‘বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া খোল দেখে ছেলে বলে, আব্বু নৌকা।
আমি বলি, হ্যাঁ, নৌকা।
গত বছর তখনও ওর দাঁত ওঠেনি – মুখ ডুবিয়ে কামড় দিত। লাল মাড়ি আর ঠোঁটে হাসি ফুটলে কী যে সুন্দর দেখাতো!
আমরা এখন তরমুজ খাই না। করোনার বাজারে দামি তরমুজে অনেক ফরমালিন ভেবে শূন্য পকেট সেলাই করে রাখি।’
ফেসবুকে যখন পোস্ট দিলাম, সুন্দর-অসাধারণ-দারুণ-অপূর্ব অভিব্যক্তিতে ছেয়ে গেল। ফ্রেন্ডলিস্টে সুশীলজনের ভীড়; নইলে নাইস-অসাম-জটিল-অস্থির কমেন্টস থাকতো নিশ্চয়ই। তবে যোগসূত্র ওই এক – মানুষ সবকিছুতেই বিনোদন খোঁজে; লেখা পড়ে, মানুষ পড়ে না!
আজ ফের বৃষ্টি। পুকুরতলার জল, মগভর্তি হলেও ক্ষতি নেই – ফোঁটা হলেই হলো। তবে বৃষ্টিতে আনন্দ বেশি। রত্ম তাই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ায়।
হিহি হিহি
আটটি দাঁতের মোহনীয় হাসি। সবুজ ধানগাছের ওপর বৃষ্টিপাতের চেয়েও সুন্দর। কচি হাত উল্টেপাল্টে ধরে, টিনচাল থেকে গড়িয়ে পড়া পানির স্পর্শে উদ্বেল হয়। এক-আধবার ঘোড়ার চাবুকের মতো বিজলী চমকালে আঁতকে ওঠে – সঙ্গে আমিও।
হি, আব্বু বাত্তি।
হ্যাঁ আব্বু, বাত্তি। বিজলী বাত্তি।
ঘরময় সন্ধ্যার রং। বিদ্যুৎ গেছে প্রথম বজ্রশব্দেই; থাকলে টিভি দেখা যেতো – দেখা হয় না তেমন। সেই মৃত্যু আর আক্রান্তের খবর। ফলে সাধারণ ছুটি, লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন প্রভৃতির মেয়াদ বৃদ্ধি। এক ঘেয়েমির অন্য কারণ একই চ্যানেলে আটকে থাকা। রত্মের আবদার, আব্বু মোটু-পাটলু… হে হে…। ওটুকু ছেলেকে বোঝানো না রিমোট কন্ট্রোল বিকল, কার্টুন চ্যানেলে যাওয়া যায় না!
একটা ঝাপটা গ্রিল গলে শরীরে আছড়ে পড়ে। রত্ম মুহূর্তেই পেঁচিয়ে ধরে আমাকে। যেনো একটা লতা, এই মাত্র পাতা ছেড়েছে -স্নিগ্ধ ও সবুজ।
আব্বু ভয় পেয়েছো?
বয় পাইসি।
ভয় কীসের? তুমি সুপারম্যান। দেখো কী সুন্দর বৃষ্টি!
পুনরায় তার দাঁতে মুক্তা ফোটে। নানান আবদারেও কখনও ভূত, আবার বাঘের গল্প বানিয়ে আমাদের বনভোজন সংসারে তার হাসি চাষ করি। এই লকডাউনে আমরা কথা আর গল্প দিয়ে আমাদের ভাঁড়ার পূর্ণ করে রাখি। রত্ম চকলেটের মতোই কথা খুব পছন্দ করে। ফলে তার সাইকেল, বল, আপেল, কখনও চকলেটও বাঘ অথবা ভূতের মুখে হারিয়ে যায়। হারিয়েও সে হাসে, আমরা দম বন্ধ করে মুখে হাসির ছবি আঁকি।
বৃষ্টি ঝরার মতো, কিন্তু স্বতন্ত্ররূপে ঘরময় একটা শব্দ ওড়ে। রত্ম টের পায়। বলে, আব্বু মোবেল।
মুখস্ত নম্বর; রিসিভ করলে ঝড়ের মতো কণ্ঠ আছড়ে পড়ে কানে।
এই কোনও খবর নাই, ঘটনা কী? কী করতেছো এখন?
