পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য সংবাদের ভিড়ে একটি সংবাদ আমার নজর কাড়ে। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান না, অর্থাৎ রাজনীতিতে আসতে রাজি নন। সাক্ষাৎকার নেওয়া সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি বলেছেন, এদেশের মানুষ আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, সেটা একজন এমপি হয়ে আমি নষ্ট করতে চাই না। প্রচলিত ব্যবস্থায় গা ভাসিয়ে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করা যখন মূখ্য হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজের কতিপয় শীর্ষ ব্যাক্তিদের কাছে, তখন তার এই ঘোষণা আমার কাছে ব্যাতিক্রম মনে হয়েছে, মনে হয়েছে তিনি অত্যান্ত সাহসি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তার সাথে সেই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির যে ধারা সেখানে একজন এমপি হয়ে কিছুই করার নেই। এমনকি ছোটখাটো একজন মন্ত্রী হয়েও কিছু করার থাকে না। দলের অনুগত হয়েই থাকতে হয়। যেমন: সোহেল তাজের মতো একজন ভালো মানুষও কিন্তু টিকতে পারলেন না।
তিনি বলেছেন, আমার কাছে মানুষের যেমন প্রত্যাশা, তেমনি আমিও মানুষের আশা-আকাঙ্খা ফুরণ করার মতো যদি পরিস্থিতি কখনো পাই, তখন ভেবে দেখবো। আমার নিজের জন্য কিছু দরকার নেই, আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি বেঁচে থাকার জন্য দুটো খেতে পারলেই হলো। মানুষের জন্য কাজ করার সেরকম কোনো সুযোগ যদি আসে, পার্টির প্রধানরা যদি কখনো বলেন, আপনাকে এটার দায়িত্ব নিতে হবে, তখন ভেবে দেখা যেতে পারে। এদেশের মানুষ আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, সেটা একজন এমপি হয়ে আমি নষ্ট করতে চাই না।
বাংলাদেশের রাজনীতির চলমান অবস্থা বুঝেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করি। এরও কিছুদিন আগে আমরা শুনেছি তিনি রাজনীতিতে নাম লেখাতে যাচ্ছেন। শুনা গিয়েছিল তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দিয়ে এমপি পদে নির্বাচন করবেন, এরপর শুনা গেল বিএনপি নয় বর্তমান সরকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকেই নির্বাচন করবেন তিনি। যখন জাতীয় নির্বাচন অতি নিকটে তখন সব জল্পনা- কল্পনাকে নাকোচ করে দিয়ে তিনি দেশবাসিকে জানিয়ে দিলেন- না, রাজনীতি নয় সামাজিক আন্দোলনের মধ্যেদিয়েই দেশবাসীর পাশে থাকতে চান তিনি। আমি তার এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই, অভিনন্দন জানাই। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।
যত জনপ্রিয় কিংবা বিশিষ্টি ব্যাক্তি হোন না কেন যখন কোনো ব্যাক্তি রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন তখনই তিনি নানাভাবে সমালোচিত হতে থাকেন। সম্প্রতি আমরা তুমুল জনপ্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মতুর্জা ও সাকিব আল হাসানের বেলায়ও তা দেখেছি। অথচ রাজনীতিতে আসছেন এই সংবাদ তারা নিজমুখে ঘোষণা করেননি, তার আগেই তাদের সমালোচনায় সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যম। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তাদের নির্বচনে কোনো বাধা নেই। তবু কেন এই সমালোচনা? তা অবশ্য আমাদের কারোই অজানা নয়। রাজনীতিতে না আসার ঘোষণা দিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন এবার এসবের বাইরে চলে গেলেন।
