প্রকৃতি

কাঁদছে মানুষ, হাঁসছে প্রকৃতি ।। ফয়সাল আহমেদ

ফয়সাল আহমেদ   মে ৩, ২০২০

করোনা নামের এক ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ যখন দিশেহারা। কভিড-১৯ মহামারিতে পর্যুদস্ত পৃথিবীর মানুষ যখন নিজের অস্থিত্ব রক্ষায় ঘরবন্দী করে রেখেছে নিজেকে।

করোনাকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিদিন যখন অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। তখনই সজীব হয়ে ওঠেছে প্রকৃতি। যেমনটা বহুকাল আমরা দেখিনি। আমাদের পূর্বের কয়েক প্রজন্মও তা দেখেনি। প্রকৃতির এই বিস্ময়কর পরিবর্তনে আমরা অবাক হচ্ছি!

অথচ একবার খেয়াল করছি না, ইতিপূর্বে এই প্রকৃতির উপর আমরা কতই না অত্যাচার করেছি। অবাধে গাছ-পালা কেটে বনভূমি উজার করেছি, পাহাড় কেটেছি, পুকুর, খাল-বিল, নদ-নদী, এমনকী সাগরও দখল করেছি, ভরাট করে ইমারত নির্মাণ করেছি। আমাদের ভোগ-বিলাসিতার নামে কোটি কোটি কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছি। এসবের কালো ধোঁয়া যেমন পৃথিবীর বাতাসকে বিসাক্ত করেছে, বাড়িয়েছে তাপমাত্রা, তেমনি কারখানার বর্জ্য, কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত পানি নদ-নদী আর সাগরকে করেছে দূষিত। এসবের প্রভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে। নদ-নদীতে ভাঙন ধরেছে, বাস্তুহারা হয়েছে, হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। নানা দেশে ফসলহানী দেখা দিয়েছে। না খেয়ে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে নানা প্রজাতির জীবজন্তু।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, কোন দেশ, কতদিনের মধ্যে সাগর তলে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে, কোন দেশ আংশিক বিলীন হবে। এসব পড়ে, শুনে আমরা ভীত হই। এমনই অজানা এক আশঙ্কায় আমরা এই পৃথিবীর নাগরিকেরা যখন গভীর অনিশ্চয়তায় দিকে হাঁটছিলাম তখনই আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হলো আরো এক ভয়ংকর প্রাণঘাতী ভাইরাস কভিড-১৯। মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে আমরা গৃহবন্দী হলাম। অপরদিকে এই সুযোগে প্রকৃতি যেন তার বহুকালের অবরুদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে।

সংবাদমাধ্যমসূত্রে আমরা দেখছি করোনারকালে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বনের প্রাণিকে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুম্বাইয়ের রাস্তায় সম্প্রতি ঘুরতে দেখা গিয়েছে ময়ূর। ফেসবুকে ময়ূরের সেই ছবি পোস্ট করে আলোকচিত্রী মানব মাঙ্গলানি লিখেছেন, ‘ময়ূরেরা বেরিয়ে এসেছে এবং নাচছে মুম্বাইয়ের ফাঁকা রাস্তায়, বিরল দৃশ্য।’

শুধু কী ময়ূর! কোথাও জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায় পায়চারী করতে দেখা গেছে উট পাখিদের, আবার সড়কে অবাধে ঘুড়তে দেখা যাচ্ছে পেঙ্গুইনদেরও। সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনে ফাঁকা রাস্তায় অবাধে চলাচল করে বেড়ালো কয়েকটি পেঙ্গুইন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল সেই ভিডিওতে দেখা যায় পেঙ্গুইনগুলো শহরের প্রধান সড়ক পার হয়ে মানব বসতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অকল্পনীয় এমন দৃশ্য আপনি কখনও দেখেছেন? না আমরা দেখেছি?

