মিডিয়াতে রিপোর্টিং করতে করতেই শেষে কিনা বইও লিখে ফেললাম। বইয়ের সঙ্গে লেখার সম্পর্কটি নিবিড় হলেও এনিয়ে আমার কোন পরিকল্পনা ছিল না। যদিও আজ থেকে দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছর ধরে লেখা-লেখির সাথেই আছি। তবে বই লিখবো, আমার ‘স্মৃতির আলোয় কিশোরগঞ্জ’, গ্রন্থটি প্রকাশের আগে তেমন করে কখনো ভাবা হয়নি।
সংবাদকর্মী হিসেবে সব সময়ই লিখতে হয়। লেখা-লেখির পেশাই এটা। কোন ঘটনা এলাকায় সংঘটিত হলে সংবাদকর্মী হিসেবে পত্রিকা বা টেলিভিশনে খবরটি পাঠাতে হলে লেখা-লেখি করতে হয়। তাছাড়া সমসাময়িক নানা বিষয়ের উপর সংবাদকর্মীকে নিবন্ধ তৈরিতে পড়া ও লেখা তার জন্য অপরিহার্য বিষয়। সেই সুবাদে দীর্ঘ দিন ধরেই আমাকে এ কাজটি করতে হয়েছে।
একজন সংবাদকর্মীর লেখা-লেখির গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। এজন্যে তাকে যথেষ্ট পরিশ্রমও করতে হয়। কারণ পড়াশোনা ছাড়া পারদর্শী সংবাদকর্মী হওয়া যায় না। তবে বই প্রকাশের বিষয়টি ভিন্ন মাত্রার। তাই এর আবেদনও অন্য রকম। বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন,‘আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন কলমের মাধ্যমে। আর কলমের আশ্রয় পুস্তক’। সন্তোষ্টিটা সেখানেই।
মনে পড়ে ছাত্র জীবনেও লেখা-লেখি করেছি। বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা বন্ধুরা মিলে সাময়িকী প্রকাশ করেছি। এসব সাময়িকীতে যখন কবিতা বা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, তখন কী যে আনন্দ লাগতো এখনো মনে হলে শিহরণ জাগে। কৈশোর ও যুব বয়সের ওইসব কাজের মাঝে প্রজাপতিছন্দ অনুভব করেছি এবং কাজের শেষে হরিণি চপলতায় বার বার চঞ্চল হয়েছি।
আমাদেরকে শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকেই এসব সৃজনশীল কাজে বেশ উৎসাহ জোগাতেন। তাঁদের সামান্যতম উৎসাহ আমাদের তখন দারুনভাবে উজ্জীবিত করতো। আমার পরিবারের পরিবেশটিও এর সহায়ক ছিল। কারণ আমাদের একটা লাইব্রেরি থাকায় বই ও কাগজের কাছা-কাছি ছিলাম শৈশব থেকেই। ফলে লেখা-লেখির সাথে আমার একটা মনস্তাত্বিক সংযোগ গড়ে ওঠেছিল তখন থেকেই। তাছাড়া বাবা-মা’র স্নেহ আনুকল্য আমার জন্য ছিল বাড়তি সুবিধা। স্কুল ও কলেজ জীবনে বহু সাময়িকী প্রকাশ করেছি। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’,‘ রবীন্দ্র জয়ন্তি’ও ‘নজরুল জয়ন্তি’ উপলক্ষে আমরা এসব সাময়িকী প্রকাশ করতাম। বিভিন্ন সংগঠনের নামে অথবা বন্ধুরা ক’জন সংঘবদ্ধ হয়েই শুরু করতাম সাময়িকী প্রকাশনার কাজ। এজন্যে নিজেরা কিছু অর্থ দিয়ে ও বেশিরভাগ অর্থই আমরা চাঁদা তুলে সংগ্রহ করতাম। আজকের দিনের মত ওই সময় আধুনিক কোন ছাপাখানা ছিল না। ট্রেডল মেশিনে পায়ে চেপে ছাপার কাজ করা হতো এবং সীসার অক্ষর গুলো কম্পোজিটাররা কাঠের তৈরি ছোট ছোট খোপ থেকে একটি একটি করে তুলে শব্দ ও বাক্য তৈরি করেই তবে মুদ্রণের কাজটি করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ট্রেডল মেশিন ছিল। অফসেট মেশিন চালু হলো এইতো সেদিনের কথা।
