বাম-প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধীমানপুরুষ ছিলেন অজয় রায়।তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে বিশুদ্ধ বাঙালি।গভীরাশ্রয়ী মনন ও চিন্তার অধিকারী এই মানুষটির ছিল একটি নিজস্ব ভাবজগত। জাতিসত্ত্বা, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে ছিলেন শিকড়সন্ধানী মানুষ। অতীশ দীপঙ্কর থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী চৈতন্যদেব থেকে বাউল ফকির লালন শাহ-এসব জ্ঞানতাপস মনীষীরা বাঙালির যে নৈতিক ভিত্তি তথা মনোজগত নির্মাণ করেছেন তার উপর অজয় রায়ের ছিল গভীর বিশ্বাস ও আস্থা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রুশ বিপ্লবের পর মার্কসের সাম্যবাদী দর্শনের প্রভাবে দুনিয়ার দিকে দিকে যে ঝড় ওঠে; সেই ঝড়ে আলোড়িত হয় ভারতবর্ষও। এ সময় এম এন রায়, সিঙ্গারা ভেলু বেন্ডিয়ার, এস এ ডাঙ্গে, শওকত উসমানী, গোলাম হোসেন এবং কমরেড মুজফফর আহমদের নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনমানসে মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা দানা বাঁধতে থাকে।
অতপর ১৯২৫ সালে কানপুর সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন ঘটে।কমরেড মুজফফর আহমদের হাত ধরে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসের এই সাম্যবাদী দর্শনের হাতছানিতে আকৃষ্ট হয়ে স্কুল জীবনেই বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন অজয় রায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। প্রায় সব রকম বৈষয়িক দায়িত্ব ও আকর্ষণ উপেক্ষা করে মানবতার রাজনীতির তীর্থযাত্রী হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন মেয়াদে কাটিয়েছেন ১৫ বছরের কারাজীবন। ১৯৫২ সালে কারাগারের অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ‘কবর’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন নাটকটির রচয়িতা এবং কারাবন্দি সহযোদ্ধা মুনীর চৌধুরীর সাথে। এই কারাগারেই তিনি পাঠ নিয়েছিলেন গণমানুষের মুক্তির দর্শনে।
উল্লেখ্য, মামলা-হুলিয়া মাথায় নিয়ে অনিশ্চিত জীবনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গ্রাজুয়েশন পরীক্ষায় অর্জন করেছিলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছিলেন কারাবন্দি জীবনেই।
একজন আধুনিক ও সংস্কারবাদী মানুষ হিসেবে যুগের পরিবর্তনকে স্বাগত জানালেও তিনি কখনোই অতীত বিমুখ ছিলেন না। ইতিহাস সচেতন অজয় রায় বাঙালির হাজার বছরের শাশ্বত মৌলিক সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে মনের গহীনে লালন করেছেন সারা জীবন। তাই শাসক শ্রেণির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন, পহেলা বৈশাখ উদযাপন, মঙ্গল শোভাত্রার প্রচলন, উদীচী-ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কালজয়ী কার্যক্রমের স্থপতি হিসেবে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে।
বামপন্থী রাজনীতিক হিসেবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির তৃণমূল থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। পার্টির মুখপত্র একতা’র সম্পাদনাও করেছেন অনেকদিন।
তিনি তাঁর মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির তাত্বিক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে রাজনৈতিক কৌশলগত বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে তিনি পার্টি থেকে বেরিয়ে ‘কমিউনিস্ট কেন্দ্র’ নামে একটি মার্কসবাদী সংগঠন গড়ে তোলেন। তবে এই সংগঠনের সঙ্গেও তিনি বেশিদিন সম্পৃক্ত থাকেননি।
অতপর দেশের প্রচলিত রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কয়েকজন দেশবরেণ্য ব্যক্তির মিলিত উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং ২০১০ সালে গঠন করেন ‘সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ’। দুর্বৃত্তায়িত ও আদর্শহীন রাজনীতির ঘুরপাঁকে অস্থির অজয় রায় পথহারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে ব্যাপৃত ছিলেন জীবনের শেষ অবধি।
মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎ বোস, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অহিংস ও মানবতার নীতি-আদর্শ তিনি ধারণ করেছেন জীবনের সকল পর্যায়ে। সে কারণেই জীবন-জিজ্ঞাসার প্রশ্নে নগরবাসী অজয় রায়ের মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল কঠিন সুতায় বাঁধা। তাঁর এই অকৃত্রিম মৃত্তিকালগ্নতা আমাদেরকে মোহিত করে। মানুষের উপর তাঁর ছিল অগাধ-অবিচল আস্থা। কাউকেই তিনি অবিশ্বাস করতেন না। কারণ ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ রবীন্দ্রনাথের এই অমর কথাটি তিনি সারা জীবন লালন করেছেন পরম শ্রদ্ধায়।
