মানুষ- সমাজ

অন্য আলোয় গোলাম সারওয়ার : আবেদ খান

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ৪, ২০১৯

আমার সাংবাদিকতা জীবনে গোলাম সারওয়ারকে দেখেছি অন্য এক চেহারায়। সংবাদের প্রয়োজনে সংবাদ কাটাছেঁড়া করতেন অতিশয় নির্মমভাবে। তখন ধন্দে পড়তে হয়- আবেগপ্রবণ গোলাম সারওয়ার আর আবেগহীন গোলাম সারওয়ারের মধ্যে কোনটা সত্য। তাঁর সাংবাদিকতার জীবন নিয়ে অনেকেই হয়তো অনেক কথা বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিংবা প্রকৃত সংবাদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গোলাম সারওয়ার ছিলেন নিখুঁত একটি মানুষ। খবরের প্রয়োজনে তিনি সময়ের বিধিনিষেধ মানতেন না কখনও

আমি রাশিচক্রে বিশ্বাস করি না। তারপরেও কতকগুলো অদ্ভুত ঘটনা কাকতালীয়ভাবে ঘটে যায়। যেমন গোলাম সারওয়ারের জন্মদিন এপ্রিল মাসের ১ তারিখ। আমার জন্মমাসটিও এপ্রিল। আমাদের পেশাগত জীবনের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাসান শাহরিয়ার, তারও জন্মমাস এই এপ্রিল।

আমাদের পরিচয়ের মূল ক্ষেত্রটি সাংবাদিকতা। ঘনিষ্ঠতার কারণও ঘটেছে ওই পেশাগত জীবনের ভেতর দিয়ে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, এপ্রিলের জাতক মানেই নানা রকম মিল ঘটে যাবে। এই এপ্রিলে তো হিটলারেরও জন্মদিন ছিল, আবার চার্লি চ্যাপলিনেরও। তার মানে তো এই নয় যে, হিটলার কিংবা চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে রাশিগত মিলের কারণে আমরা সবাই সেই ধরনের কিছু জন্মগতভাবে পেয়ে গেছি। আমার মনে হয়, আমাদের এই তিনজনের সম্পর্কের গাঢ়তা এসব ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।

গোলাম সারওয়ার আমার সুদীর্ঘ ৪৫ বছরের সহকর্মী এবং বলা যায় সহমর্মীও। আমাদের দু’জনের কর্মপদ্ধতি অবশ্যই ভিন্ন। গোলাম সারওয়ার ছিলেন প্রকৃত অর্থেই কাগজের মানুষ। তাঁর সামগ্রিক ধ্যান-জ্ঞান, ভালোবাসা সবই ছিল সংবাদপত্র জগৎকে কেন্দ্র করে। আমার সঙ্গে এখানে তাঁর একটি অমিল রয়ে গেছে। আমি এককেন্দ্রিক নই। আমার বিচরণের জগৎ সংবাদপত্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সংগঠন এসবই জুড়ে। আর গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। লেখার হাত তাঁর অবিশ্বাস্য রকমের মিষ্টি। বর্ণনায় রূপকল্প এত অনিবার্যভাবে চলে আসত, যা থেকে আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, সারওয়ারকে আসলে কোন ভূমিকায় মানায়- সাহিত্যপ্রেমী, না সংবাদপত্রপ্রেমী? 

এক সময় যখন খেলাঘরে তাঁর লেখা ছড়া বেরোত, তখন গোলাম সারওয়ার ছিলেন আমার অচেনা। সেই অচেনা অবস্থায়ও তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন তাঁর ছন্দজ্ঞান এবং সাহিত্যের শক্তিমত্তা দিয়ে। পরবর্তী জীবনে মাঝেমধ্যে যখন গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে কথা হতো, তখন তাকে আমি বলতাম, সারওয়ার, আপনি বুঝিয়ে দিয়েছেন- আপনি জীবনানন্দের ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা এক কবি।

