লেখাটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় নরসুন্দা ডট কমের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল। কৃতজ্ঞতা- দৈনিক সমকাল।- সম্পাদক
শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে ছাত্র-তরুণরা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়। এ প্রজন্মেরই এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। অনেকে তাকে চেনেন ‘ন্যাপের মোজাফফর’ হিসেবে। কেউ কেউ বলেন, ‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর’। অর্থনীতি বিষয়ে মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু রাজনীতির প্রয়োজনে, বাঙালির এবং বিশেষভাবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে সে সময়ের এই আকর্ষণীয় পেশা ছেড়ে দিতে পেরেছেন অবলীলায়। ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের নিষ্ঠুুর দমননীতির মধ্যেও যখন ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে জড়িয়ে পড়েছি, তখন তার নাম শুনি। ক্রমে ঘনিষ্ঠ হই। তিনি তখন আত্মগোপনে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। তাকে পুলিশ-গোয়েন্দারা খুঁজছে হন্যে হয়ে। অতি বিশ্বস্ত কিছু ব্যক্তি ছাড়া তার সাক্ষাৎ পাওয়ার সুযোগ নেই। তার সময়ের যেসব রাজনীতিক গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের একটানা ৭-৮ বছর পর্যন্ত জেলে কাটাতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বায়ত্তশাসনের যে ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন, তা মোকাবেলায় আইয়ুব খান প্রচণ্ড দমননীতির পথ বেছে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির শত শত নেতাকর্মী তখন কারাগারে। ছাত্রনেতাদেরও ঠাঁই হয় চার দেয়ালের মাঝে। এমন কঠিন সময়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সংগোপনে শহর-বন্দর-গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন। মণি সিংহ, খোকা রায়, বারীন দত্ত, অনিল মুখার্জি, সুখেন্দু দস্তিদার, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হকসহ অনেকেই তখন হুলিয়া মাথায় নিয়ে জনগণের জন্য নিবেদিত। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে তারা নমস্য, কিংবদন্তিতুল্য।
বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দাবি হিসেবে ৬ দফা পেশ করার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নতুন মেরুকরণ দেখা যায়। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়েছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে। তিনি সে সময় আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তার সঙ্গে ভাসানীসহ অন্যদের প্রধান মতপার্থক্য প্রকাশ পায় দুটি মূল ইস্যুতে- স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি। ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার। ১৯৫৭ সালে মোজাফফর আহমদ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পার্লামেন্টে সোচ্চার হন, প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বললেন, ৯৮ পার্সেন্ট স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তান। মজার ব্যাপার, সেই আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ৬ দফা উত্থাপন করলেন, তখন ন্যাপের কেউ কেউ তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর কূটকৌশল আবিস্কার করতে থাকেন। তারা ৬ দফার বিরোধিতা শুরু করেন। তাদের এই কর্মকাণ্ড আরও জোরদার করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হক, অধ্যাপক আহসাবউদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ওপর থেকে হুলিয়া তুলে দেন। তারা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর থেকে একটানা ৮ বছর আত্মগোপনে ছিলেন। শোনা যায়, হুলিয়া তুলে নেওয়ার পেছনে ছিল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের রাজনৈতিক সমঝোতা। আইয়ুব খান ও তার সহযোগীরা বুঝতে পারছিলেন যে, ৬ দফা ব্যাপক সমর্থন লাভ করতে শুরু করেছে। বাঙালিরা শেখ মুজিবের পেছনে সমবেত হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা ৬ দফার বিরোধিতা করার জন্য ‘চীনপন্থি’ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন নেতাকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারই ফল ৪ নেতার ওপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার।
শোনা যায়, এ তালিকায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নাম ছিল না। তিনি ছিলেন ৬ দফার পক্ষে। তবে এর সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকের দাবি, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার কর্মসূচি যুক্ত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। আইয়ুব খান হিসাব করে দেখলেন, চারজন বামপন্থি নেতা হুলিয়ামুক্ত হয়ে যদি ৬ দফার বিরোধিতা শুরু করে, তাহলে গোপন রাজনৈতিক সমঝোতা প্রকাশ হয়ে যাবে। তাই তিনি মূল তালিকায় থাকা সুখেন্দু দস্তিদারের নামটি কেটে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নাম যুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি- মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হক ও অধ্যাপক আহসাবউদ্দিন আহমদ প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেমে ৬ দফার বিরোধিতা করতে থাকেন। অন্যদিকে মোজাফফর আহমদ তার সহকর্মীদের নিয়ে মওলানা ভাসানীর সঙ্গ ত্যাগ করে পৃথক ন্যাপ গঠন করেন, যা এক সময় মোজাফফর ন্যাপ হিসেবে পরিচিতি পায়। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
মোজাফফর আহমদ পাকিস্তান আমলে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলেন, মুসলিম লীগের হয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু দ্রুতই বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হন। পাকিস্তানের শুরুতে এ আদর্শের প্রতি অনুগত থেকেই আওয়ামী লীগে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে। সে সময়ে মওলানা ভাসানী ইউরোপে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন। মোজাফফর আহমদ ছিলেন তার সফরসঙ্গী। এ সময়ে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিদের ওপর চলছিল তীব্র দমননীতি। মওলানা ভাসানী ও তার সফরসঙ্গীরা দেশে ফিরতে পারছিলেন না। মোজাফফর আহমদ ভাসানীর সচিব হিসেবে এ সময়ে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে দু’জনের মধ্যে রাজনৈতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মওলানা ভাসানী ও তার অনুসারীরা আইয়ুব খানের প্রতি নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেন। তারা বিশেষভাবে ৬ দফার বিরোধিতা করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তারা ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’- এ পথ বেছে নেন; কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এ মতের বিরোধী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন ‘সীমান্ত গান্ধী’ হিসেবে পরিচিত খান আবদুল গাফফার খানের পুত্র খান আবদুল ওয়ালি খান। ১৯৬৯ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পেছনে এ দলের ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ। দলটি একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে থাকে, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে আইয়ুববিরোধী বৃহত্তর ঐক্যজোট গঠনে ভূমিকা রাখে। এ সময়ে মোজাফফর আহমদ ছিলেন ন্যাপ ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান প্রকাশ্য মুখপাত্র। তাকে গ্রেফতার করা হয়; কিন্তু আন্দোলনের চাপে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে মুক্ত হন। আমিও কয়েক বছর কারাগারে থেকে মুক্তি পাই। আমার বিরুদ্ধেও পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই আন্দোলনেই কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হয়, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে জনগণ এবং বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু হিসেবে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদসহ অনেক বামপন্থি নেতা আমার কাছে ছিলেন স্বপ্নলোকের নায়ক। পলাতক থেকেও কীভাবে মানুষের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখা যায়, কীভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, সে শিক্ষা পেয়েছি তার মতো আরও অনেকের কাছ থেকে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পাকিস্তানের লাহোর শহরে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য। সেখানে মোজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট অবসানে সব প্রদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের বিকল্প নেই।
আরো পড়তে পারেন….
