চলতি বছর যারা নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছেন তাদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ইস্যুটি আবার সামনে চলে এসেছে।
শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ এবং ডেনিস মুকওয়েগে দুজনেই সংঘাতের সময় ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন।
মিস মুরাদ একজন ইরাকি ইয়াজিদি যাকে ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরা ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছিল। পরে তিনি ইয়াজিদিদের মুক্তির প্রতীকে পরিণত হন।
ডা. মুকওয়েগে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের একজন গাইনোকলজিস্ট।
তিনি এবং তার সহকর্মীরা মিলে হাজার হাজার ধর্ষিতা নারীর চিকিৎসা করেছেন।
অারো পড়ুন..
সানি লিওন : ১৮ বছর বয়সে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন
চলতি বছর ৩৩১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন দেয়া হয় এবং তাদের মধ্য থেকে নোবেল কমিটি এই দুজনকেই পুরষ্কারের জন্য বেছে নেয়।
নাদিয়া মুরাদ এবং ডেনিস মুকওয়েগেকে পুরষ্কার-বিজয়ী ঘোষণা করে নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রিস-অ্যান্ডারসেন বলেন, “ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাদের প্রচেষ্টার জন্য দু’জনকে এই পুরষ্কার দেয়া হয়েছে।”
নোবেল শান্তি পুরষ্কার ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি হিসেবে মনে করেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিন।
“এই পুরষ্কারের মাধ্যমে এই অপরাধ শুধু স্বীকৃতিই পাবে না,” তিনি বিবিসিকে বলেন, “এর মাধ্যমে এই ইস্যুটিতে সারা বিশ্বের নজর পড়বে এবং ধর্ষণের শিকার নারীদের বেদনা সবাই উপলব্ধি করতে পারবে।”
এই বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ এবং সর্ব-সম্প্রতি মিয়ানমারের মতো দেশে যারা আন্দোলন করছেন তারাও অনুপ্রাণিত হবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং দু’লক্ষেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব ধর্ষণের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের দাবি নিয়ে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
কিন্তু এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে কী সারা বিশ্বে সংঘাতের সময় ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার রোধে কোন আইন তৈরি সম্ভব হবে?
ড. জিয়াউদ্দিন মনে করছেন, সেটা হলেও যে কালই হবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
তবে নোবেল পুরষ্কারের মধ্য দিয়ে এবিষয়ে আন্দোলন আরও বেগবান হবে এবং বিশ্বের বিবেক নড়েচড়ে বসবে।
“যে অপরাধগুলো মামলার পর্যায়ে রয়েছে, বা যেগুলো নিয়ে মামলা হতে পরে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই সেসব অপরাধের যে একটা জেন্ডার আসপেক্ট (লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য) রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এখন প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই তা বিবেচনা করছে।”
যৌন-দাসী হিসেবে নাদিয়া মুরাদকে বিক্রি করা হয়
ইরাকে যুদ্ধ চলার সময় নাদিয়া মুরাদকে ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরা তিন মাস আটকে রাখে এবং যৌন-দাসী হিসেবে ব্যবহার করে।
এসময় তার ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয় এবং দাসী হিসেবে বেশক কয়েকবার তাকে বিক্রি করা হয়।
দু’হাজার চৌদ্দ সালের নভেম্বর মাসে আইএস-এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নাদিয়া মুরাদ ইয়াজিদি জনগণের মুক্তির আন্দোলনে সামিল হন।
তিনি মানব পাচারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। এবং ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে কঠোর শাস্তির দাবি জানাতে থাকেন।
বিবিসি ফারসি বিভাগের সাংবাদিক নাফিসা কোনাভার্দ ইসলামিক স্টেট-এর হাত থেকে মুক্তির কিছুদিন পর নাদিয়া মুরাদের সাথে দেখা করেন।
সেদিনের সেই সাক্ষাতের একটি ছবি তিনি টুইটারে পোস্ট করেন।
সেখানে সাক্ষাৎকারে তার পরিচয় প্রকাশ করা হবে কি না, তা জানতে চাইলে মিস মুরাদ বলেছিলেন: “না, আমি চাই সারা বিশ্ব দেখুক আমাদের কী হাল হয়েছে।”
নাদিয়া মুরাদ ২০১৬ সালে ভাকলাভ হাভেল মানবাধিকার পুরষ্কারও অর্জন করেন। পরের বছর তিনি মানব পাচারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত পদে মনোনীত হন।
রেপ সার্জন ডেনিস মুকওয়েগে ৩০,০০০ ধর্ষিতার সেবা করেছেন
ডেনিস মুকওয়েগে কয়েক দশক ধরে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ধর্ষিতা নারীদের সেবা দিয়ে আসছেন।
তিনি এবং তার সহকর্মীরা এপর্যন্ত ৩০,০০০ ধর্ষিতা নারীর চিকিৎসা করেছেন।
ধর্ষণের সময় একজন নারীর দেহে যেসব ক্ষত তৈরি হয় তার চিকিৎসার জন্য ডা. মুকওয়েগেকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
আরো পড়ুন…
নিজের বিরুদ্ধে আনা ধর্ষণের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
কেন সুন্দরী নারীদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে ইরাকে ?
নাদিয়া মুরাদ জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন :
ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় ছোট্ট গ্রাম কোচোতে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন নাদিয়া মুরাদ নামের এক তরুণী। দরিদ্র ওই গ্রামের মানুষের চাহিদা কম ছিল বলে সবাই সুখী ছিলেন। ওই দারিদ্র্যের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নাদিয়া।
কিন্তু ২০১৪ সালে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী (আইএস) ঢুকে পড়ে ওই গ্রামে। একদিন গ্রামের সবাইকে অস্ত্রের মুখে একটি স্কুলে ঢোকানো হয়। পুরুষদের আলাদা করে স্কুলের বাইরে দাঁড় করানো হয়। এর পরেই মুহুর্মুহু গুলিতে নাদিয়ার ছয় ভাইসহ পুরুষদের হত্যা করা হয়।
পুরুষদের হত্যা করার পর আইএস জঙ্গিরা নাদিয়া ও অন্য নারীদের একটি বাসে করে মসুল শহরে নিয়ে যায়।
সেখানে অল্প বয়সী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হয়।
বিক্রি হন ইয়াজিদি তরুণী নাদিয়াও। আইএসের যৌনদাসী হিসেবে বেশ কিছুদিন থাকার পর পালিয়ে আসেন তিনি।
ব্রিটিশ অনলাইন দ্য ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই এই লোমহর্ষক কাহিনি জানিয়েছেন নাদিয়া মুরাদ। তাঁর বয়স এখন ২৫ বছর। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ শিরোনামে নাদিয়ার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইয়ে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।আইএসের কাছ থেকে পালিয়ে আসার পর নাদিয়া মুরাদ জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন।