এক. কীভাবে থিয়েটারে আসি সে অনেক পরের গল্প। কিন্ত তারও আগে সেই ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের বীজ বোধহয় বোনা হয়ে গিয়েছিল।হয়েছিল কি আমরা তখন ভাড়াবাড়িতে থাকতাম।এখন যে পাড়াতে থাকি সেই পাড়াতেই।
অর্থাৎ বালুরঘাটের বেলতলাপার্ক দিশারী পাড়া। তো যেখানে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়িতে দীপ্তি পিষি থাকতো। পিষি তখন বালুরঘাটের বিখ্যাত থিয়েটার দল ত্রিতীর্থে অভিনয় করতো। যে ত্রিতীর্থ দেবাংশি, দেবীগর্জন ইত্যাদি মঞ্চস্থ করে প্রমান করে দিয়েছে কলকাতার বাইরেও থিয়েটার হয়! অধিকাংশই জানেন যে ত্রিশূল এবং তরুন তীর্থ দল মিলে গিয়ে ত্রিতীর্থ নাম হয়েছিল। নাটকের ইন্টারভেলে ত্রিতীর্থে ভাল ভাল খাওয়া দাওয়া হতো।
আমি ছিলাম পিসির ন্যাওটা। আর পিসিও যেখানে যেখানে যেত আমাকে নিয়ে যেত। ফলে নাটকের দিনও যেতাম। আর এক এক দিন পোলাও ও খেয়েছি। ছোটবেলার অনেক কিছু ভুলে গেলেও এই ঘটনাটি যেন আমার মনে থেকে গিয়েছে। তখন কত বয়স হবে আমার ! চার-পাঁচ! নাটক দেখতে ভাল লাগতো। একেক জন এসে এসে কথা বলতো, লাইট পড়তো তাদের উপর আমার ভারী ভাল লাগতো। আর ঐ পোলাও…এখনও দীপ্তি পিসির সাথে দেখা হলে এই কথা হয়। আর পিসি বলে সে কি দিন ছিল রে! সোনালী দিন।
দুই.
কি অদ্ভুত! সেই ত্রিতীর্থেই গেলাম বড়বেলায় অভিনয় করবো বলে আমার বর্তমান বিদ্যালয় অযোধ্যা কালিদাসি বিদ্যানিকেতনের তখনকার কলিগ মমিতা দাসের মাধ্যমে। ২০০৭ সাল হবে। তার আগে নাটকের সম্বল বলতে ছোটবেলাতে প্রদীপ জ্যেঠু দের বাড়ির বারান্দায় মায়েদের শাড়ি টাঙিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীর নাটক। নবম শ্রেণিতে বালুরঘাট হাইস্কুলে রামকৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয়ের না হওয়া নাটক।আর কলকাতায় গেলেই রুটিন ছিল শনি বা রবিবার আকাদেমিতে কলকাতার নাট্য দলগুলির নাটক।
সেই নাটক দেখতে দেখতে মনে হতো আমিও পারবো বোধহয় অভিনয় করতে। বা, বালুরঘাটের নাটকে তখন খরা চলছে। কোন নতুন নাটক হচ্ছেনা। নতুন প্রজন্ম আসছে না। অথচ তার আগে বালুরঘাটের নাট্য ইতিহাস ছিল গৌরবময়। সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক হয় জানি কিন্ত বালুরঘাটে একসময় নাটক এর টিকিট ব্ল্যাকে কিনতে হয়েছে।
ভাবা যায়!! সেখানে কি না নাটকের খরা। কোন নতুন নাটক সেই অর্থে হচ্ছেনা। কোন নতুন প্রজন্ম আসছে না। কলকাতায় আকাদেমি, রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, মধুসূদন মঞ্চ, গিরিশ মঞ্চে বসে বসে থিয়েটার দেখতে দেখতে আমারও মনে হতো আমি অভিনয় পারবো। আমার অভিনয় করা উচিত। তাতে বালুরঘাটে নতুন কেউ থিয়েটারে আসছে না সেই জায়গায় একজন তো যুক্ত হবে!
তিন.
