দেশ-বিদেশ

কোপেনহাগেনের রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার মূর্তি আই অ্যাম কুইন মেরি

নরসুন্দা ডটকম   এপ্রিল ৭, ২০১৮
কোপেনহাগেনের রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গিনী

শিরদাঁড়া সোজা করে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। পায়ে জুতো নেই। বাঁ হাতে মশাল আর ডান হাতে আখগাছ কাটার ধারালো অস্ত্র। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেনের রাস্তায় গত মাসে বসানো হয়েছে এই মূর্তি। এ দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় বা পার্কে যে সব মূর্তি দেখা যায়, তার মধ্যে ৯৯ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ পুরুষের। সেখানে, হঠাৎ খাস রাজধানীতে এক কৃষ্ণাঙ্গিনীর মূর্তি কেন? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে, এ দেশের ঔপনিবেশিকতা-দীর্ণ অতীতে।

১৭৯২ সালে খাতায় কলমে আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস আনার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল ডেনমার্ক। তবে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হয় তারও বেশ কিছু দিন পরে, ১৮৪৮ সালে। ঘৃণ্য এক প্রথার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলেই তো এক দিনে পরিস্থিতি পাল্টে যায় না! ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন জায়গায়, খেতে ও কারখানায়, কৃষ্ণাঙ্গ কৃষক ও শ্রমিকদের উপর অত্যাচার থেমে যায়নি। পাল্টে যায়নি তাঁদের না-পাওয়ার রোজনামচাও। ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হওয়ার তিন দশক পরে, অর্থাৎ ১৮৭৮ সালের কথা। বঞ্চনা-অত্যাচারের প্রতিবাদে এক কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে।

সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিন কৃষ্ণাঙ্গিনী। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট ক্রোয়া দ্বীপের প্রায় পঞ্চাশটি আখের খেত এবং ফ্রেডেরিকস্টেড শহরের অনেকটাই জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন বিদ্রোহীরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে ‘ফায়ারবার্ন’ নামে পরিচিত সেই বিদ্রোহ। তিন নেত্রীর অন্যতম মেরি টমাসকে স্মরণ করেই কোপেনহাগেনের মূর্তিটি বানানো হয়েছে। এ দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার মূর্তি! যে বেদির উপর মূর্তিটি বসানো রয়েছে তাতে লেখা— ‘আই অ্যাম কুইন মেরি’ (আমি রানি মেরি)।

মূর্তির দুই শিল্পী— ডেনমার্কের জিনেট হেলার এবং ভার্জিন আইল্যান্ডের লা ফন বেল জানালেন, এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই সেই শ্রমিক বিপ্লবের কথা জানেন না। বিস্মৃতির অতল থেকে মেরির মতো নেত্রীদের তুলে আনতেই এই মূর্তি বানানোর পরিকল্পনা। কিন্তু একা মেরি কেন? তাঁর সঙ্গে তো ছিলেন আরও দুই কৃষ্ণাঙ্গিনী। শিল্পীরা জানিয়েছেন, ‘রানি মেরি’র এই মূর্তিটি প্রতীকী। তিন নেত্রীকেই স্মরণ করা হয়েছে মূর্তিটির মাধ্যমে।

রানি মেরির যে ছবি অবলম্বন করে ২৩ ফুট উঁচু মূর্তি বানিয়েছেন দুই শিল্পী, সেটি হুয়ে পি নিউটন-এর তোলা। সেই আফ্রো-মার্কিন বিপ্লবী নেতা নিউটন, যিনি ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার কায়েম করতে তৈরি করেছিলেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি’। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইযে এ ভাবেই এক সূত্রে বাঁধা পড়েছিলেন দু’শতকের, দু’দেশের দুই যোদ্ধা।
প্রসঙ্গত, ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে আমেরিকাকেই ক্যারিবীয় সাগরে তাদের তিনটি দ্বীপের ‘মালিকানা’ বিক্রি করে দিয়েছিল ডেনমার্ক। দু’কোটি ৫০ লক্ষ ডলারে! সেই ‘লেনদেনের’ শতবর্ষ পূরণের পরেই উন্মোচিত হল বিদ্রোহিণীর মূর্তি। ডেনমার্কের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্টের সিনিয়র কিউরেটর হেনরিক হোমের কথায়, ‘‘বঞ্চনা, অবদমন ও ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য এ রকমই একটা মূর্তির প্রয়োজন ছিল। আমাদের অস্বস্তিকর অতীতকে ভুলতে দেবে না এই মূর্তি।’’

About the author

নরসুন্দা ডটকম