মানুষ- সমাজ

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত : স্বদেশী যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবী

নরসুন্দা ডটকম   সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮

যতীন সরকার >>

লোকে জানে তাঁকে স্বদেশী যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবী বলে। তিনি ভূপেন দত্ত। একদিকে কট্টর মাৎসিনিপন্থি, অপরদিকে কট্টর মার্কসপন্থি। অধিকন্তু তিনি আবার নৃতত্ত্ব-শাস্ত্রী এবং সমাজ-সেবক।

আমি প্রায় বিস্মৃত সেই বাঙালি মনীষীর কথা স্মরণ করছি। তার নাম_ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (জন্ম: ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮০ – মৃত্যু: ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১)।

তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ। কলকাতার অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্তই সন্ন্যাসী হয়ে নাম ধারণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। তারই অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ কিন্তু অগ্রজের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল হয়েও নিজে অধ্যাত্মবাদী বা সন্ন্যাসী হননি। তার বদলে তিনি হয়েছিলেন বস্তুবাদী ও সমাজবিপ্লবী। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তথা মার্কসীয় দৃষ্টিতে উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস-রচনায় বাঙালিদের মধ্যে তিনিই ছিলেন পথিকৃৎ। সংবাদপত্রসেবীও ছিলেন তিনি। সংবাদপত্রের মাধ্যমেও তিনি ঐতিহ্য-চেতনা ও বিপ্লব-ভাবনায় দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন।

ভূপেন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনেই যোগদান করেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের লক্ষ্যে ব্যারিস্টার পি. মিত্র যে নিখিলবঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেছিলেন, ভূপেন্দ্রনাথ সেই সমিতির সদস্য হন ১৯০২ সনে। এখানেই তিনি বিপ্লবী যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ ও ভগিনী নিবেদিতার সাহচর্য লাভ কারেন। এ সময় তিনি ইতালীয় বিপ্লবী মাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন।

অরবিন্দের সহায়তায় তিনি বিপ্লবীদের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদক হন ১৯০৬ সনে।

লোকে জানে তাঁকে স্বদেশী যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবী

‘যুগান্তর’ সম্পাদনা ও ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি বে-আইনি ইস্তেহার প্রকাশের জন্য ১৯০৭ সনে তিনি এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। মুক্তির পর তিনি ছদ্মবেশে আমেরিকায় চলে যান এবং ১৯১২ সনে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন ও এর দুবছর পর ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৪ সনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের অনেকেই আমেরিকা ছেড়ে বার্লিন চলে যান এবং ভূপেন্দ্রনাথও তাঁদের সহযাত্রী হন। বার্লিনে অবস্থান করেই তারা বিপ্লব-আন্দোলনকে জোরদার করতে মনোযোগী হন। ভূপেন্দ্রনাথ ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সন পর্যন্ত বিপ্লবীদের সংগঠন বার্লিন কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। শুধু বিপ্লবী কাজকর্মই নয়, এ সময়ে তিনি সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের গবেষণা করে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পান (১৯২৩)। জার্মান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি ও জার্মান এশিয়াটিক সোসাইটির তিনি সদস্য ছিলেন। তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদানের জন্য ১৯২১ সনে ভূপেন্দ্রনাথ মস্কোতে যান। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং সেই সম্মেলনে আরও দুজন বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় ও বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত উপস্থিত ছিলেন। সোভিয়েত নেতা লেনিন ভূপেন্দ্রনাথ সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।

ভূপেন্দ্রনাথ ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র রচনা করে লেনিনকে দিয়েছিলেন। মস্কো থেকেই তৎকালীন ভারতের জন্য শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের একটি কর্মসূচি তিনি ১৯২২ সনে অনুষ্ঠিত ভারতের কংগ্রেসের অধিবেশনে পাঠিয়েছিলেন। দেশে ফিরে ১৯২৭-২৮ সনে তিনি কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হয়েছিলেন এবং নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন ১৯২৯ সনে। কংগ্রেসের সদস্য হয়েও দেশের শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকার আদায়ের দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এবং সে সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব ১৯৩০ সনে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুকে দিয়ে গ্রহণ করাতেও তিনি সমর্থ হয়েছিলেন। ভারতের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৩৬ সনে। দুবার তিনি নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। সোভিয়েত সুহূদ সমিতি ও গণসংস্কৃতি সম্মেলনসহ বহু সংগঠনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সংযুক্তি ছিল। ভূপেন্দ্রনাথের বিপ্লবী চিন্তা ও বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডের পরিচয় কমিউনিস্ট নেতা ডাক্তার রণেন সেনের লেখায় উঠে এসেছে এ ভাবে_ “ড. দত্ত ত্রিবেণীর মতো তিনটি বিপ্লবী ধারার সঙ্গমস্থল ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন, কংগ্রেস ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গমস্থল।”

