দেশ-বিদেশ

চলে গেলেন অমলকান্তির কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

নরসুন্দা ডটকম   ডিসেম্বর ২৫, ২০১৮

চলে গেলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।আজ মঙ্গলবার সকালে দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

বেশ কিছু দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। সম্প্রতি শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করে। কয়েক দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সোমবার সকালে তাঁর হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। সেই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি নীরেন্দ্রনাথ।

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবির পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনির লেখক, সম্পাদক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ।

ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন নীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন কবির বয়স ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’… অজস্র কবিতার বই। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর লেখা কবিতা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল…’ বা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়…’ বাঙালির কাছে রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

দশকের হিসাবে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চলিস্নশের দশকের কবি, তা সবারই জানা। সেই দশক ছিল বিদ্রোহে-বিপস্নবে রক্তিম, মন্বন্তরে ধ্বস্ত, দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত। এ-সময় বাংলা দেখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, নেতাজির নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের মরণজয়ী সংগ্রাম; দেখেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসা। দেখেছে মন্বন্তরে শত-সহস্র ক্ষুধার্ত মানুষের নিরুপায় মৃত্যুর মিছিল, এই সময়ের ছাপ চেতনায় নিয়েই বাংলা কাব্যবিশ্বে নীরেন্দ্রনাথের আবির্ভাব।

সাহিত্য মাত্রেই  যুগের ফসল। আর সচেতন কবির কবিতায় তো সময় হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক উপার্জন। নীরেন্দ্রনাথের কবিতাতে তাই চলিস্নশের কালবেলা স্বতঃস্ফূর্ততায় উৎকীর্ণ হয়ে উঠেছে।

কবিতাই তাঁর মাতৃভাষা ছিল। তবে, খবরের কাগজে কাজ করার সুবাদে নানা রকমের গদ্যও লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজে মনে করতেন, ‘কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।’ বলতেন, ‘কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা। যেমন কলকাতার যিশু, উলঙ্গ রাজা, বাতাসি।’ এ প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন, ‘এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।’

এ বছরের ২৯ জুলাই মারা গিয়েছিলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। বন্ধুর স্মৃতিচারণায় ‘দেশ’ পত্রিকায় নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না।… ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।’ সেই লেখার শেষে নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এখন একদম শয্যাশায়ী অবস্থায় আছি। আর ক্রমাগত এই কথাটা ভাবছি, আমি শিগগিরি যাব…।’

সেই ‘শিগগিরি’ যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে, তা কি নীরেন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন? বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি রোদ্দুর হয়ে গেলেন।

আরো পড়তে পারেন…

বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী চার্লি চ্যাপলিনের গল্প

মহাভারত’-এ কৃষ্ণ হচ্ছেন আমির- শাহরুখ খান

About the author

নরসুন্দা ডটকম