এই ধরুন ডুয়ার্সের কথাই যদি বলি। লকডাউনের ফলে সেখানে পরিবেশ দূষণ আগের চাইতে বহুগুণ কমেছে। পরিবেশেও তার ছোঁয়া লেগেছে। পাখির কলতান, বন্য প্রাণীদের স্বাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ানো, রাস্তায় হাতিদের পায়চারি, ময়ূরের নাচ, সবই চলছে ওখানে। পর্যটক বিহীন নিস্তব্ধ ডুয়ার্সের মূর্তি নদীতেও দূষণ কমেছে। বিভিন্ন পানীয় বোতল, প্লাস্টিক বা আবর্জনার স্তূপ, এর কোনটাই নাই সেখানে। নদীর পাশে নিশ্চিন্তে ঘুরছে বনের হরিণ, গন্ডারসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। বনমোরগের আওয়াজ, পেঁচার ডাক, হরিণের চিৎকার সবকিছুই ভেসে আসছে দিনের বেলায়। সন্ধ্যা হতে না হতেই ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। যা আগে কখনও ঘটেনি। এসব আমরা সংবাদমাধ্যমসূত্রেই জানতে পারছি।

জলপাইগুড়ির অনারারি ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন সীমা চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন- ‘জঙ্গলে পর্যটক ঢোকা বন্ধ থাকায় একটা নিস্তব্ধতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে বন্য প্রাণীরা নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করছে। তাই গাছের উপর কখনও চিতাবাঘ উঠে পড়েছে, আবার বাইসন, হাতি চা-বাগানে ঢুকে পড়ছে। সবথেকে বড় বিষয় হল লকডাউনে বন্য প্রাণীর হামলায় কিন্তু কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এটা সব থেকে ভালো খবর। আসলে বন্য প্রাণীরা বিরক্ত না হওয়ায় হামলার ঘটনা কমেছে।’

কভিড-১৯ এ বিধ্বস্ত ইতালির ভেনিসের সমুদ্রতীরে ডলফিন এসে খেলছে। জাপানের নারা শহরের জনমানবশূন্য রাস্তায় দেখা মিলেছে বিরল প্রজাতির শিখা হরিণের। লকডাউনের কারণে উড়িষ্যার উপকূলে অলিভ রিডলে কচ্ছপগুলো এবার অনেক শান্তিতে ডিম পাড়তে পারছে। গহিরমাথা আর ঋষিকুল্যা সৈকতজুড়ে এবার প্রায় আট লাখ কচ্ছপ এসেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ওকল্যান্ডের একটি স্কুলের মাঠে টার্কি মুরগির ঝাঁককে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। আর পর্যটকশূন্য মেক্সিকোতে গত এক দশকে এই প্রথমবার সমুদ্র সৈকতে উঠে এসে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে বড় বড় কুমির। শুধু তাই নয়, আরাম করে রোদও পোহাচ্ছে তারা।

এই সেদিন আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ডলফিনের দলকে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে এমন ফাঁকা জনমানবশূন্য সমুদ্রসৈকতে ডুবসাঁতারে মত্ত ছিল ডলফিনের দল। এমন দৃশ্য অমরা কবে দেখিছি মনে পড়ে?

করোনার এই সময়টা নদীর জন্যও বড় সুখের সময়, আনন্দের সময়। কারণ এখন নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার কমে গেছে। নদীতে আবর্জনাও মিশছে অনেক কম। কারণে অকারণে নদীতে নোংরা- আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলা বন্ধ। ফলে নদীর দূষণ তেমন হচ্ছে না বললেই চলে। এই সময়ে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দিকে চোখ ফেরালেই দেখা মিলবে পূর্বের চাইতে বহুগুণে সচ্ছ পানি। এই পানিতেই খেলা করছে মাছেরা। আর মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সাগর, নদীতে মাছের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এতেই বুঝা যাচ্ছে আমাদের করুণ দশার বিপরীতে প্রকৃতি যেন তার হারিয়ে যাওয়া রুপ-যৌবন ফিরে পেয়েছে। একদিকে কাঁদছে মানুষ, অন্যদিকে হাঁসছে প্রকৃতি। একজন নদীকর্মী হিসেবে, প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে প্রকৃতির এই আনন্দে আমি যেমন খুশি, তেমন উদ্বিগ্ন ও বটে। এই সময়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপি হাজারো মানুষের মৃত্যুর সংবাদ আমাকে ব্যথিত করছে। খুব দ্রুতই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটুক। ভয়, ডর কাটিয়ে স্বেচ্ছা গৃহবন্দী মানুষগুলি বাইরে বেরিয়ে আসুক। করোনাকে পরাভূত করে পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। তবে অবশ্যই করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে প্রকৃতি বিনাসী কোনো কাজ আমরা দেখতে চাই না। ভালো থাকুক আমাদের প্রিয় প্রকৃতি

ফয়সাল আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক।

About the author

ফয়সাল আহমেদ