আজ ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস, বাংলাদেশের বাঙালিরা ৪৭ বছর আগে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং আরোপিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গর্জে উঠে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিল।
এই যুদ্ধের জন্য বাঙালির হাতিয়ার ছিল দুটি : হাজার বছর ধরে পলিবিধৌত এই বাংলার মাটিতে বিভিন্ন ভাব-দর্শন-ধর্ম ও সংগ্রামী চেতনা নিয়ে গড়ে ওঠা সমন্বয়ধর্মী অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তা বোধের চকিত উপলব্ধি এবং ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রূর মোকাবিলা’ করার মত অদম্য মনোবল ও সাহস। আশা করা গিয়েছিল, পৃথিবীর অন্যতম সেরা সংবিধান নিয়ে যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ যে যাত্রা শুরু করেছিল তা আর কখনো পশ্চাদপসরণ করবে না।
কিন্তু দূভার্গ্যের সাথে আমাদের দেখতে হয়েছে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার পরিবর্তে ক্রমাগত ধর্মশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হবার দিকে যাত্রা শুরু করেছে এবং ৭৫-এ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্ষমতাহরণের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গতিমুখ সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে ধাবিত হয়ে এক ধর্মবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে বাংলাদেশ তার আদি চরিত্র পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে ; কিন্তু আদর্শহীনতা, ক্ষমতার লোভ এবং সার্বিকভাবে অপরিণত বুদ্ধিবৃত্তির কারণে বাংলাদেশের পক্ষে তার উন্মেষকালীন উপলব্ধি ও প্রত্যয়ে পৌঁছে বিকশিত হবার সম্ভাবনা সূদুর পরাহত হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক শক্তির নিপীড়ন এবং আরোপিত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় জেগে ওঠা চকিত জাতিসত্তা ও মানবিকতার বোধ যে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত প্রমান। যতকাল পর্যন্ত বাঙালি নিজস্ব অস্তিত্ব বিকাশের স্বার্থে , জাতি হিসেবে সামগ্রিকভাবে অন্তরের গভীর থেকে চেতনাগত পরিণতমনস্কতা লাভে ব্যর্থ হবে, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ আশাভঙ্গ ও বেদনার কারণ হয়েই থাকবে — আপাত কিছু ভৌত ও বাহ্যিক অবয়বগত উন্নয়ন ছাড়া।
আজকে বিজয় দিবসে আমার প্রার্থনা — বাঙালি সমগ্র দৃষ্টিতে আত্মদর্শন এবং আত্মাবিষ্কারে সক্ষম হোক, অদূর ভবিষ্যতে সমতা ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা নির্মাণে স্থায়ীভাবে সফল হোক ! পৃথিবীর যে-প্রান্তে বাঙালির যত ভাই-বোন আছেন, সবাইকে বাংলাদেশের ৪৭-তম মহান বিজয় দিবসে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা !
নোট: লেখাটি লেখকের ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া।
তুষার গায়েন : কবি, প্রাবন্ধিক।জন্ম – ৪ জুলাই ১৯৬৭, ভাণ্ডারিয়া। আশির দশকে স্নাতক শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান সোভিয়েত ইউনিয়নে। শিক্ষা শেষে নব্বইয়ের শুরুতে দেশে ফিরে স্থাপত্য পেশার পাশাপাশি নিয়মিত কাব্যচর্চা শুরু করেন এবং লিটল ম্যাগাজিনসহ দেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন সাহিত্য, স্থাপত্য, সমকালীন দর্শন ও চিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধাদি। ২০০৬ সাল থেকে উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছেন, কানাডার প্রাণকেন্দ্র সাংস্কৃতিক ও বানিজ্যিক শহর, টরন্টো। পেশায় স্থপতি; ‘দ্য ওডেসা স্টেট একাডেমী অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড আর্কির্টেকচার’ থেকে স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর (১৯৯২) এবং আমেরিকার ‘দ্য নিউইয়র্ক সিটি কলেজ অব দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি’ থেকে আরবান ডিজাইন-এ মাস্টার্স করেছেন (২০০৮)।
প্রকাশিত কবিতার বই: নীলভবহ্রদ (১৯৯৭), বৃষ্টির অন্তর ত্রাস (২০০৩), দ্বিমেরুযোজন (২০১২)। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন, Postmodern Bangla poetry 2003, অধুনান্তিক বাংলা কবিতার অনুবাদ সংকলন।
আরো পড়ুন…
আমার পার্থদা : লিটল ম্যাগাজিনের দরদী স্বজন
মুচিপাড়ায় কুকুরদের জীবনে কেয়ামত নেমে আসা সেই সকালের গল্প: লুৎফর রহমান রিটন