কৈশোর বয়স থেকে সেই যে লেখা-লেখি শুরু করেছিলাম আজো লেখা নিয়েই আছি। সত্তরের দশকে সাংবাদিকতার পেশায় প্রবেশ করি। প্রথমটায় অনেকটা শখের বসেই শুরু। তখন প্রখ্যাত লোক ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও গবেষক মোহাম্মদ সাইদুর ভাই’র সাথে সাথে ঘুরে বেড়ানোর শখে পেয়েছিল আমাকে। আজ পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুর আবার অন্য একদিন হয়তো করিমগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি। এক সপ্তাহ পরে আবার হয়তো বাজিতপুর। তাঁর সাথে চারণের মত ঘুরতে ঘুরতেই সাংবাদিকতায় আমার প্রবেশ ঘটেছিল। সাইদুর ভাই যখন ‘পূর্বদেশ’ এবং ‘দৈনিক বাংলায় ’রিপোর্ট করেন তখন প্রায়ই গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি তাঁর সঙ্গি হতাম।
শেকড়-সন্ধানী লোক-ঐতিহ্য সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর ছিলেন আমার সাংবাদিকতা জীবনের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। গুরুদয়াল কলেজের বাংলার শিক্ষক জিয়াউদ্দীন স্যার ছিলেন আমাদের অভিভাবক। উভয়ের আনুকূল্য ও আগ্রহই আমাকে এ পথে নিয়ে এসেছে।
কলেজ জীবন হতেই আমি সংস্কৃতি জগতের সাথেও জড়িয়ে পড়েছিলাম। এর অন্যতম কারণ হলো আমার বড় ভাই এম এ আজিজ ছিলেন তখন আর্টস কাউন্সিলের (বর্তমান জেলা শিল্পকলা একাডেমি) কর্মকর্তা। সেই সুবাদে বড় ভাইয়ের উৎসাহে কলেজের ছাত্র থাকাকালীনই আমি আর্টস কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ পেতাম। ফলে সংস্কৃতিচর্চার প্রতি অনুরাগ আমার হৃদয়ে ছাত্রাবস্থায়ই সঞ্চারিত হয়েছিল। সে সময় আর্টস কাউন্সিলের মঞ্চে মঞ্চায়িত নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদি আমি দেখে অবাক ও মুগ্ধ হয়েছি। সে সময়কার আয়োজিত নানা সাহিত্য সভায় বিজ্ঞজনদের বক্তৃতাও আমি শুনেছি। এতে আমাদের কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তানদের কথাও উঠে আসতো।
র্যাংলার আনন্দ মোহন বোসু, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায়, ড. নীহার রঞ্জন রায়, কেদারনাথ মজুমদার, ড. এম.এ.গণি, নিরোদ সি চৌধুরী, কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ, কথাসাহিত্যিক রাহাত খানসহ অনেকের সাফল্যের কথা শুনে উজ্জীবিত বোধ করেছি। এসব আনুষ্ঠানমালা আমার মনোজগতকে ক্রমেই বিকশিত ও সমৃদ্ধ করেছে। আমি দেখে দেখে বুঝতে শিখেছি যে, সাহিত্য-সংস্কৃতি হচ্ছে আনন্দদায়ক এবং সভ্যতার চাবিকাঠি। তখন থেকেই আমার মধ্যেও সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার প্রতি অনুরাগ জন্মাতে শুরু করেছিল। আমার চার পাশের যা কিছু সুন্দর সেই সুন্দরকে আরো সুন্দর করে দেখবার ও সাজাবার একটা বাসনা আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল।
গুণীজনেরা বলেন, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের দৃষ্টির বৈভব ভিন্নতর। সাধারণের দেখা ও কবি-লেখকদের দেখার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমি দেখছি, আপনি দেখছেন এবং দূরের কেউ হয়তো দেখছেন। কিন্তু কবি ও সাহিত্যিক যখন দেখেন তখন তিনি দেখার সাথে অনুভবও করেন। তাঁর দৃষ্টির মধ্যে কোন কোন বস্তু সত্যিকারের অনুভূতি নিয়ে জাগ্রত হয় এবং তখন তিনি তাঁর দৃষ্টির বৈভব দিয়েই বিষয়টিকে অবলোকন করেন। এভাবেই সাহিত্য- কবিতা ও শিল্পকে আবিস্কার করতে হয়। এই আবিস্কার একদিনে সম্ভব হয় না এবং এমনি এমনি ঘটে না। যেমন আমাদের চোখ আছে অমরা দেখি, কিন্তু জন্মগতভাবেই আমরা দৃষ্টিকে পাই না। যেমন জন্মগতভাবেই আমরা কথা বলতে অভ্যস্থ নই। জন্মের পর একটি শিশু দেখে দেখে মাকে চিনে এবং মায়ের সাথে অন্যের পার্থক্য বুঝতে শেখে। আবার ভাষার অধিকার নিয়ে শিশুর জন্ম হলেও সে বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে কথা বলতে শেখে। অবশ্যই এর আগে নয়।