তার আগে অবশ্য জলদাপাড়া সংলগ্ন মাদারীহাটের বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনে যখন আমি শিক্ষকতা করি (2001-06) তখন মূলত 2005-06 ‘সংকল্প’ নাম দিয়ে পরিবেশের কাজ শুরু করেছি।দেখলাম মূলত সচেতনতাধর্মী এই কাজের প্রয়োজনে থিয়েটার অন্যতম একটি হাতিয়ার হতে পারে।ছাত্র দের দিয়ে মঞ্চস্থ করলাম ‘গাছই জীবন’।রচনা ও নির্দেশনা এই অধমের।
মনে রাখতে হবে পরিবেশের সঙ্কটের কথা তখনও নাটকে উঠে আসেনি( এখনও কি পরিবেশের সঙ্কটের কথা গভীর ভাবে উঠে আসছে??)।যদিও সেটা ছোটদের দ্বারা পরিবেশিত নাটক। সেই নাটক ছিল পথ নাটকের ফর্মাটে।তাই আমরা সেই নাটক নিয়ে পথে, অন্য স্কুলে পরিবেশন করলাম।নতুন ধারার নাটক পছন্দ করলো অনেকে।আমারও মনে হতে লাগলো বালুরঘাটে শেকড়
আমার।যে বালুরঘাটকে সবাই জানে থিয়েটারের শহর বলে।তার বীজ কি গোপনে গোপনে ছড়ানো হয়ে গিয়েছিল আগেই!
তারপর অবশ্য 2006 সালে বাড়ির ডাকে চলে আসি আমার জন্মশহর বালুরঘাটে।
চার.
বালুরঘাটে এসে যেন মাদারীহাট পর্বেরই সূচনা হলো। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শুরু হয়ে গেল নাটকের পাঠ।স্কুলের ছুটির পর, ছুটির দিনে রিহার্সাল চলতে থাকে। শিলিগুড়িতে ২০০৭ সালে রাজ্য শিশু কিশোর নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণ বা পরে কেন্দ্র সরকারের আয়োজনে কলা উৎসবে কলকাতায় অংশগ্রহণ, জেলার একমাত্র বিদ্যালয় হিসাবে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার কর্মশালা- থিয়েটারের আনন্দ যেন পেয়ে বসেছে।আর ভিতরে ভিতরে কেবল মনে হচ্ছে বালুরঘাটের থিয়েটারের দলে যুক্ত হওয়ার কথা। অভিনয়ের কথা। সেই সময়ই আমার সেই কলিগ মমিতা দাসের মাধ্যমে প্রখ্যাত নাট্যদল ত্রিতীর্থের সেই ঐতিহ্যমন্ডিত থিয়েটার হলে প্রবেশ।
সেখানে সে সময় থিয়েটার হচ্ছেনা। ঐ যে আগেই বলছিলাম বালুরঘাটের থিয়েটারে খরার সময়। অন্য নাট্যদল গুলোও থিয়েটার করছেনা। নাটকের দলগুলোর ঘরে তখন অন্ধকার। শুধু আড্ডার আলো এসে বসে। আর এদিকে কলকাতা যাচ্ছি আর সুযোগ পেলেই থিয়েটার দেখছি। এভাবেই দেখেছি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, শাঁওলি মিত্র, উষা গাঙ্গুলির মতো থিয়েটারের মানুষদের যাদের নাম শুনে এসেছিলাম এতদিন। অর্পিতা ঘোষ, ব্রাত্য বসু, দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, কৌশিক সেনদেরও ও ভাবেই দেখা। দেখেছি বিখ্যাত সব নাট্য নির্মানও।
এই সব দেখে আসি আর মনের ভিতর প্রবল ভাবে নাড়া দিতে থাকে থিয়েটারে অভিনয় করার কথা, থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার কথা।বিখ্যাত নাট্য দলটিতে তখন কোন থিয়েটার হচ্ছেনা অথচ মন চাইছে প্রবল ভাবে থিয়েটারে যুক্ত হতে।এ সময়ই আমার এক বন্ধু ও দাদা সন্তু রায় ও তুষার কান্তি দত্তের মাধ্যমে বালুরঘাটে নতুন নাট্যদল সৃজন নাট্য সংস্থায় যুক্ত হয়ে গেলাম। তারা তখন অণু নাটকের চর্চা করছে। নতুন ধারার নাটক। দৈর্ঘ্য ১৫-২০ মিনিট। ব্যস লেগে গেলাম। প্রথম নাটক -বিবর্ণ সভ্যতা। নির্দেশক- রবীন্দ্রনাথ সাহা ।নাট্য দল- সৃজন, বালুরঘাট। একথা জোরের সাথেই বলতে পারি যে বালুরঘাটে যখন থিয়েটার হচ্ছেনা তখন সেই মরা গাঙে বান নিয়ে এসেছিল সৃজন, অণুনাটকের মাধ্যমে।