অজয় রায়ের পড়ালেখার সীমানা ও ক্ষেত্র ছিল বহুবিস্তৃত-বহুমাত্রিক। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ধর্মতত্ব, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে ছিল তাঁর পাঠবিচরণ। তাঁর জীবনশিক্ষা ছিল বহু শাখায় পল্লবিত। লেখক হিসেবেও অজয় রায় ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত ১৭টি গ্রন্থ প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সমকালে যেমন পাঠক-সুধিসমাজে প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি বর্তমানেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সমাদৃত।
সুতীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অজয় রায়ের ছিল দূর থেকে নিজেকে চিনতে পারার অসম্ভব ক্ষমতা। সমকালে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেতেন ভবিষ্যতকে। অত্যন্ত মিতবাক এবং প্রচারবিমুখ অজয় রায় মানুষের আপন ঢোল বাজানোর শোরগোলে মুখ লুকিয়ে চলতেন। কেউ তাঁকে প্রশংসা বা তোষামোদ করলে তিনি বিব্রত ও অস্বস্তিবোধ করতেন। এদেশের বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের বাঁক বদলের রূপকার হয়েও তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তী মানুষ। অজয় রায় আত্মসমালোচনা করতের নির্দ্বিধায়। এখানেই অন্য অনেকের সাথে ছিল তাঁর ভিন্নতা।
অজয় রায়ের জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থানার বনগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতার দাবিতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উত্তাল, স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীরা প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন অকাতরে। সময়ের এই আত্মনিবেদনের চেতনা এবং পারিবারিক আদর্শের আলোকেই অজয় রায়ের মনোজগত গড়ে ওঠে, শোষিত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলন হয়ে ওঠে তাঁর আরাধনা। সে কারণেই তিনি ছিলেন আজীবন আপোসহীন-নীতিনিষ্ঠ এক দেশপ্রেমিক।
অজয় রায়ের পিতা ড. প্রমথ নাথ রায় ছিলেন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ভাষার (ইংরেজি) অধ্যাপক। পিতার কর্মসুবাদে অজয় রায়ের শৈশব-কৈশোর কাটে বেনারসে। এখানেই তিনি মেট্রিক (১৯৪৩) এবং আইএসসি (১৯৪৫) উভয় পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে পাশ করে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পিতা-মাতার অকাল মৃত্যু তাঁকে অনিশ্চিত জীবনের দোরগোড়ায় ঠেলে দেয়। ফলে পড়ালেখায় বিরতি দিয়ে পিতৃ-মাতৃহীন অজয় রায় ছোট ভাইবোনদের নিয়ে ফিরে আসেন কিশোরগঞ্জের বনগ্রামে। শুরু হয় জীবনযুদ্ধ।
জীবন সংগ্রামী অজয় রায় উত্তর ভারতের বেনারস থেকে কিশোরগঞ্জের গ্রাম, ময়মনসিংহ শহরের ধুলি-ধূসর রাস্তা, আধা শহর আধা গ্রাম, মুন্সিগঞ্জের এক রাস্তার জনপদ, পুরানো ঢাকার অলিগলি, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগার, মুক্তযুদ্ধকালে মেঘালয় রাজ্যের বারেংগাপাড়া থানা শহর, এরপর কিশোরগঞ্জ হয়ে ঢাকাবাসী হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে।ওয়ারীর র্যাংকিন স্ট্রীট থেকে ধানমন্ডির নীলাচল- এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। অবশেষে বহুবর্ণিল ইতিহাসের এই নেপথ্য নায়ক ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর ৮৮ বছর বয়সে নিরবসর জীবনের ইতি টেনেছেন। জাতির বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ফিরে গেছেন কিশোরগঞ্জের বনগ্রামে জন্মমাটির কোলে। মিশে গেছেন বাংলার পলি দো-আঁশে।
জীবনচক্রের বাস্তবতায় এই জগৎ-সমাজ-সংসার থেকে অজয় রায়ের প্রস্থান ঘটলেও তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন তাঁর জীবনব্যাপী সাধিত বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে। তাঁর নীতি-আদর্শের উজ্জ্বলতায়। কৈশোর থেকে আমৃত্যু জ্ঞানের ও চিন্তার জগতে অহর্নিশ নিমগ্ন থেকে তিনি সমাজ ও মানুষকে সম্পদবান করে গেছেন।
ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তার বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তিপূর্ণ দৃঢ় অবস্থান আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজনীতিকে মানবিক পথের সন্ধান দেয়। সামগ্রিক বিবেচনায় অজয় রায়ের জীবনসত্তার পূর্ণতা ও বিভূতি আমাদের অভিভূত করে, মানুষ হিসেবে তাঁর বিনয়, সৌজন্যবোধ, সহমর্মিতা এবং সংবেদনশীলতা আমাদের করে মুগ্ধ।
তিনি জীবনকে ভেঙে নতুন ছাঁচে গড়তে শিখিয়েছেন, জীবনের শাখা-প্রশাখা চারিদিকের আলো-অন্ধকারের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে ছায়া দিতে শিখিয়েছেন। গণমানুষের জাগৃতি সাধনের মতো মহৎ কাজে সাথে কেউ আসুক বা না আসুক, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় একলা চলার প্রেরণা দিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন থেকে আমরা প্রতিকূলতার প্রাচীর ডিঙানোর সাহস পাই, আঁধার রাতে পথ চলতে আলো পাই। সে কারণেই অজয় রায় তাঁর উত্তর প্রজন্মের কাছে এক জীবন মশাল।
তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই আকাশ বিস্তৃত, অতলস্পর্শী ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও সম্পাদক, সড়ক বার্ত।