ঝড় হচ্ছে।
চালের ওপর, না বিছানায়?
আরে নাহ, রত্মকে নিয়ে বৃষ্টি দেখি।
হুম, এই শোনো, একটা সুখবর আছে। নতুন করে কনসিভ করেছি। কোয়ারেন্টাইন কাজে লাগাতে হবে না?
খুব ভালো। সরকার ছুটি দিয়েছে, কাজে লাগাতে হবে না? ভালোই তো।
আর ভালো। সারাদিন খেটে মরছি। এই মেয়ে বলে, আম্মু এটা রান্না করো; ওই মেয়ে ওটা। সাহেব বলে আরেকটা। পিচ্ছিটার জন্য বাইরের দুধ, খিচুড়ি; সারাদিন খাওয়া আর খাওয়া। ও, রত্মের কী খবর?
আর বলো না। মা এটা-ওটা কতো কি রাঁধে! সে তো কিছু খেতে চায় না। শুকিয়ে যাচ্ছে।
ওহ্, চেষ্টা করো; ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খেতে হবে। নইলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে না।
হ্যাঁ, তা ঠিক, তা ঠিক।
আমার ঠোঁটে বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে লাইনটা কেটে গেলে স্বস্তিলাভ করি। ফ্লোরে অ্যালোমিনিয়ামের শব্দ শুনে পিছনে আবছা আলোয় বউকে দেখি। কাকভেজা হয়ে মাত্রই এসেছে – শুনেছে হয়তো কিছু অথবা না। কিন্তু মনে হলো, দীর্ঘকালের একটা জাদুর স্ট্যাচু। নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে, ছামিনা আপা এসেছিল দুধের টাকার জন্য। রত্মের দুধ রাখা বন্ধ থাকুক এক মাস। কী বলো?
রত্মের তুলোর মতো হাতটা নিয়ে যাই বৃষ্টির নাগালে। বলি, আব্বু দুধ খাবে?
আব্বু ডুড খাবো।
ভেজা হাতে কাছে টেনে মাথায় একটা চুমু খাই। চুলগুলো বেড়েছে বেশ। ঘরে কাপড় কাটার কাঁচি আছে। কাল সকালে চেষ্টা করবো একবার।
বৃষ্টি থেমে আসে মোটামুটি। একটা ভেজা কাক ওড়ার কসরত দেখাচ্ছে। ভুল, একটা ফিঙ্গি তাড়া করছে তাকে। আকারে তিন-চার গুণ কাককে ফিঙ্গি তাড়া করে – ছোটকালের সেই বিস্ময়বোধ আজ আর নেই। আকারের চেয়ে সাহসটাই বড় কথা; আমার সে-সাহস নাই।
গোলপুকুর পাড়ের মাঠ থেকে মাইকের শব্দ আসে। ত্রাণ বিতরণ। দূর্যোগে পর্যদুস্ত মানুষের জন্য ভিক্ষা নয়, সাহায্য নয়, খন্দকার সাহেবের ভালোবাসা। কোন খন্দকার? ভাবতে ভাবতে সূর্যের আলো জানালা গলে খাটের উপর এসে পড়ে। রত্মের চোখ কালো কাকের মতো নড়ে ওঠে। আবার মাইকের আওয়াজ। পিছনে তাকিয়ে দেখি বউ এখনও নির্বাক দাঁড়িয়ে। মাইকের শব্দ শুনছে। আমার চোখে তার শান্ত-সরল দৃষ্টি চাকুর মতো বিধেঁ। আমাকে দৈনন্দিন অনিবার্য প্রশ্নের মুখোমুখি রেখে বেরিয়ে যায়।
হিহি হিহি… টুই বড় ডুস্টু
বাইরে তাকিয়ে থেকে রত্ম খুব উচ্ছ্বল। একটা চকলেটের কৌটা কোত্থেকে ভেসে দৃষ্টির সম্মুখে ঠেকেছে। টিভিতে এই চকলেটের বিজ্ঞাপনটা তার মুখস্ত। বাইরে বেরুতে দেখলেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আব্বু নাশিলা।
