সোশ্যাল মিডিয়া

মুহাম্মদ : মহানবী (সঃ) এর জীবনী নিয়ে সৈয়দ কামরুল হাসান

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ২৪, ২০২০
মুহাম্মদ

সৈয়দ কামরুল হাসান : আমি গত রাতে পড়ে শেষ করলাম যুক্তরাজ্য নিবাসী ধর্ম ও দর্শনের অধ্যাপক Karen Armstrong- এর “Muhammad: A Biography of the Prophet” মহানবী (সঃ)- এর জীবনী ভিত্তিক শওকত হোসেন – কৃত অনুবাদঃ মুহাম্মদ ( মহানবী (সঃ)- এর জীবনী ) । অনুবাদ সম্পর্কে বিশেষ বলার নেই, তবে অনুবাদক যথেষ্ট খেটে খুটে কাজটি করেছেন- সে-কথা বলা যায় । Karen Armstrong বইটি লিখেছেন ১৯৯১ সালে

পরে ২০০৬ সালে আরও একটি বই রচনা করেছেন তিনিঃ “Muhammad : A Prophet for our Time”, যা আজো আমার নাগালের বাইরে ।

বাঙ্গালী মুসলমান হিসাবে ইসলাম ও নবীজী আমাদের খুব কাছের ও খুবই ঘরোয়া । তাঁর জীবনী জানতে গিয়ে প্রথম পড়ি কবি গোলাম মুস্তাফার “বিশ্ব নবী”, তারপর হাতে পাই মাওলানা আকরাম খাঁর  “মোস্তফা চরিত”। আর একটু বড় হলে – Syed Amir Ali- র  “The Spirit of Islam” ; এ ছাড়াও খোঁজ – খবরে আসে কাজী নজরুল ইসলামের  “মরু ভাস্কর” এর কথাও।

আরও বড় হয়েছি যখন, যখন কিনা পারিবারিক গণ্ডী পেরিয়েছি আর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে নাম লিখিয়েছি – তখন নানদিকে কৌতুহলের ডাল পালা ছড়িয়েছে – সেই সাথে জেগেছে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা; বেড়ে গেছে তৃষ্ণা শতগুনে। আর তখন ইসলাম ও নবীজী সম্পর্কে আরও জানা ও বোঝার সুযোগ ঘটে । এবার খোঁজ পাই মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশাম বিরচিত জীবনীর। এগুলো নবীজী’র মৃত্যুবরণ করার পর খুব কাছাকাছি সময়ে রচিত এবং প্রচুর দুর্লভ ও প্রামাণিক দলিল ও সাক্ষ্যে ভরপুর। পরবর্তীতে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যে যে হাজার হাজার জীবনী রচিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে – সেগুলি এই প্রাচীন জীবনী গুলো থেকে প্রচুর তথ্য- উপাত্ত গ্রহণ করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মাদ (সঃ) কোন পৌরাণিক চরিত্র ছিলেন না – তিনি অদূর ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক চরিত্র- আর দশ জনের মতই তিনি ছিলেন একজন “মরণশীল” মানুষ ।

আমাদের এখানে মুহাম্মাদ (সঃ) -এর জীবনী আলোচনা ক্রমান্বয়ে আমার কাছে এতটাই একদেশদর্শী, অন্ধ ও ভাবাবেগ দুষ্ট মনে হতে শুরু করে যে এই যুগ স্রষ্টা মহাপুরুষ আমার কাছে প্রকৃত পক্ষে বাস্তবের পরিবর্তে এক কাল্পনিক ও পৌরাণিক পুরুষ হিসাবে ধরা দিতে শুরু করে ।