আর মনীষী বিনয় সরকারের ভাষায়_ “সকলেই জানে যে, ভূপেন দত্ত সেকালের রামকৃষ্ণপন্থীও নন আর একালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পথও মাড়ান না।
লোকে জানে তাকে স্বদেশী যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবী প্রবর্তক বলে। ভূপেন দত্ত একদিকে কট্টর মাৎসিনিপন্থি, অপরদিকে কট্টর মার্কসপন্থি। অধিকন্তু তিনি আবার নৃতত্ত্ব-শাস্ত্রী এবং সমাজ-সেবকও বটে।”

ভূপেন দত্তকে কট্টর মার্কসবাদী বলা যায় কিনা, এ বিষয়ে আমার মনে কিছু সন্দেহ আছে। কট্টর কথাটি যদি ডগমাটিস্ট-এর বাংলা প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহার করা হয়, তা হলে তো তাঁকে কোনোমতেই কট্টর বলতে পারি না আমরা। তাঁর আখ্যা হওয়া উচিত মুক্তমতি ঐতিহ্য-সচেতন মার্কসবাদী। কট্টর মার্কসবাদীরা স্বামী বিবেকানন্দকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেই মনে করেন। ভূপেন্দ্রনাথ কিন্তু রামকৃষ্ণপন্থী না হয়েও কিংবা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের পথ না মাড়িয়েও বিবেকানন্দের সদর্থক চিন্তার মর্মগ্রাহী হয়েছিলেন।

বিবেকানন্দের পূর্বে এই উপমহাদেশের কেউই নিজেকে সোস্যালিস্ট বলে ঘোষণা করেননি_ কোনো রাজনৈতিক নেতাও নন, কোনো বুদ্ধিজীবী-চিন্তাবিদও নন। অথচ স্বামী বিবেকানন্দ অধ্যাত্মবাদী সন্ন্যাসী হয়েও ছিলেন সোস্যালিজমের দৃঢ় সমর্থক। সোস্যালিজম বা সমাজতন্ত্রকে তিনি বলতেন শূদ্ররাজত্ব। বিবেকানন্দ তার বর্তমান ভারত বইয়ে ইতিহাসের ধারাটিকে যে দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন তাকে অনায়াসেই মার্কসপন্থার প্রায় সংলগ্ন বলা যেতে পারে–যদিও মার্কস-এঙ্গেলসের রচনার সঙ্গে তার কোনো পরিচয় ছিল না।

প্রাচীন ভারতীয় পরিভাষা ব্যবহার করে তিনি ব্রাহ্মণযুগ,ক্ষত্রিয়যুগ, বৈশ্যযুগ ও শূদ্রযুগ–মানব ইতিহাসকে চার ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ তার নিজের যুগকে বৈশ্যযুগ অর্থাৎ এ সময় সমাজ চলছে বৈশ্যরাজ বা ধনিক-বণিকদের শোষণমূলক শাসনে। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বৈশ্যযুগের অবসান ঘটবে এবং শূদ্ররাজত্ব অর্থাৎ প্রলেতাবিয়েতের শাসন আসবেই আসবে। সেই শূদ্ররাজত্ব তো সোস্যালিজম ছাড়া আর কিছুই নয়। যে বিবেকানন্দ সোস্যালিজম প্রতিষ্ঠাকে একান্ত কাম্য ও অপরিহার্য বলে মনে করতেন, বিবেকানন্দ-অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ সেই সোস্যালিজমকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখেই তার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অগ্রজের মতো তিনিও ছিলেন চিরকুমার।

আরো পড়ুন……

বঙ্গবন্ধুই আমাকে শিখিয়েছেন জনগণের কাছে যাওয়ার মাহাত্ম্য- মো. আবদুল হামিদ

About the author

নরসুন্দা ডটকম