ঘরের এ-দ্বার ও-দ্বার আর এ-পাত্র ও-পাত্র খুঁজে চকলেটের টাকা বুক পকেটে রেখে খন্দকার সাহেবের ভালোবাসায় আপ্লুত হওয়ার ধাঁধাঁয় পড়ি। বৃষ্টির পর কড়া রোদের ঢল উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে অনুভব করি, চোখ-শরীর ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। কাদা-জল এড়িয়ে মাথার ওপর গাছ রেখে হাঁটার পথ খুঁজি। পথের পাশে ঘোলাজলে আর দশটা ছেলেপুলের মাঝে নিজের শৈশব রেখে গোলপুকুড় পাড়ের মাঠে এসে পৌঁছি।
কাদায় লুটোপুটি ক্ষুধার্ত মানুষ। ক্ষুধার্ত কিনা কে জানে! শুনি মুদি দোকানদাররাও লাইনে দাঁড়ায়। চেনা আর বহিরাগতের লাইন – ক্রমে লাইন ভেঙে হ-য-ব-র-ল জটলা। জটলার সম্মুখে হাটে দাঁড়িয়ে থাকা ষাঁড়ের মতো ত্রাণের ট্রাক। ট্রাকের মুখোমুখি দাঁড়াই মাঠের প্রান্তে – ন্যূব্জ, প্রাচীন বৃক্ষের মতো গম্ভীর। ট্রাকে সাঁটা প্যানা সাইনবোর্ড, ‘খন্দকার সাহেবের ভালোবাসা’। সূর্যরশ্মি গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। ক্রমে বিতরণস্থলের সাথে আমার দূরত্ব কমিয়ে না-দেখার ভঙ্গিতে পায়চারি করি। ভাবি, চেনা মানুষগুলোর জটলা শূন্য হোক।
কিন্তু শূন্য হবে কী – জটলা বাড়ে আর বন্যার পানির মতো ঘোলা হয়। দুটো চিল ডানার ওপর রোদ মেখে মাঠকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরছে। চিলের চিৎকার মুহূর্মুহু আমাকে বিচলিত করে। শূন্যে দৃষ্টি ফেলে তখন চিল দেখি, আবার কপালের ঘামফোঁটায় তাদের বিষন্ন ছায়া মুছে দৃঢ় হওয়ার চেষ্টা করি। রত্মের ফোকলা হাসি, বউয়ের বিষন্ন মুখ সামনে রেখে নিজের ভদ্রতার মুখোশ আড়াল করতে গিয়ে দম আটকে যায়। তবু নিজেকে বলি, কে কাকে চেনে এখানে? সবার দৃষ্টি তো পোটলার দিকে। কিন্তু চূড়ান্ত পদক্ষেপের বেলায় কেউ একজন কাঁধে চাপড় দিয়ে ওঠে, বন্ধু খবর কী?
পাশে নভোচারির পরিহিত পোশাকের মতো একজনকে দেখে আঁতকে উঠি। মুখ উন্মোচনে দেখি জাহাঙ্গীর। খন্দকার জাহাঙ্গীর! সৌম্য দর্শন, পুরনো বিতলামি হাসি। বলি, কীরে, আকাশ থেকে নামলি?
ক্ষ্যাপা হাসিতে তাকে উন্মাদ বোধ হয়। চিরকালই এমন সে। সময়ের চেয়ে এগিয়ে – ইঁচরে পাকা। আমরা বড়দের দেখে সালাম অথবা না-দেখার ভান করে এড়িয়ে যেতাম আর জাহাঙ্গীর আড়াল থেকে এগিয়ে তাদের গা ঘেঁষে বসত। কেউ ভর্ৎসনা করতো, তো কেউ খাতির। আমরা ফোঁড়ন কাটলে বুক উঁচিয়ে বলতো, আমি কখনও তোদের কাকু, কখনও বন্ধু।
জাহাঙ্গীর আমার কাঁধে হাত রাখতে গেলে আমি এড়িয়ে যাই। অট্টহাসিতে বলে, পুরনো অভ্যাস। সামাজিক দূরত্বে আছিস নাকি?
কেন, তুই নেই? পিপিই পরে আছিস কেন?