আমি যখন কলেজের ছাত্র তখন আমি দেয়াল পত্রিকা বের করতাম এবং সুন্দর হস্তাক্ষরে কবিতা, গল্প লিখে বোর্ডের মধ্যে সাঁটিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে বৃক্ষতলে প্রদর্শনের জন্য টানিয়ে রাখতাম। এমনকি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করতাম। বড়দের দেখিয়ে তৃপ্তি লাভ ও ছোটদের দেখিয়ে গর্বিত বোধ করতাম। এতসব করতাম অনুভবের তাগিদ থেকে এবং ভাল লাগার আনন্দ থেকেই। সাহিত্য-সংস্কৃতির কাছা-কাছি থাকার কারণে এস্বভাবটা আমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। আমি পারি কি না পারি সৃজনশীল কিছু একটা করার অভ্যাস আমার মধ্যে ছোটকাল থেকেই গড়ে উঠেছিল। আমি এতে আনন্দ পেতাম।
এই যে আনন্দের বিষয়টা সেটাও জনে জনে তারতম্য হয়। আপনি কি করছেন তার চাইতে আপনি কি করে আনন্দ লাভ করেন সেটাই হলো আসল বিষয়। এটাই তার বড় পরিচয়, প্রকৃত সত্তা। মানুষ ও পশুর মাঝে পার্থক্য হচ্ছে পশু চার পায়ে হাটে। তাদের দৃষ্টি নিন্মমুখি। তারা নিজেকে ছাড়া অন্যের জন্য ভাবতে পারে না। অন্যদিকে মানুষ দু’পায়ে হাটে। তার দৃষ্টি উর্দ্ধমুখি। মানুষ নিজের জন্য যেমন ভাবতে পারে, সে অন্যের জন্যও ভাবতে জানে। মানুষ তার সন্তানের জন্য ভাবে, পরিবারের অন্যদের কথা ভাবে, প্রতিবেশির কথা ভাবে, দেশের কথা ভাবতে জানে। তাইতো বলা হয়ে থাকে ‘ মানুষ -মানুষের জন্য’।
মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্যটা এখানেই। পৃথিবীতে এমন অনেক মহৎ প্রাণের উদাহরণ আমাদের চারপাশেই রয়েছে। এইতো সেদিন ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় বন্ধুদের জন্য জঙ্গিদের হাতে স্বেচ্ছায় ফারাস আয়াজ হোসেন তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভালোবাসার এমন নব নব তাজমহল রচনা কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আর এটাইতো আবহমান বাংলারও প্রকৃত চেহারা।
আমার মনে হয় পড়া শোনার সাথে লেখা-লেখির বিশেষ একটা যোগসূত্র রয়েছে। শহরের পুরানথানা এলাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে ছেলেবেলা থেকেই আমার যাতায়ত ছিল। সেখানে যাতায়তের কারণে পাঠাভ্যাসটিও গড়ে উঠেছিল আমার। বই পড়ার মাধ্যমেই লেখার প্রতিও আগ্রহ জন্মেছিল সেখান থেকে। তখন থেকেই কিছু কিছু লিখতে শিখি। জানিনা সেই যে পড়া ও লেখা শুরু করেছিলাম নিয়তিই হয়তোবা আজ গ্রন্থ প্রকাশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে। আমার বিধিলিপি কিন্তু আমাকে ঠকায়নি। আমাকে আনন্দ দিয়েছে, ছন্দময় করেছে, আলোকিত করতে সাহায্য করেছে এবং সর্বোপরি আমাকে সমৃদ্ধি দান করেছে।
নোট: লেখায় ব্যবহৃত প্রতিকী ছবিটি সংগ্রহ।

মু আ লতিফ : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক, কিশোরগঞ্জ।