বসুন্ধরা, আঁখি মিলন, ভেজাচোখ, মাটির কসম, নীতিবান, সহযাত্রী, প্রেমপ্রতিজ্ঞা, গাড়িয়াল ভাই, বাঁচার লড়াই, খুনি আসামি, শাস্তি ও বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো এমন অসংখ্য সফল ছবির জনপ্রিয় নায়ক তিনি। এই অভিনয় দিয়েই তিনি একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা। এর সাথে এবছর রাষ্ট্রের সবোর্চ্চ সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ দেশীয় চলচিত্রের ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে আছে। বলা হয়ে থাকে এই সিনেমাটি তখন যে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ব্যাবসা করেছিল তা আজ পর্যন্ত কোনো সিনেমা ভাঙতে পারেনি। সারাবাংলায় তখন ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র জোয়ার চলছিল। কোনো কোনো দর্শক সিনেমাটি বিশ থেকে পঁচিশবার পর্যন্ত দেখেছেন। এমন ছবির সফল নায়ক এখন আর সিনেমায় অভিনয় করছেন না। তা নিয়ে অবশ্য তার খেদ আছে। চলচ্চিত্রের বর্তমান পরিস্থিতি তাকে কষ্ট দেয়। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে যেখানে কাটিয়ে দিয়েছেন চার দশকেরও বেশি সময়। সেই সিনেমা জগতের এমন হাল দেখে কষ্টতো হবেই।
এসবের মধ্যেই তিনি এখন তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই বা ‘নিসচা’ নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। নিরাপদ সড়কের দাবিতে মানুষকে সোচ্চার হতে, সচেতন করতে সারাদেশ সফর করছেন। নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ একাডেমি, যার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষে চালকদের লাইসেন্সসমেত গাড়ি চালাতে সহযোগিতা করছেন। তার স্ত্রী জাহানারা ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর থেকে তিনি এই সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রায় দুই যুগের ও বেশি সময় ধরে চলছে তার এই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন।
আন্দোলনে নেমে তাকে অনেক নিগ্রিহীত হতে হয়েছে, হয়েছেন নানা বাধার সম্মুখিন, তবুও কোনোকিছুই তাকে টলাতে পারেনি। ইতোমধ্যে দেশজুড়ে সংগঠনটির অসংখ্য শাখা গড়ে ওঠেছে। এতে আরো জোড়দার হয়েছে এই আন্দোলন। তার ড়োড় তৎপড়তায় সরকার ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করেছে। ২০১৭ সাল থেকে জাতীয়ভাবে এই দিবস পালন করা শুরু হয়। দিবসটির প্রথম প্রতিপাদ্য ছিল- ‘সাবধানে চালাবো গাড়ি, নিরাপদে ফিরবো বাড়ি’। এই আন্দোলনকে গতিশীল করতে ২০১৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘নিরাপদ নিউজ ডটকম’ নামের একটি অনলাইন পত্রিকা। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের ব্যানারে জনমত তৈরি করতে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও তিনি রাজপথে নেমেছেন, মানববন্ধন করেছেন।
সবশেষে বলতে চাই- শ্রদ্ধেয় ইলিয়াস কাঞ্চন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে আরো জোড়দার করার সময় এখনই। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু যখন আমাদের শান্তির ঘুম কেড়ে নিচ্ছে, আমরা কেউ না কেউ প্রতিদিন হচ্ছি স্বজনহারা। সন্তান হারাচ্ছে তার পিতাকে, স্ত্রী হারাচ্ছে তার স্বামীকে, ভাই হারাচ্ছে বোনকে, সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না! এমন সময়ে কি আর ঘরে বসে থাকা যায়?।
আমরা চাই, আপনার নেতৃত্বে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, আরো সফল হোক। যাত্রী থেকে চালক, যানবাহন মালিক থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র সবাই সচেতন হোক, হোক আরো দায়িত্বশীল। বীর মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের লড়াকু সৈনিক আপনি। আপনার নেতৃত্বেই সারাবাংলার সড়ক হয়ে উঠুক আরো আরো নিরাপদ। একটি নিদৃষ্ট এলাকার গুটিকয়েক মানুষের নেতা না হয়ে আপনি থাকুন আমাদের সবার হৃদয়ের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে। অভিনন্দন ও ধন্যবাদ বাংলা সিনেমার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
ফয়সাল আহমেদ: সাংবাদিক ও লেখক।