শতাব্দীর কঠিন চ্যালেঞ্জসমূহ বর্তমানে আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পূর্ব পুরুষরা কিংবা আমাদের পূর্বতন প্রজন্ম সরাসরি শত্রুর মোকাবেলা কিংবা অভিসন্ধি বুঝতে সক্ষম ছিলেন।
আজ এক অচেনা শত্রুর বিপক্ষে আমরা লড়ে চলেছি। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধের সামনের সারিতে থেকে রোগীদের সহায়তা ও পরিচর্যা করছেন চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা পরম মমতা আর আন্তরিকতা দিয়ে এ মুহুর্তে রোগীদের সেবা-শ্রুষা করে যাচ্ছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই তারাই হচ্ছেন কোভিড-১৯ যুদ্ধের বীর সেনানী।
করোনাভাইরাস মহামারী সামাল দিতে গিয়ে এমনিতেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন দেশের স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রশাসনের লোকজন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা দিনরাত চেষ্টা করছেন মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে। কিন্তু তার উল্টোচিত্রও দেখছি।
পৃথিবীর সব হাসপাতাল-ক্লিনিকের দিকে চোখ রাখুন। ঘুমহীন ক্লান্ত শরীর নিয়ে কত মানুষ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অন্যকে বাঁচানোর জন্য। ওটাই তাদের পেশা। সেবাই তাদের ধর্ম। সেই তাদের নিয়েও আমাদের দেশে আছে মানুষের রাগ-ক্ষোভ-হতাশা। আসলে কিছু কিছু চাকরি আছে যেখানে হয়তো অনেক টাকা আছে। সঙ্গে আছে শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম। আছে অন্যের জীবনের জন্য দিনরাতের লড়াই। মৃত্যুকে হটিয়ে দিয়ে একটা মানুষকে বাঁচাতে পারলে যে আনন্দ তা কোনো সুপারশপে কেনা যায় না।
স্বাস্থ্য আর জীবনের ঝুঁকির শঙ্কা প্রতিমুহুর্তে বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার বড় প্রশ্ন সবার কাছে। এ অবস্থায় কোভিড-১৯ রোগ থেকে মুক্তি পেতে আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা স্বাস্থ্যবিভাগের লোকজনই। এ জন্য দেশের সাধারণ মানুষও বোধহয় এই মুহুর্তে তাদেরকে খুব আপন মনে করছে। সরকার প্রধানসহ সবার চাওয়া, রোগ মুক্তিতে ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক মনোভাব দেখাবেন না। চরম দুঃসময়ের মুহুর্তে অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করবেন না। মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করুন। এমন নির্দেশনা সত্ত্বেও অধিকাংশ জায়গায় এর সুফল মিলছে না। দেশের অনেক এলাকায় স্বাভাবিক রোগের তেমন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। এতে করে মানুষের জীবন-মৃত্যুতে ভোগান্তি ও দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। উত্তরণে সরকার নানামুখী আন্তরিক উদ্যোগ-আয়োজন সত্ত্বেও কাঙ্খিত উন্নতি হচ্ছে না। এ জন্য স্বাস্থ্যসেবায় জড়িতদের নিয়ে দেশের মানুষের মনে একধরনের ক্ষোভ-হতাশা থেকেই যাচ্ছে।
বর্তমানে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একধরনের অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। সরকারী হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারী বিভিন্ন স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে সবাই করোনা রোগী নিয়ে তটস্থ। ফলে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক রোগের তেমন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র থেকে পলায়ন এবং প্রণোদনা পাওয়ার অপকৌশল বলে অনেকেই মতামত দিচ্ছেন। এই মতামত স্বাস্থ্যসেক্টরে জড়িতদের লজ্জিত ও ব্যথিত করছে।
দৃশ্যত মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়, বর্তমান অবস্থায় শিশুসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত বয়স্করা স্বাস্থ্যসেবা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া গর্ভবতীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। একজন গর্ভবতীকে গর্ভকালীন অন্তত চারবার চেকআপ করাতে হয়। বর্তমানে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে অধিকাংশ গর্ভবতী কাঙ্খিত সেবা নিতে পারছেনা। অথচ স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ বাধ্যতামূলক। এছাড়া প্রসবকালীন ও পরবর্তী সময়ে জটিলতা দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে এসব নারীর নিয়মিত মেডিকেল চেকআপই প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে।
প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে শিশুসন্তান হচ্ছে অমূল্যধন। তার জন্ম হওয়া মাত্রই আনন্দের ঢেউ যেন ছড়িয়ে পড়ে পরিবারসহ সর্বত্র। আর সেই প্রিয়তম শিশু কোন রোগে আক্রান্ত হোক অভিভাবক মাত্রই তা কেউ-ই চাইবে না। এটাই তো স্বাভাবিক। এ জন্য জন্মের ৪২ দিন পূর্ণ হলেই শিশুকে নির্দিষ্ট বিরতিতে ১ বছরের মধ্যে যক্ষা, পোলিও মাইলাইটিস, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি ও হাম এই ৮টি রোগের টিকা দিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে যান।
কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় অধিকাংশ স্বাস্থ্যবিভাগে শিশুরদের প্রতিরোধযোগ্য এ রোগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ্য ও সুন্দরভাবে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখা বোধহয় আমাদের জন্য নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত আশু প্রদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন এমনটাই প্রত্যাশা সব শ্রেণি পেশার মানুষের।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে মানুষ থেকে মানুষে। ফলে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আক্রান্তদের সংস্পর্শে চিকিৎসক-নার্সসহ এ পর্যন্ত কয়েক শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ ও করেছে। সংক্রমণের এই সংখ্যা তাদেরকে সঙ্কিত করেছে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, মূলত সেই কারণে দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশের নানা শ্রেণি পেশার মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনাসহ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এই মহাবিপর্যয় থেকে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য। আর এই কঠিন সময়ে চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে সকলের কাছে মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করছি।
সবশেষে বলব, সময়ের সঠিক প্রয়োগে আসুন দৈনন্দিন জীবনে কঠোর দায়বদ্ধতা উত্তরণ করে আত্ম উপভোগের মাধ্যমে এমন দুঃসময়ের দিনগুলি পার করি। পরস্পরকে দোষারোপ নয়, বরং একে-অপরকে নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করি। তাহলেই বলতে পারব, মহামারি মোকাবিলায় সূদুরপ্রসারী যুদ্ধে সম্মিলিত আহ্বানের ডাক-আমরা করবো জয়!