ঈদ সংখ্যা ২০২০

তবুও বাঙালি ।। তাপস দাস

নরসুন্দা ডটকম   মে ২৩, ২০২০
বাঙালি
“গলি তস্য গলি” বাংলায় অত্যন্ত পরিচিত শব্দ, কিন্তু এই গলি যদি গার্ডেনরিচের কোন গলি হয়, সঙ্গে তস্য গলি চিনিয়ে নিয়ে যাওয়া বন্ধুর নাম জুনেদ হয়। আর সময়টা “করোনা অতিমারী সময়” হয় তবে অনেকের ভ্রু কুঁচকে যাবে।
বন্ধু হলে বলবে অতিমারীতে অতি বাড়াবাড়ি। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে বিগত কিছু বছর ধরে ভারতে গভীর ভাবে ইসলামোফোবিয়া চেপে বসেছে। কিন্তু এই ধরণের কোন ফোবিয়া বা আতঙ্ক আমার মনে জায়গা করতে পারেনি। সেই কারণে বোঝার চেষ্টা করে চলেছি এই বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিপর্যয়ের করোনা কাল।
শৈশব-কৈশোরের জীবন প্রবাহে চলতে চলতে এই ধরণের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আবার কোন মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে ভয়ঙ্কর মনে করার কোন কারণ নেই এই বিশ্বাস ও তৈরি হয় জীবন প্রবাহে। আমার জীবন প্রবাহে হয়তো এক প্রতিবেশী পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এমন মন তৈরি হওয়ার। প্রতিবেশ-পরিবেশ এই দুই আমাদের বোধ-মন-মনন তৈরির প্রধান কারিগর। ঘর, বাড়ি, মা, ঠাকুরমা, পিসি, বড় দিদির কোলের পর, প্রথম চেনা গাছপালা, পুকুর, মাঠ, গোয়াল ঘর, মুরগির খাঁচা এই সমস্ত চেনার মধ্য দিয়ে যে পরিবার জুড়ে আছে তাঁরা নামাজ পড়েন। ঈদে সিমাই-গোস্ত তৈরি করেন। খালা, বু, আপা তাঁদের আত্মীয় পরিচয়।
যৌথ পরিবারে বড় হওয়ায় নানা ভালবাসার সম্পর্ক আমাদের শিশু কিশোর মনকে সিঞ্চন করে। তেমনি পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গেও নানা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যেমন কাকার বন্ধু কাকা, দাদার বন্ধু দাদা, পিসির বন্ধু পিসি ভাইয়ের বন্ধু ভাই। এমন নতুন নতুন চেনা প্রতিবেশ থেকে গড়ে ওঠে। এবং অপরিচিত মানুষের প্রতি ভয় সরে গিয়ে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। 
ভারতীয় ঐক্যবদ্ধ বৈচিত্র্য কোন সোনার পাথর বাটি নয়। এটি বাস্তবিক পরীক্ষিত সত্য। তা সকল ভারতীয় বেড়ে ওঠার সঙ্গেই সেই ঐক্যবদ্ধতার শিক্ষা পেয়ে থাকে। আমাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়নি। তাই শত মিথ্যা প্রচার আমাকে আতঙ্কিত করতে পারে না।
আমাদের বাড়ি লাগোয়া ছিল তিনটি পুকুর যেমন হয় গ্রাম বাংলার সর্বত্র। আর গোলাম কাকা দের বাড়ি ছিল সেই পুকুরের ওপারে। আশির দশকে আমাদের সোদপুর-বরিষা অঞ্চলের গ্রাম পরিবেশকে গ্রাস করতে পারেনি শহুরে উন্নয়ন। তাই পুকুর মাঠ গাছগাছালির মধ্যেই ছিল আমাদের দামাল বয়স। ঐ পুকুরের পাড়ে অসতর্কভাবে আমাদের বাড়ির কোন বাচ্চা পৌঁছাত ওপার থেকে জেঠি বা পিসিরা চিৎকার দিয়ে সাবধান করতো আমাদের বাড়ির বড়দের। আবার ডাংগুলি খেলার জন্য আমার জেঠু কোন শাস্তি বিধান দিতেন তার সাম্য অধিকার ঐ বাড়ির ছেলেদেরও।