কী বলিস, পরবো না? জনপ্রতিনিধি, আক্রান্ত হলে জনসেবা করবো কী করে?
উত্তরে পা চালায় সে। অগত্যা আমিও তার পিছু ধরি। বলে, চল, ঐ ঘুমটা-মারা টঙের আড়ালে যাই। চুরুট টানবো। তুইতো আগের ব্র্যান্ডেই?
আর ব্র্যান্ড, লকডাউনের শুরুতেই চুরুট-মুরুট ছেড়ে দিয়েছি; বলি, কিন্তু চারিদিকে অজস্র কণ্ঠের মতো হট্টগোলে মিশে যায়। ধীরপায়ে টঙের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। জাহাঙ্গীর পিপিই’র ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা প্যাকেট বের করে নড়চড়া করে। ধ্যেৎ বলে ছুড়ে ফেলে পাশের ড্রেনে।
বুঝলি সব শেষ হয়ে যায়। এই যে ট্রাকভর্তি ত্রাণ, দেখবি শুয়োরের বাচ্চারা সব নিয়ে যাবে।
শুয়োরের বাচ্চা বলছিস?
নয়তো কী? এইযে দেখ, নিজের হাতে গোল দাগ দিয়ে দিলাম নিরাপদ দূরত্বে থেকে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য। শালারা করলো টা কি? সবগুলো একসাথে খিচুড়ি পাকিয়ে ফেলল।
সিগেরেটের অর্ডার দেয়। একটা আমি ধরাই, একটা ও। হট্টগোলটা ছড়াতে থাকে। বেশ শব্দ আসে কানে। ট্রাকের উপর থেকে দুইটা লোক ত্রাণের বাঁধা-ব্যাগ দেওয়ার আগেই চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। বোঝা যায়, যার গায়ে শক্তি বেশি তার মুখের হাসি আগে।
দেখ দেখি কা-! বাঙালি এইজন্যই মরবে। এই যে এতো উপদেশ, এতো বিজ্ঞাপন, কে শোনে কার কথা? আরে বাবা থাক না কটা দিন ঘরে! এই একটু খাবারের জন্য দেখ কি হাঙ্গামা! মনে হবে দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে গ্যাছে।
দুর্ভিক্ষের বাকি আছে বলছিস? তাছাড়া হাঙ্গামাইতো ভালো। অর্ধেক ত্রাণ দিয়ে অজুহাতে ফিরে যাবি।
হা হা হা। তুই রাজনীতি করলে নিশ্চিত বিলিয়নিয়ার। হা হা হা। কিন্তু বন্ধু, এইটাতো সরকারী মাল না। পকেটের টাকায় কেনা।
বাম কানের উপর কিছু একটা পড়ে। হাত দিয়ে দেখি পাখির বিষ্ঠা। উপরে তাকাই, একটা কাক একটা ফিঙ্গিকে তাড়া করছে। অদ্ভুত। জাহাঙ্গীর লক্ষ করে। বলে, ব্যাপার কী? গণেশ দেখি পল্টি খাইল। তাই বলে গাধাদের মতো ভাবিস না এই ধাক্কায় চীন অ্যামেরিকাকে টপকে যাবে। আরে তোদের এতো উচ্ছ্বাস কীসের? চীন তোদের বাপ-দাদা? বেনিয়ার জাত, ব্যবসা ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না।
জাহাঙ্গীর এমনই। হঠাৎ এক কথার ভিতরে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে যায়। সম্বিৎ ফিরে পুরনো কথায় ফিরেও আসে। সিগেরেটের পোড়া অংশ টোকা দিয়ে ফেলে বলে, ও, যা বলছিলাম। আমার দোষ কি বল? বাপের সম্পদ বিক্রি করে তো আর জনসেবা করবো না। পাঁচটা দোকানে এক করে চেয়েছিলাম, দিয়েছে হাফ করে। ব্যবসা নাই, তাদেরই দোষ দেই কী করে?