একটা ব্যক্তিগত কথা এখানে জানাই। আমি লাজুক প্রকৃতির। কথা বলি ঠিকই কেননা ততদিন সঞ্চালনা জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। তবে শরীরি অভিনয়ে একটু যেন আড়ষ্ঠতা অনুভব করি। আমি কি পারবো? সেইসময় মনে হয়েছিল একবার। এখন যে, যে কোন পরিস্থিতিতে অনর্গল কথা বলি, মঞ্চে দাঁড়াতে পারি, একটা সক্ষমতা এসেছে- সেক্ষেত্রে থিয়েটারের অবদান অনেক।এই হিসাবে থিয়েটারের কাছে আমি আজন্ম ঋণী থাকবো।আর কৃতজ্ঞ থাকবো অন্তর থেকে রবীন দা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ সাহার কাছে। হাতে ধরে শিখিয়েছেন কত কিছু! কৃতজ্ঞ থাকবো সৃজন নাট্য সংস্থার প্রতিও। আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। সৃজনে বিবর্ণ সভ্যতা, দেনাপাওনা( একাঙ্ক নাটক), শিকড়ের খোঁজে ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেছি।সৃজন থেকে যাবে বুকের ভিতর।
তারপরেই যে নাট্যদল আমাকে আপন করে নিয়েছে আর আমিও আপন করে নিয়েছি সেই নাট্যদল বালুরঘাটের শপথ নাট্যদল।এখানে এসে পথ নাটকে আমার অভিনয়ের হাতেখড়ি। যার সাথে এখনও থিয়েটার বন্ধনে ।বহু স্মরণীয় চরিত্র- অভিনয় এই নাট্যদলে।রক্তকরবীর বিশু পাগল, পদধ্বনির আন্দ্রেয়ী ইভানোভিচ, অন্য ঝুমুরের ফটকে কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো! বালুরঘাটসহ উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে আমরা উপরোক্ত নাটক গুলির শো করেছিলাম।শপথ নাট্যদলের সম্পাদক- নির্দেশক হারাণ মজুমদার অভিনয়ের যে পাঠ দিয়েছেন তা থেকে যাবে আজীবন।তার কাছেও আজন্ম ঋণী থেকে যাবো।কৃতজ্ঞ থাকব শপথ নাট্যদলের কাছেও।
এখানে মনে রাখতে হবে যে এই সময় বালুরঘাটে আবার থিয়েটার তার সেই সোনালী যাত্রা শুরু করেছে আবার। নাট্য দলগুলির মহরা কক্ষে ফিরে এসেছে সুদিন। কাউকে ফোন করলে ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসছে “…পরে ফোন করছি, রিহার্সালে আছি” ত্রিতীর্থ সেই সময় মঞ্চস্থ করছে ‘বীজমন্ত্র’, সমবেত নাট্যকর্মী ‘সুন্দর’, বালুরঘাট নাটকর্মী ‘শোকমিছিল’, বালুরঘাট নাট্যতীর্থ ও বালুরঘাট নাট্যমন্দির মঞ্চস্থ করছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাস্তি’।তার কিছু পরে বালুরঘাটে পুনরায় পথ চলা শুরু করবে নাট্যসংস্থা তূণীর।‘জলপোকা’ হবে ওদের মঞ্চায়নের নাম। পথ চলতে শুরু করবে বালুরঘাট নাট্য সংসদ, নাট্যদল মাস্ক, শুভ্রদীপ দের একটি নাট্যদল।নতুন প্রজন্ম ভীড় করবে আবার নাট্য অঙ্গনে।
পাঁচ.