গোলাম সারওয়ার সলজ্জ হাসি হাসতেন। আমার সাংবাদিকতা জীবনে গোলাম সারওয়ারকে দেখেছি অন্য এক চেহারায়। সংবাদের প্রয়োজনে সংবাদ কাটাছেঁড়া করতেন অতিশয় নির্মমভাবে। তখন ধন্দে পড়তে হয়- আবেগপ্রবণ গোলাম সারওয়ার আর আবেগহীন গোলাম সারওয়ারের মধ্যে কোনটা সত্য। তাঁর সাংবাদিকতার জীবন নিয়ে অনেকেই হয়তো অনেক কথা বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিংবা প্রকৃত সংবাদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গোলাম সারওয়ার ছিলেন নিখুঁত একটি মানুষ। খবরের প্রয়োজনে তিনি সময়ের বিধিনিষেধ মানতেন না কখনও। কোথায় বসে কাজ করবেন, তা নিয়েও কোনোদিন ভাবেননি। কত দ্রুত কীভাবে একটি কাজ অতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে, সেই বোধে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর মস্তিস্কের সচল এবং সতর্কতা ছিল বিস্ময়কর। কত দ্রুত একটি কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করা যায়, সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে সত্যটি অনায়াসে তুলে আনা যায়, এটা বোধহয় আমাদের সমসাময়িক কিংবা তার পরের প্রজন্মের মধ্যেও দেখা যেত না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গোলাম সারওয়ারের মস্তিস্কের ক্ষিপ্রতা ছিল অনবদ্য।

আরো পড়তে পারেন…

স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ : মুহম্মদ জাফর ইকবাল

হিউস্টনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে : লুৎফর রহমান রিটন

একটি সমাবর্তন ভাষণ : মুহম্মদ জাফর ইকবাল

অনেকে বলে থাকেন, গোলাম সারওয়ার গত কয়েক দশকে সফল বার্তা সম্পাদকদের মধ্যে একজন। যদি বার্তা সম্পাদক হিসেবে বলি, আমার পেশাগত জীবনে অনেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, এটা বিবেচনায় রেখেই বলছি- তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয় তিনজনের একজন।

গোলাম সারওয়ার সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে আমি থামতে পারি না। সফলতায় কিংবা দুর্বলতায় তিনি আমার চোখে সেই কতিপয় একজন, যাকে হারিয়ে আমি খুবই নিঃসঙ্গ হয়েছি। আমাদের দেখা কম হতো পরবর্তী জীবনে। ‘৮৪ সালে যখন আমি ইত্তেফাক ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথে ঝাঁপ দিই এবং একজন নিছক কলাম লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার বিপন্ন প্রয়াস চালাচ্ছি, তখন অনেকেই আমাকে বলেছেন, আমি নিশ্চিত নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে চরম অনিশ্চয়তার তরঙ্গ-সংকুল জীবনে ঝাঁপ দিলাম। আমার সহকর্মীদের অনেকে রীতিমতো আমার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠিয়েছিলেন। কিন্তু গোলাম সারওয়ার কখনও আমাকে বলেননি- আবেদ, আপনি ভুল করছেন। একদিন হাসতে হাসতে শুধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।’

এত চমৎকারভাবে এই কথাটি তিনি সে সময় বলেছিলেন, যা আমাকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিল। পরে তিনি যখন নিজেই একটি পত্রিকার ভাবনা শুরু করলেন, তখন তিনি একদিন আমাকে বললেন, আমি কিন্তু আপনার মতো অনিশ্চয়তায় ঝাঁপ দিতে পারব না। তাই আমি পথে নেমেছি সবকিছু গোছগাছ করে। তিনি সেভাবেই নতুন পথে পা বাড়িয়েছেন এবং একজন সফল সম্পাদকও হয়েছেন। তার সেই সফলতা তাকে দিয়েছে সাংবাদিকতা জগতের বিস্ময়কর উচ্চতা।

তারপরও আজ একটি কথা বলতে ইচ্ছে করে, সাহিত্য ও শিল্পপ্রেমী গোলাম সারওয়ারের বিচরণ সাহিত্যের এই ক্ষেত্রে হতো, তাহলে আমরা তাকে কোথায় দেখতাম? আমার দৃঢ় ধারণা, গোলাম সারওয়ার সে ক্ষেত্রেও অনবদ্য কিছু সৃষ্টি আমাদের উপহার দিতে পারতেন।

সাংবাদিকতার যে প্রতিভা তা একসময় কালের করাল চক্রে প্রাচীন হয়। স্থায়িত্ব সেভাবে হয়তো থাকে না। কিন্তু সাহিত্যকর্ম থাকে। সাহিত্যের সৃজনশীলতাই সমকালীন জীবনকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপনে সক্ষম। সে জন্যই আমার সংশয়, কাকে আমি উচ্চাসনে বসাব- এক অবিকশিত সাহিত্য সম্ভাবনাকে, নাকি সমকালীন সাংবাদিকতার এক দিকপালকে।

বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান পিআইবি’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত

আবেদ খান :                                          সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ; চেয়ারম্যান, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)

About the author

নরসুন্দা ডটকম