বরেণ্য রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাকে আমরা পাই এমন এক নেতা হিসেবে, যার গ্রহণযোগ্যতা তখন দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে চলে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু নতুন পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে মোজাফফর আহমদের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে থাকেন। তিনি জাতীয় সরকার গঠনের দাবি করেছিলেন। এ দাবি মানা না হলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি সমর্থন করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সে সময়ের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে তিনি উদ্যোগী হন। মোজাফফর আহমদ মস্কো সফর করে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন প্রদানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তার এ প্রচেষ্টা যে সফল হয়েছিল, তা তো আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। বাংলাদেশের বামপন্থিরা যাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পারে, সে বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন এবং তার কয়েক হাজার সদস্যকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানকে আমরা এ আলোচনার সফল পরিণতি ধরে নিতে পারি। তাকে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখানেও তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ এবং মনোরঞ্জন ধরও এ পরিষদের সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি একযোগে কাজ করছে- এ পরিষদ গঠনের ফলে দেশ-বিদেশে সে বার্তা পৌঁছে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করে স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসার যে চক্রান্ত শুরু করে, তা নস্যাৎ করার জন্য মোজাফফর আহমদ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পাশে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সদস্যদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সমর্থন জোরদারের জন্য যে প্রতিনিধি দল যায়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোজাফফর আহমদ বরাবরই ছিলেন সম্মুখ সারিতে। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে যে ত্রিদলীয় গণঐক্যজোট গঠিত হয়, তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ সময়ে আমিও ন্যাপের নেতৃত্বে যুক্ত হয়ে পড়ি। মোজাফফর আহমদ সভাপতি এবং আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ন্যাপ সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে শোক মিছিল যায়, আমি ছিলাম তার অন্যতম সংগঠক। ১৯৭৯ সালে মোজাফফর আহমদ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আশির দশকে এইচএম এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ জোটের নেতৃত্ব একযোগে কাজ করে বাংলাদেশ থেকে সামরিক শাসন চিরতরে বিদায় করার জন্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান আমলের মতোই অনেক দুঃসময় এসেছে। কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কখনোই নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বিভিন্ন সময়ে সামরিক সরকার তাকে মন্ত্রিত্বের টোপ দিয়েছে। অন্যান্য সুবিধা দিতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন মেহনতি মানুষের স্বার্থে অবিচল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সর্বদা সক্রিয় থাকার পাশাপাশি তিনি বহুবিধ সামাজিক উদ্যোগেও শরিক ছিলেন। তার একটি বিশেষ অবদানের কথা আমি বলতে চাই- রাজধানীর অদূরে মদনপুর এলাকায় শ্রম-সাধনায় গড়ে তোলা হয় সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ। সেখানে রাজনৈতিক কর্মীরা সমাজতন্ত্রের কর্মী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছে। দেশপ্রেমের শিক্ষা পেয়েছে। দলমত নির্বিশেষে অনেকেই সেখানে গিয়েছেন এক অন্য ধরনের প্রতিষ্ঠানে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য।
মোজাফফর আহমদ নির্লোভ মানুষ ছিলেন। স্বৈরশাসকদের সঙ্গে আপস করতে জানতেন না। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছেন সর্বদা। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কুশী-লব, নায়ক। রাজনৈতিক অঙ্গনে কিংবদন্তি। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছেন এই যুক্তিতে- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল তার আজন্ম স্বপ্ন। এ জন্য কাজ করেছেন যৌবনকাল থেকেই। বঙ্গবন্ধুও তার যৌবনে স্বাধীনতার পথে চলার স্বপ্ন যে সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির কাছে ব্যক্ত করেছেন, মোজাফফর আহমদ ছিলেন তার অন্যতম। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তো তার পুরস্কার গ্রহণের কথা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। দীর্ঘ কর্মক্ষম জীবনে তার আরেকটি স্বপ্ন ছিল- শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি। এ জন্য কায়েম করতে হবে সমাজতন্ত্র। সে স্বপ্ন পূরণে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসবে- সে প্রত্যাশা রাখছি।
বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সভাপতি- ঐক্য ন্যাপ।