আমার ধারণা পশ্চিমবঙ্গের যে কোন ছেলের প্রথম সংগঠিত কাজ হল স্বরসতি পূজা। আর আমাদের সেই সংগঠিত উদ্যোগের প্রথম কমরেড ফারুক হোসেন আর সুকান্ত মুখার্জি। বড়দের শাসন আবদার কিংবা লুকিয়ে যা কিছু করার সবই ছিল জাহিদা দিদিদের বাড়ীতে। শালে বুকে লুকিয়ে ইদের দিনে সিমাই ছড়া অন্য সব উপাদেয় স্বাদ গ্রহনের ব্যবস্থা কাকী করে দিতেন এক ইশারায়।
যদিও ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যকার ব্যবধান অস্বীকার করার উপায় নেই। ঐ ব্যবধান বাস্তব যেমন “এক বৃন্তে দুটি কুসুম” লাইন অমর হয়েছে। তাই আমার মতন অসংখ্য মানুষের মধ্যে ঐ ব্যবধান আতঙ্কের সৃষ্টি করা না। আবার বিরোধ-প্রতিবিরোধ ও ঐতিহাসিক সত্য।
মুসলমান পন্ডিত পরিব্রাজক ভারত বিদ্যার বিশারদ, আল বিরুনি এই ব্যবধানকে অনুধাবন করেছিলেন।
তিনি বলেছেন, “হিন্দুরা আমাদের থেকে বিসদৃশ্য”। ভাষাগত পার্থক্য থেকে ধর্মীয় রীতিনীতির অনৈক্য লক্ষ্য করে ছিলেন। যদিও তাঁর সেই দেখার পর হুগলি-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-বারাকেতে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। এই অনৈক্য বাংলায় এক মহান- আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে দুই ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসী মানুষদের একত্রে টিকে থাকতে শিখিয়েছিল।
নদীমাতৃক বঙ্গে মৎসজীবী কৃষকসহ নিম্নবর্গীয় প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অবজ্ঞা নিম্নবর্গের হিন্দুদের মুসলমান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। রাজার শক্তি বা মৌলবী, ফকির দ্বারা প্রভাব ও ধর্ম পরিবর্তন করিয়েছিল। কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষের ধর্ম পরিবর্তনের আগ্রহ অস্বীকার করা যায় না। ধর্মীয় বিভেদ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিকভাবে একই শ্রেণীতে থাকায় এবং একইভাবে প্রকৃতিকে চেনার ও ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থাকায় বাঙালি হয়ে থাকায় অভ্যাস গড়ে উঠেছে। 
বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশের ফলে আরো বেশী বেশী করে পাশে থাকার টান অনুভব করেছে বাঙলা ভাষীরা। বারবার দাঙ্গার স্মৃতিকে ভুলে আবার একত্রে বর্ষবরণে পয়লা বৈশাখ মেতে উঠেছে বাঙালি সাজে। হয়তো তাই বিশ্ব জুড়ে এই অতিমারি করোনা কালেও সমস্ত আতঙ্ক কাটিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক দূরত্ব কমানোর অঙ্গিকার করতে হবে এপার- ওপারে থাকা প্রতিটি বাঙালির। কারণ জাতিগতভাবে নৃতাত্ত্বিক ভাবে আমরা আসলে একই জাতি।

তাপস দাস : নদী কর্মী, কলকাতা (ভারত)
আরও পড়তে পারেন….
লোকালের গান ।। রাজেশ ধর
কাক ।। অনিন্দ্য আসিফ
চুপমানুষ ।। সুস্মিতা চক্রবর্তী

About the author

নরসুন্দা ডটকম