লিখলো  ‘বন্ধু এবং অণুপ্রেরণা…আমাদের সময়ের গ্রেটেস্ট অভিনেতা।’ শাহরুখ তোমাকে বড় ভালবাসতো ইরফু। আমিও।তোমাকে আমিও খুব ভালবাসি, পছন্দ করি সেটা শুধু তোমার অনিন্দ্যসুন্দর ও আশ্চর্য অভিনয় প্রতিভার জন্য নয়, নানান ঘটনায় প্রমানিত তোমার ভাল মানুষী মনটার জন্য। আর একটা পরিচয় আছে সেজন্যও তোমার সাথে গভীর সংযোগ।সেটা তোমার বাঙালি স্ত্রীর জন্যও যে শুধু নয় সেটা তোমার জন্যও এতদিনে তুমি তো বাঙালীই হয়ে গিয়েছিলে বন্ধু। তোমার সাথে একদিন তো দেখা হবেই।

সেদিন কিন্ত বাংলায় লেখা এই খামবিহীন খোলা চিঠি নিয়েই আমরা দুজনে বাংলায় কথা বলতে বলতে আড্ডা দেবো। কি রাজি তো! ইতি তোমার গুণমুগ্ধ তুহিন

তুহিন শুভ্র মন্ডল : নাট্যকর্মী ও অভিনেতা, ভারত।

About the author

নরসুন্দা ডটকম