কাল মধ্যরাত পর্যন্ত হিউস্টনের নানান সড়কে এলোমেলো চক্কর দিচ্ছিলাম প্রীতিভাজন আরিফ বাবুর সঙ্গে। আমাকে চনমনে রাখতে বাবু ওর ছোট্ট কিউট মার্সিডিজ-এ উচ্চ ভল্যুমে চালিয়ে দিয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর গান।
রক্তে দোলা লাগানিয়া সুর ঝংকারে আইয়ুব বাচ্চু গাইছেন তাঁর বিখ্যাত গান–”এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে/গুনতে দিস তুই কিছু মোরে/ ওরে সব ভালো তুই একা বাসিস নে/একটু ভালোবাসতে দিস মোরে/পুরো জোছোনা তুই একা পোহাস নে/ সঙ্গে নিস রে তুই মোরে/ ওরে সব ভালো তুই একা বাসিস নে/একটু ভালোবাসতে দিস মোরে…..।”
বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের সব ভালোবাসা একাই জিতে নিয়েছিলেন বাচ্চু তাঁর সুরের জাদুতে। আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের জাতীয় সঙ্গীত বলা হয় বাচ্চুর ”সেই তুমি কেনো এতো অচেনা হলে” গানটিকে।
বাচ্চু সম্পর্কিত আমার উচ্ছ্বাসপূর্ন কথাবার্তায় বাবু খানিকটা বিস্ময়ই প্রকাশ করলো। গিটারিস্ট হিশেবে বাচ্চুকে আমি বাংলাদেশের তো বটেই, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বা শীর্ষস্থানীয় বাজিয়ের আসনে দেখি। প্রবাসে, মন খারাপের অশ্রুমাখা দহনদগ্ধকালে বহুদিন আমি বাচ্চুর রূপালি গিটারের অকল্পনীয় দক্ষতায় নির্মিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা শুনেছি।
গিটার কথা বলে ওঠে বাচ্চুর আঙুলের স্পর্শে।
কাল রাতে আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী বাচ্চুকে নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস আর আবেগ যেনো উপচে পড়ছিলো। ভায়োলিনের করুণ মূর্ছনায় হৃদয় মোচড় দেয়া সুতীব্র ক্রন্দনের মতো একটা সঙ্গীতায়োজনে বাচ্চুর হিরণ্ময় কন্ঠ বলে যাচ্ছিলো–”এখন অনেক রাত/ খোলা আকাশের নিচে/জীবনের অনেক আয়োজন আমায় ডেকেছে/তাই আমি বসে আছি দরজার ওপাশে…।”
জীবনের কী আশ্চর্য নিষ্ঠুর স্বভাব ! চব্বিশ ঘন্টাও পেরোয়নি, আজকে, ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘরে পৌঁছানোর কয়েক ঘন্টা আগেই পৃথিবীতে লেখা হয়ে গেছে আরো একটা মন খারাপ করা গল্প। টিভি স্ক্রলে ধাবমান একটা খবরের ওপর দৃষ্টি পড়তেই চোখ আমার ঝাপসা হয়ে উঠলো। প্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন দরজার ওপাশে। যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেন না।
গতকাল রাতেও আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন আমার সঙ্গে। বাচ্চু গাইছিলেন–‘এখন অনেক রাত‘। হিউস্টনের আকাশে তখন সত্যি সত্যি অনেক রাত ছিলো। এখনও অনেক রাত, হিউস্টনের আকাশে। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু আজ নেই। তিনি চলে গেছেন দরজার ওপাশে……।
প্রিয় বাচ্চু ভাই, তিন দশকের বেশি সময় ধরে আপনি মাতিয়ে রেখেছিলেন কোটি কোটি মানুষকে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে আপনি এক নক্ষত্রপ্রতিম বিস্ময়পুরুষ। ৫৬ বছর কোনো বয়েস হলো! আপনার এরকম চলে যাওয়াটা মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার ৫৮। বয়েসের হিশেবে আমরা সমসাময়িক। আপনার মতো আমিও একদিন দরোজার ওপাশে চলে যাবো। উড়াল দেবো আকাশে। এতো এতো দেখা হয়েছে আমাদের কিন্তু কোনোদিন বলাই হলো না–বাচ্চু ভাই কতো ভালোবাসি আপনাকে! আমার জীবনের কতো শতো মুহূর্ত ঘন্টা দিন এবং রাত্রি রাঙিয়ে দিয়েছেন আপনি!
আজ রাতে আমি আর ঘুমাবো না। রাতটা কাটবে আপনার গান শুনে। এই লেখাটা লিখছি যখন ল্যাপটপের অডিও বক্সে আপনি গাইছেন–আর কতো এইভাবে আমাকে কাঁদাবে? আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে…।
হিউস্টন ১৮ অক্টোবর ২০১৮