বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত (জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১-মৃত্যু ১৬ নভেম্বর ২০১২) সর্বৈবভাবে ছিলেন একজন কুশলী, কৃতবিদ, কর্মতৎপর, সৎ ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী। প্রায় এক যুগ আগে নিজের সহযাত্রী আত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার উপলব্ধির স্তরে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে, পরবর্তীকালে তিনি সর্ববাদী, সাত্ত্বিক সাধনায় নিবেদিত হন। তার ‘আলিঙ্গন’ ছবিতে এ ধরনের একটি চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল আমাদের।
অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সুভাষ দত্তের শিল্পভাবনার শর্ত ও মূল্যবোধ ছিল- জীবন-সংগ্রামে মুখর-তুখোড় তৎপরতা শেষে শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন, নিজের উপলব্ধির কাছে ফিরে আসা। পৈতৃক নিবাস বগুড়ার সারিয়াকান্দির ধুনটের হাটশের গ্রামে আর লেখাপড়ার হাতেখড়ি দিনাজপুরে মাতুলালয়ে, বড় হয়েছেন সেখানে। নিজে পড়াশোনার পাট মাঝপথে চুকিয়ে ‘ফিল্মের টানে’ সুদূর বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে ‘অনেক কিছু’ করার পর দেশে, সেই দিনাজপুরেই ফিরেছিলেন। ঢাকায় সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বাংলা-উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। অসম্ভব অনুসন্ধিৎসু ও সূক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সব সময় আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কিছু করার। জীবনকে যেমন দেখতেন তীক্ষষ্ট দৃষ্টিতে, তেমনি এর শিল্পিত রূপায়ণেও ভাবতেন বেশি। আর এর জন্য তার পড়াশোনা ও অধ্যবসায় শেষমেশ মেশে সেলুলয়েডের ফিতার ক্যানভাসে জীবনের নিত্যতাকে তুলে ধরার।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যখন পশ্চিমবঙ্গের সেরা সব বাংলা ছবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় নিরুদ্দেশ যাত্রী, এই ঢাকাতেও উর্দু ছবি নির্মাণের বন্যা বইতে শুরু করেছিল।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে রক্ত দিতে হচ্ছিল, স্বাধিকার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অয়োময় আকাঙ্ক্ষা যখন দানা বাঁধছিল; সেই সময়ে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবি নির্মাণ করে বাঙালির, বাংলা সংস্কৃতির, সৃজনশীলতার, মৌলিকত্বের মর্মমূলে যেন আত্মবিশ্বাসের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। সুতরাং সবাই নতুন চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, নায়িকা, নায়ক, প্রযোজক- এরা সবাই যেন এক কাতারে শামিল হলেন নতুন পথের, প্রত্যয়দীপ্ত নবযাত্রার অভিষেক ঘটাতে। সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প নেন ১৯৬২ সালের শেষ দিকে। পত্রিকায় সুতরাং বানানোর বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাবাজারের মেসে বসবাসকারী জনৈক সত্য সাহা সত্যই সাহস করে এসে সুরকার হতে চাইলেন। ‘রাশোমোন’ (১৯৫০) যেমন জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরো সাওয়ার (১৯১০-৯৮), ‘পথের পাঁচালী‘ (১৯৫৫) যেমন সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১-৯২), অমরত্বের স্বপ্ন জাগানিয়া ছবি সুতরাং (১৯৬৪) তেমনি সুভাষ দত্তের। কেননা এ ছবিতেই প্রথম এ দেশের চলচ্চিত্রে স্বপ্নদৃশ্য দেখা যায়। ছবির শেষে নায়ক-নায়িকার মিলন হয় না। বিয়োগান্ত পরিণতিও এ দেশীয় চলচ্চিত্রে প্রথম। ফ্রাঙ্কফুর্ট এশীয় চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ দ্বিতীয় পুরস্কারে বিজয়ী হয়েছিল। “পুরস্কার-টুরস্কার নয়, ‘সুতরাং’ আমার বড় আদরের সন্তান। বিপুল এক শিল্পনেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল ছবিটি নির্মাণের সময়। আমি নিঃসংকোচে শ্রম ও সাধ্য ঢেলেছি এতে। আমি মরণশীল সামান্য মানুষ। শিল্প মানুষকে অমরত্ব দেয়। আমি উচ্চাভিলাষী নই; তবে এটুকু বলতে পারি, আন্তরিক সৃষ্টি হিসেবে ‘সুতরাং’ বেঁচে থাকবে”- স্বগতোক্তি তার।
আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। দত্ত বাবুর ছোট বোন ঝর্ণা দত্ত (প্রয়াত) ও আমি যৌথভাবে একটি চিত্রনাট্য দাখিল করি। সেটি গৃহীত হয়, আমরা পুরস্কৃতও হই। দাদার পরিচালনায় সেটি সেলুলয়েডে বাগ্ধময় হয়ে উঠবে, এমন প্রত্যাশা তার ও আমাদের ছিল। আমাদের সে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেল। খুব কাছে থেকে দেখার এবং তার কিছু কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুবাদে এ কথা বলতে পারি, সুভাষ দত্ত একজন মহৎপ্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেন অন্ত ছিল না। আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বলা বাহুল্য, তিনিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল, সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। তার তিরোধান একটি যুগের সমাপ্তি, অপূরণীয় ক্ষতি দেশ ও জাতির, শিল্প জগতের এবং দর্শকনন্দিত বিনিয়োগবান্ধব সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণের।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। সূত্র: সমকাল।