দেশ-বিদেশ

“সানি লিওন যা করেছেন, একজন মেয়ে হিসেবে আমি সেটা করলে কেউ মানবে না!”

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮

টানা বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতে তার নামই সবচেয়ে বেশি গুগল সার্চ করা হয়। পাশের দেশ বাংলাদেশেও তাই। তার বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিংস, সাক্ষাৎকার স্মার্টফোনের মারফত হাতে হাতে ঘোরে।অথচ ভারতে একজন শিল্পীর যে ন্যূনতম অধিকারটুকু পাওয়ার কথা, ভারতের সেই সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট তারকা ও সাবেক পর্নস্টার সানি লিওন বোধহয় সেটুকুও পাচ্ছেন না।

সামনের মাসে ব্যাঙ্গালোর শহরে তার প্রথম নাচের ‘লাইভ পারফরম্যান্স’ করার কথা, কিন্তু তাতে ভারতীয় সংস্কৃতি রসাতলে যাবে – এই যুক্তি দেখিয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে স্থানীয় কন্নড় গোষ্ঠীগুলি।

এর আগে গত বছরেও ব্যাঙ্গালোরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বাধার মুখে কর্নাটক সরকার সানি লিওনের অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছিল

শুধু তা-ই নয়, মাসকয়েক আগে তিনি যখন ‘করনজিৎ কাউর : দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব সানি লিওন’ নামে নিজের বায়োপিক রিলিজ করেছিলেন, তখনও সেখানে কাউর শব্দের ব্যবহার নিয়ে তীব্র আপত্তি জানায় নানা শিখ সংগঠন।

তাদের যুক্তি ছিল, ‘কাউর‘ শিখ সমাজের নারীদের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক একটি পদবী – এবং যিনি নিজের ধর্ম ত্যাগ করেছেন তার আর নিজের নামে কাউর ব্যবহার করার কোনও অধিকার নেই।

ফলে একটা জিনিস স্পষ্ট, পর্ন-তারকার অতীত পেছনে ফেলে সানি লিওন যতই নিজেকে বলিউডের একজন শিল্পী ও অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান না কেন – অনেকেই এখনও তাকে সেই পুরনো প্রিজম দিয়েই দেখতে চাইছেন।

ব্যাঙ্গালোরে যেমন ‘কর্নাটক রক্ষণ ভেদিকে’ নামে একটি কট্টরপন্থী সংগঠন অনেকদিন ধরেই সানি লিওনের প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।

টানা বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতে তার নামই সবচেয়ে বেশি গুগল সার্চ করা হয়।

এর আগে ২০১৮র ইংরেজি নতুন বছরের ঠিক আগে ব্যাঙ্গালোরে সানি লিওনের যে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল তা এদের বাধাতেই ভেস্তে যায়। এখন ৩রা নভেম্বর শহরে সানি লিওনের আবার যে প্রোগ্রাম করার কথা, তার বিরুদ্ধেও এখন এরা কর্মসূচী নিচ্ছেন।

কর্নাটক রক্ষণ ভেদিকে-র নেতা হরিশ বিবিসিকে বলছিলেন, “সানি লিওন যেদিন ভদ্রভাবে শাড়ি পরে পারফর্ম করবেন, তখন হয়তো আমরা সেটা মেনে নেওয়ার কথা ভাবতে পারি। কিন্তু ছোট ছোট স্কার্ট পরে নাচ-গান করে তিনি সংস্কৃতিকে উচ্ছন্নে পাঠাবেন, সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।”

এমন কী ওই সংগঠনের তরুণী সদস্যরাও মনে করছেন – ব্যাঙ্গালোরে এমনিতেই মেয়েরা নিরাপদ নন, এরপর শহরে যদি সানি লিওন এসে নাচগান করেন তাহলে নাকি নারী নিরাপত্তা আরও বিপন্ন হবে।

এক তরুণী যেমন বলছিলেন, “মানছি উনি একজন অভিনেত্রী, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যা খুশি করতে পারেন – কিছু বলার নেই। কিন্তু পাবলিক লাইফে সেটা হয় না। সানি লিওন যা করেছেন, একজন মেয়ে হিসেবে আমি সেটা করলে কেউ মানবে না!”

“সানি লিওনের ইতিহাস সবাই জানে। তিনি কিছুতেই কর্নাটক বা ভারতের সংস্কৃতির প্রতিনিধি হতে পারেন না” – এই জাতীয় কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে ব্যাঙ্গালোরে কান পাতলেই।

পাঞ্জাবের বিভিন্ন শিখ সংগঠন যখন তার বায়োপিকের ‘করনজিৎ কাউর’ নামকরণের বিরোধিতা করেছিল, তখনও তাদের যুক্তি ছিল সানি লিওন আসলে তাদের ধর্মেরই অবমাননা করেছেন।

অকালি দলের নেত্রী ও শিরোমণি গুরদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটির দু-দুবারের প্রেসিডেন্ট বিবি জাগির কাউরও তখন বলেছিলেন, “উনি জীবনে আগে কী করেছেন, তার ভূমিকা আগে কী ছিল সেটা আমি জানি না – জানার দরকারও নেই। কিন্তু তার এরকম একটা ছবি বানানোর আগে অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত ছিল শিখ ধর্মকে যাতে কোনওভাবে অপমান না-করা হয়!”

তবে আমেরিকা ও কানাডার অ্যাডাল্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক সময়ে সানি লিওনের ভূমিকার জন্যই যে তাকে ‘কাউর’ বলে মানতে শিখ সমাজের একটা অংশের আপত্তি, সেটা অবশ্য মোটেই গোপন ছিল না।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শমিতা সেন মনে করছেন, “আমার পছন্দ না-হলেই তোমাকে আঁকতে দেব না, বলতে দেব না – এই জাতীয় যে সার্বিক অসহিষ্ণুতার আবহ আজকের ভারতে গড়ে উঠেছে, এখানেও সেটারই প্রতিফলন ঘটছে বলে আমার ধারণা।”

“আর এক্ষেত্রে সানি লিওনকে পারফর্ম করতে দেব না কারণ তিনি পর্নস্টার ছিলেন, এই যুক্তিটাও ভীষণ হাস্যকর। কারণ আমাদের দেশে পর্ন তো এমনিতেই কম জনপ্রিয় নয়! আর ভারতে চারিত্রিক নৈতিকতার সংজ্ঞাই বা কী, যেখানে বিশ্বের সেক্স ইন্ডাস্ট্রির প্রধান উৎস কামসূত্রের জন্মই এদেশে!”, বলছিলেন অধ্যাপক সেন।

আরো পড়ুন…

আসছে “জান্নাত”

এবার ইন্ডিয়াতে আলোচনায় বাংলাদেশি মডেল নায়লা নাঈম

সেই উনিশ শতকে নটি বিনোদিনীর সময় থেকেই ভারতে থিয়েটার বা চলচ্চিত্র জগতের অভিনেত্রীরা যে ঠিক পর্ন ইন্ডাস্ট্রি না হোক – দেহপসারিনী বা বাঈজির মতো অনুরূপ পেশা থেকেই উঠে এসেছিলেন, সে কথাও তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

তবে এই যে তার অনুষ্ঠান করাতে বারবার বাধা আসছে, কিংবা বাবা-মার দেওয়া নাম ব্যবহারেও আপত্তি উঠছে – সানি লিওন নিজে অবশ্য তা নিয়ে নিজে খুব একটা ভাবিত নন বলেই দাবি করছেন।

গত মাসেই বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি ভারতের কিছু পাল্টাতে পেরেছি কি না জানি না, ভারত কিন্তু আমার অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। এটা দুনিয়ার সেই হাতে গোনা দেশগুলোর একটা, যেখানে আপনি যদি একটা স্বপ্ন নিয়ে আসেন তাহলে সেই স্বপ্নকে সত্যি করা সম্ভব।”

সাঁইত্রিশ বছর বয়সে এসে করণজিৎ কাউর ভোহরা ওরফে সানি লিওন হাজারো প্রতিকূলতার মুখেও ভারতে তার স্বপ্ন সত্যি করার সেই লড়াই এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।

“হ্যাঁ, ভারতে জার্নিটা খুব কঠিন, হয়তো খুব নির্মম ও মায়াদয়াহীন – সবই ঠিক। কিন্তু আমি তবুও বিশ্বাস করি ভারতে আপনি আপনার স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলতে পারেন” – বলছেন তিনি। সূত্র: 

About the author

নরসুন্দা ডটকম