যে কোন মৃত্যুই আমাকে তাড়িত করে।অবাক করে।কষ্ট দেয়। ভাবনাযুক্ত করে।মৃত্যুবারতা পেলে আমি ঘুমুতে পারি না।জেগে উঠতে পারি না।অলস ও অবশ হই। পাথর হই।শোকে ম্যুহমান হই।সারা রাত আমার ঘুম আসে না।দিনমান কোন কাজে হাত চলে না।
একদিন আমিও চলে যাব।যেমন চলে গেলেন আব্বা। যেভাবে চলে গেল আমার ছোট্টসোনাবোনেরা।প্রিয় নানুনানা।প্রিয় বন্ধু প্রিয় আত্মীয়।চেনাজানা মুখ।যাঁকে ছাড়া আমার একদমই চলবে না, যাঁকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না, সবকিছু শুন্য-শুন্য লাগে; সময়ের বিবর্তনে তাঁকে ছেড়েও থাকতে হয় আমার।থাকতে হচ্ছে। অথচ এমন কথা ছিল না।আমিও যদি যাই চলে, প্রিয়জন আত্মিক বাঁধন ছেড়ে, জানি আমাকে ছেড়েও সবাই ভালো থাকবে।হাসবে-কাঁদবে।আনন্দে আত্মহারা হবে। বেদনায় লীন হবে নীল আকাশে।জানলায় বৃষ্টিমুখরতায় চোখ ভেসে যাবে জলে।তবুও থেমে থাকবে না জীবন। আসা-যাওয়ার এই দোলাচলে ‘তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে…’
লাকী ভাইয়ের সাথে খুব কমই দেখা হয়েছে।আমি যখন ঢাকায় থাকি, একযুগ হয়, তখনই দেখা হয়েছে তাঁর সাথে। নিভৃতচারী ছিলেন।অনুষ্ঠান-উৎসবে খুব কমই যেতেন। আড়ালচারিতায় ব্যুদ হয়ে থাকতেন।প্রচার বিমুখ ছিলেন। তবে সবসময়ই ছিলেন কাজের ভেতর দিয়ে।’সুরের বাণীর মালা দিয়ে’ অনন্ত শুণ্যতাকে ছুঁইয়াছিলেন।’বেদনা মধুর হয়ে যায়’ তাঁর সৃষ্টির পরশে।আমার কবিতাকে জানতেন তিনি।বলতেন গীতিকবিতা।গান লেখায় তাগাদা দিতেন। বেশকিছু লেখাও চেয়েছিলেন।যা তাঁকে ছুঁয়ে যায়, নেবেন। সুরারোপ করবেন।যদি পছন্দ না হয়, মেজাজে না আসে, হাতে না আসে, ফেলে রাখবেন।প্রত্যাশা করা যাবে না। তাগাদা দেয়া যাবে না।যদি কিছু হয় অনবদ্য, নিজের থেকেই ডাকবেন।তাঁকে শুনে আমি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হতো বুঝি কিছুই হয়নি।যদি কখনও কিছু ভালো লিরিক আসে হাতে, দিয়ে দেব। যদি কিছু হয়, হবে।না হলে নাইবা হ’ল।আমার আর যাওয়া হয়নি।কিছু লিরিক তাঁর হাতে দিয়ে বলা হয়নি, গুরু যদি কখনো ইচ্ছে হয়, সুর করার, করবেন।ইচ্ছে না হলে করবেন না।
আশি দশকের হলেও তিনি শুণ্য দশকে এসে সমান জনপ্রিয় ছিলেন।রুচিঋদ্ধ শ্রোতা ও সংগীতবোদ্ধাগণের কাছে।চিন্তায় চেতনায় ব্যক্তিত্বে ছিলেন আধুনিক ও উত্তরাধুনিক।সুরস্রষ্টা হিসেবে তাঁর তুলনা মেলা ভার। তিনি ছিলেন আজ ও আগামির ধারক।দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। কণ্ঠেও একধরণের মাদকতা লক্ষ্যনীয়।বেশ টানে। মনে হতো যে বাণীকে প্রাণসঞ্চার করেছেন অপার বেদনাপ্লুত করে, সে বাণী তাঁর কণ্ঠেই মাধুর্যমুগ্ধচারিতা পেত বড়। ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না, ফেরারি পাখিরা কূলায় ফেরে না…’ বা ‘এই নীল মণিহার…’ ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে, রাতের নির্জনে…’ ‘আগে যদি জানতাম, মন ফিরে আর চাইতাম না….’ ‘ভালোবেসে চলে যেও না…’ ‘ মামুনিয়া…’ সহ অগণিত কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা।
২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা যান প্রিয় লাকী আখন্দ। আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ঢাকাস্থ মিডফোর্ড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৫৬ সালের ১৮ জুন জন্ম নেয়া এই শিল্পী অগণিত গানের সুরস্রষ্টা।এইচ এমভি পাকিস্থান, এইচ এমভি ভারত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বাংলাদেশ বেতারে সংগীত পরিচালক হিসেবে উচ্চমান সমুন্নতি পান।তাঁর কাজ তাঁকে অমর করে রাখবে।কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।