শপথের প্রয়োজনায় যখন রক্তকরবী নাটকে বিশু পাগলের চরিত্রে অভিনয় করছি তখনই বালুরঘাট নাটকর্মী থেকে অভিনয়ের প্রস্তাব পাই পদভূষণ নাটকে গায়েনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। নির্দেশক ছিলেন মনোজ কুমার গাঙ্গুলি। তার প্রতিও আমি ঋণী যারপরনাই। লিখেছি অভিনয়ের খুটিনাটি।তার সঙ্গেই ধন্যবাদ জানাবো বালুরঘাট নাটকর্মীর সম্পাদক অমিত সাহাকে। ভালবেসে এবং ভরসা করে আমাকে এই কঠিন চরিত্রটিতে মনোনীত করার জন্য। একদিকে বিশু পাগল, অপরদিকে গায়েন। একটি রিহার্সাল করেই ছুটতে ছুটতে আরেকটি নাটকের রিহার্সালে।
রক্তকরবী নাটকের শো ছিল সেদিন বালুরঘাট নাট্যমন্দিরে।শো শেষ করেই রওনা দিতে হবে শিলিগুড়ির বাস ধরতে। নাট্যমন্দির থেকে বাসস্ট্যান্ডও যে অন্যভাবে যাবো উপায় নেই। কারণ সময়। তাই বাড়ির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শো শেষ করে পোশাক বদলাতে বদলাতেই গাড়িতে উঠতে হল। তার ভিতরেই বিশু পাগলের দাড়ি খুলতে খুলতে যাচ্ছি। বাসের পাদানিতে পা দিতেই শিলিগুড়ি যাওয়ার রাতের বাস ছেড়ে দিল। আমিও বিশু পাগল থেকে হয়ে উঠলাম গায়েন। পরদিন শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে ছিল বালুরঘাট নাটকর্মী প্রযোজিত ‘পদভূষণ’ নাটকের শো।শিলিগুড়ির ঋত্বিক নাট্য সংস্থার আমন্ত্রণে।
আর একটি নাট্যদল দিনাজপুর থিয়েটার তাদের প্রযোজনায় আরেকটি বিখ্যাত নাটক ‘চোপ আদালত চলছে’ ( মূল নাটক: প্রখ্যাত নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকর, নির্দেশক: অবন্তী চক্রবর্তী, কলকাতা)। অবন্তী এবং দিনাজপুর থিয়েটারের কাছেও কৃতজ্ঞ আমি। সামন্তের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেবার জন্য। অবন্তীর কাছেও অনেক কিছু শিখেছি। দিনাজপুর থিয়েটারের কর্ণধার সুনির্মল জ্যোতি বিশ্বাসের কাছে ঋণী আমি। এই লেখার মাধ্যমে থিয়েটারে যাদের সাথেই আমি অভিনয় করেছি, কাজ করেছি তাদেরকেই নরসুন্দা ডট কমের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাই। চোপ আদালত চলছে নাটকে যেমন তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন।এটা বড় প্রাপ্তি।
আজ যখন সবকিছু এই লকডাউনের মধ্যে ফিরে দেখছি তখন অনুভব করছি যে এই জীবনে থিয়েটারের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আক্ষরিক অর্থেই আমি থিয়েটারের কাছে ঋণী। গত ২৭ মার্চ বিশ্ব নাট্য দিবসে ইচ্ছে ছিল বালুরঘাট থেকে একটি থিয়েটার পত্রিকা ‘থিয়েটার এবং’ প্রকাশ করার। করোনা ভাইরাস সে পরিকল্পনাকে পিছিয়ে দিয়েছে।এই সময় থিয়েটারের প্রতি আমার ঋণস্বীকারে ও করোনা ভাইরাসের সচেতনতায় #থিয়েটারে দেখা হোক বন্ধুরা #BREAK THE CHAIN ক্যাম্পেন করছি। যেটা আসলে নতুন প্রজন্মের নাট্য শিল্পীদের উৎসাহিত করবার প্রয়াস। তাতে সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে ভাল।বিশেষজ্ঞরা এটা নিয়ে ফেসবুক পেজে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দিচ্ছেন।
যে সময় থিয়েটার জীবন শুরু করেছিলাম তখন থেকে বোধ করি বালুরঘাটের থিয়েটার চর্চা ভাল জায়গায় আছে। নতুন প্রজন্মের অনেক মুখ এসে যুক্ত হয়েছে বালুরঘাটের থিয়েটারে। আর একটা কথা আমার এই দু আনার নাট্য জীবনে এটা অনুভব করি থিয়েটার আমার জীবনে না থাকলে আমি হয়তো এত আত্মবিশ্বাসী থাকতাম না। থিয়েটার নিজেকে চিনতে, জানতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে অন্যকে স্পেস দেওয়ার মানসিকতাকেও। থিয়েটার সহবত শিখিয়েছে।