আরও পড়তে পারেন সৈয়দ কামরুল হাসান এর লেখা…

ইতালী থেকে বৃটেনবাসীর উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

খালেদ হামিদী’র আকব্জিআঙুল নদীকূল নিয়ে লিখেছেন-সৈয়দ কামরুল হাসান

জলেশ্বরী যাত্রার আগে-সৈয়দ কামরুল হাসান

আমার যুক্তি ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মন তাই স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লেখকদের আলোচনা ও বিশ্লেষণের দিকে মোড় ফেরায়। এই সময় আমি মহানবী ও ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে রাহুল সাং ক্রিত্তায়ন ও এম এন রায়ের দুটি চটি গ্রন্থ পড়ি। অল্পকালের মধ্যেই ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে এবিষয়ে সেরা ও প্রবীণ গবেষক ও লেখক উইলিয়াম মুইর-এর মুহাম্মাদ (সঃ) সংক্রান্ত জীবনী গ্রন্থঃ “Life of Mahomet” – আমার দখলে আসে। সাড়ে ছয়শ পৃষ্ঠার বইটি ১৮৭৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত। তার পর বইটির বহু সংস্করণ বেরিয়েছে। এই বইটিকে এবিষয়ে গভীরভাবে যারা পাঠ করতে চান, তাদের জন্য একটি আকর গ্রন্থ বলতে পারি। প্রায় দেড়শ বছর আগে রচিত বইটি পাঠে একটা অসুবিধা হলো এর ইংরেজি ভাষাটা খুবই সাবেকী বলে আমাদের মত পাঠকদের জন্য বেশ খানিকটা দুরুহ ; যখন কিনা কোন কোন বাক্য শেষ হতে এমনকি একটি আস্ত প্যারাগ্রাফ পর্যন্ত খরচ হয়েছে। এই অবস্থায় ২০১৩ সালে প্রকাশিত সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ইহুদি লেখিকা – Leseley Hazleton- এর “The First Muslim : The story of Muhammad” বইটি আমার হাতে আসে। বলতে গেলে এই বইটির আলোচনা ও মূল্যায়ন আমার কাছে অনেক বাস্তবসম্মত ও যুক্তি গ্রাহ্য মনে হয়েছে (দু এক জায়গায় কারুর না কারুর আপত্তি থাকলেও থাকতে পারে )। কাছাকাছি সময়ে ইরানে নিষিদ্ধ – আলী দস্তির “23 Years: A Study of Prophetic Career of Mohammad” পড়ার সুযোগ ঘটে। এগুলি যে কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও স্বচ্ছ ও ইতিহাস নির্ভর তথ্য ও যুক্তি যোগাবে

Karen Armstrong -এর এই অনুদিত বইটি এই ধারার অনুবর্তী আরও একটি চমৎকার বই। একদা রোমান ক্যাথলিক এই লেখক ও অধ্যাপক ইসলাম ও নবীজী সম্পর্কে তাঁর গবেষণা ও বিশ্লেষণ যে অব্যাহত রেখেছেন তাঁর প্রমাণ ২০০৬ সালে প্রকাশিতঃ “Muhammad : A prophet for our time” বইটিও ।

আলোচ্য অনুদিত বইটিতে নবীজীর জীবন -কে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে আর্মস্ট্রং দেখবার চেষ্টা করেছেন বহুল বিতর্কিত স্যাটানিক ভার্সেস – এ বর্ণিত ইসলাম ও নবীজীর সাথে প্রকৃত ও ঐতিহাসিক সত্যের কতখানি তফাৎ ! খুব স্বাভাবিক যে , ভিন্ন ধর্ম অনুসারী হওয়াতে তার ক্ষেত্রে ভিন্ন কোন পক্ষপাত বা তাগিদ কাজ করেনি , ইতিহাসের নিক্তিতে মেপে যে টুকু সত্য পাওয়া গেছে সেটুকুই তিনি তুলে ধরেছেন, আবেগাক্রান্ত হওয়ার দায় ছিলো না তাঁর ।

খুব কাকতালীয় যে একই সময়ে আমি পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদটিও (মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান-অনুদিত) পাঠ করছিলাম , এবং Karen Armstrong -এর “মুহাম্মাদ” বইটিতে ব্যবহৃত কোরআনের আয়াতগুলির অনুবাদও অনুবাদক ওই মুহাম্মদ হাবীবুর রহমানের অনুদিত কোরআন শরীফ থেকে নিয়েছিলেন। এটা ঠিক যে অসাধারণ গ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরিফ যা অসম্ভব সুরেলা ও কাব্যিকতার মাধুর্যে পূর্ণ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল বাংলায় তার কতখানি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব – সে প্রশ্ন থাকবে। অনুরুপে ইংরেজি ভাষায় রচিত আর্মস্ট্রং – এর বইটি অনুবাদে কতখানি অর্থবহ হয়েছে – সে প্রশ্নও উঠতে পারে। প্রত্যেক অনুবাদের ক্ষেত্রে এ- সীমাবদ্ধতা সত্য।

তবু শওকত হুসেনের অনুবাদ আমার ভালই লেগেছে। বেশ ঝরঝরে ও প্রাঞ্জল। পাঠক বইটি পাঠে উৎসাহী হবেন যদি দু একটা স্তবকের নমুনা এখানে তুলে দেই , আবার এ থেকে আর্মস্ট্রং এর রচনা ও বিশ্লেষণ রীতি সম্পর্কেও ধারণা পাবেন।

অনুদিত স্তবকের নমুনাঃ
—————————–

১। আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী  “সায়িইদ” হওয়ার পরেও মুহাম্মাদ (সঃ) খুব সহজ ও মিতাচারী জীবন কাটিয়েছেন। বিলাসিতাকে তিনি ঘৃণা করতেন এবং প্রায়ই দেখা যেত তাঁর খাওয়ার মত কিছু নেই। তাঁর কখনও এক সেটের বেশি পোশাক থাকতো না, সঙ্গীরা তাঁকে উৎসবের পোশাক পরার অনুরোধ জানালেও সবসময়ই প্রত্যাখ্যান করেছেন, অধিকাংশ মানুষের পরিধেয় ভারী কর্কশ কাপড়ই বেছে নিতেন। উপহার সামগ্রী পেলে তা গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং জেসাসের মত তিনি বলতেন, দরিদ্ররা ধনীদের আগে বেহেশতে প্রবেশ করবে। এটা দুর্ঘটনা নয় যে, প্রথম যারা তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেছে তাদের ভিতর অনেকেই ছিল মক্কার দুস্থ মানুষঃ দাস এবং নারী উভয়ই স্বীকার করেছে যে, এই ধর্ম তাদের আশার বাণী শুনিয়েছে।