হট্টগোলটা এবার নিয়ন্ত্রণহীন হলো মনে হয়। ধস্তাধস্তি চোখে পড়ে। মানুষ ছড়িয়ে পড়ার ফলে সুবিধে হলো, এইবার জটলাটা আর নাই। কিন্তু মানুষের সংখ্যা ঢের বেড়েছে। বাইরে থেকে উৎসুক জনতা নিচে নেমে আসে। জাহাঙ্গীর খিস্তি করতে করতে তেড়ে যায়, এই জন্য ফকিন্নির পুতাইনদের জন্য কিছু করতে চাই না। খাড়া চুদনার পুতাইন।
আমি নীরবতাকে সঙ্গী করে চুরুট টানি। বাতাস নাই একফোঁটা। আঙুলের ফাঁক পর্যন্ত ভিজে যায়। মারামারি বিশেষ নাই, কিন্তু মাঠ রণক্ষেত্র। রণের ভিতর জাহাঙ্গীরকেই একমাত্র সৈনিক মনে হয়। পোশাকের জন্য তাকে আলাদা ভাবতে কষ্ট হয় না। তাকে উন্মত্ত দেখে কেন জানি হাসি পায়। দু’তিনজনকে দেখা যায় তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে দেয়। দ্রুতই ত্রাণবাহী ট্রাকটাও চলে গেলে আমিও পা বাড়াই। দোকানদার ছেলেটা বলে, স্যার চুরুটের ট্যাকা?
আমি ভিড়মি খাই। কিন্তু স্বাভাবিক কণ্ঠে বলি, কতো?
আটাইশ ট্যাকা।
পকেট ফাঁকা করে একটা বিশ আর একটা দশ টাকার নোট দিলে সে দুই টাকা ফেরত দেয়। যেন কিছুই হয়নি; জিজ্ঞেস করি, বিড়ি কতো করে?
মাল তো আইয়ে না। এক পিস দুই ট্যাকা।
আচ্ছা, একটা বিড়ি দাও।
মনে হয় দোকানদার বিভ্রমে পড়ে। হা করে তাকিয়ে থেকে দেয় একটা। জ্বালিয়ে টঙের পিছনে গলির পথ ধরি। একটা হলুদরঙা বাড়ির ভিতর উচ্চস্বরের খিস্তি শোনা যায়। ৫-৮ বছরের দুটো বাচ্চাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াতে দেখি। লকডাউনে পারিবারিক কলহটা বেড়েছে খুব – ছোটলোকদেরটা জানালা গলে রাস্তায় আসে, ভদ্রলোকদেরটা দেয়ালের ভিতর তরপায়।
উত্তপ্ত রোদের নিচে সিগেরেট, তারপর উচ্চ নিকোটিনের বিড়ি – মাথাটা ঘুরে, কান ভারিবোধ হয়। দু’কানে আটকে থাকা মাস্ক খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিই। সম্ভবত ঘোরে থাকা একটা নেড়ি কুকুর সেদিকে লাফ দিয়ে পড়ে। ঘোর চোখে তাকাই। তুলনায় বড় আকারের কঙ্কালসম কুকুরটাকে আমি চিনি। সুঠাম দেহের বাঘা নামে পরিচিত ছিল। বাঘা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়। দ্রুত এসে পায়ের কাছে কুঁই কুঁই করে। আমি পকেটে দু’হাত ভরে খাটিয়ায় লাশবাহী মানুষের মতো এগোই। অকস্মাৎ বাঘা বেঘোরে দৌড় দেয়; কিছু একটার উপর পুনরায় লাফিয়ে পড়ে। একটা কাক কা কা চিৎকারে বিদ্যুতের তারের উপর গিয়ে বসে। দেখি বাঘা কাকের ফেলে যাওয়া কালোমত কিছু একটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। লেজ দেখে আন্দাজ করি এটা ফিঙ্গি।
কাকটা কা কা শব্দে আকাশ মাটি এক করে তুলছে। মাথাটা ঘোরে আর ভোঁ ভোঁ করে। ডানের গলি ধরে দ্রুত হাঁটি, কিন্তু পা চলে না। ড্রেনের প্রাচীরে ছোটবেলায় চুল কাটতে গিয়ে নাপিতের সামনে দু’হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে দেওয়ার মতো বসে পড়ি। চেষ্টা করেও মাথা তুলতে পারি না। মনে হয় অসংখ্য কাক আমার ন্যূব্জ মাথা ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে।
অনিন্দ্য আসিফ : কবি ও গল্পকার।