ইসলাম আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলে কুরাইশদের দরিদ্র সাধারণ নব দীক্ষিতরাই পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত হয়েছিল, উচ্চ শ্রেণীর ধনী মুসলিমরা নয়। (পৃষ্ঠা – ১০৭ )

২। প্রকৃতপক্ষে আপন আচরণের ভেতর দিয়ে মুহাম্মাদ ( সঃ ) ভ্রাতৃত্ব বোধের একটা আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। শত্রুদের কাছে ক্রমবর্ধমান হারে ভীতিকর হয়ে উঠা মানুষটিকে “উম্মা” গভীরভাবে ভালোবাসতো, লাগাতার বিপদের মুখোমুখি থাকা সত্ত্বেও সেটা অত্যন্ত সুখী একটা গোষ্ঠী ছিল বলেই বিশ্বাস জন্মে। মুহাম্মাদ (সঃ) নিজের সঙ্গে অন্যান্য মুসলিমদের আনুষ্ঠানিকতার দূরত্ব সৃষ্টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি আড়ম্বরপূর্ণ সম্ভাষণ ঘৃণা করতেন, প্রায়ই মসজিদের মেঝেতে নির্বিকার ভাবে বসে পড়তেন এবং তাঁর অগ্রাধিকার থাকতো সমাজের দরিদ্রতম সদস্যদের প্রতি। শিশুরা বিশেষ করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো। সারাক্ষণ তিনি তাদের কোলে তুলে নিয়ে আলিঙ্গন করতেন, চুমু খেতেন। যখন কোন অভিযানে বাইরে যেতেন ফেরার সময় উম্মার শিশুদের জন্য তাঁর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হওয়া রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো এবং তারা পয়গম্বরকে বিজয় মিছিল করে মরূদ্যানে নিয়ে আসত। শুক্রবারের প্রাথনার সময় মসজিদের অভ্যন্তরে কোন শিশুর কান্নার আওয়াজ পেলে প্রায় সবসময়ই প্রাথনার সময় সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেন। শিশুর মায়ের কষ্টের কথা ভাবতেও পারতেন না তিনি ।

শত শত বছর ধরে পশ্চিমে আমরা মুহাম্মাদকে (সঃ) গম্ভীর, নিষ্ঠুর যোদ্ধা এবং নির্মম রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে দেখতে চাই। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়াবান ও সংবেদনশীল। যেমন, উদাহনণস্বরুপ বলা যায় , তিনি জীব জানোয়ারকে ভালোবাসতেন, যদি দেখতেন একটা বিড়াল তাঁর চাদরের উপর ঘুমাচ্ছে, ওটাকে বিরক্ত করা কল্পনাতেও আসতো না তাঁর । বলা হয়ে থাকে যে, জীব জানোয়ারের প্রতি আচরন থেকে কোন সমাজের রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। সকল ধর্মই জীবজগতের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা গড়ে তুলতে উৎসাহ দেয়, এবং মুহাম্মাদ (সঃ) মুসলিমদের এটা শেখাতে চেয়েছিলেন। (পৃষ্ঠাঃ ২৬৭-২৬৮) ।

৩। স্বামী হিসাবে মুহাম্মাদ (সঃ) ছিলেন আন্তরিক – আয়েশার প্রতি তিনি তাঁর বাবার চেয়ে বেশি স্নেহশীল ছিলেন। তিনি স্ত্রীদের সাদামাটা জীবন যাপন করতে বলেছিলেন বটে কিন্তু আয়েশা আমাদের জানাচ্ছেন যে, মুহাম্মাদ (সঃ) সবসময় ঘরকন্যার কাজে তাঁদের সাহায্য করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেনঃ কাপড় সেলাই ও ধোয়ার কাজ, জুতো মেরামত আর ছাগলের দেখাশোনা -সব। মুসলিমরা যাতে নারীদের প্রতি আরও সম্মান প্রদর্শনের অভ্যাস রপ্ত করে তিনি সেই শিক্ষাই দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। (পৃষ্ঠা – ২৭৭) ।

বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার “সন্দেশ” প্রকাশনী। পাঠক সংগ্রহ করে এই করোনা কালে পড়ে নিতে পারেন। মনে রাখুন জীবন খুব সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত ক্ষীয়মাণ!

নোট : লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।

        সৈয়দ কামরুল হাসান: লেখক, গল্পকার।

About the author

নরসুন্দা ডটকম