ঈদ সংখ্যা ২০২০

অস্তরাগ ।। সৈয়দ কামরুল হাসান

নরসুন্দা ডটকম   মে ১৭, ২০২০
অস্তরাগ

ক্যামেরা চলছে, চ্যানেলের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে স্থান বদল করতে গিয়ে কিঞ্চিৎ ধাক্কাধাক্কি। সবাই চাইছে প্রধান অতিথির কত কাছাকাছি যাওয়া যায়। ভীড়ের বাড়াবাড়ি ঠেকিয়ে দিতে পুলিশকে তৎপর দেখা গেলো। শেষ বক্তা বলছেন তখন, তারপরই বলবেন আজকের সভার প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রী !

বিশেষজ্ঞ-পঠিত মূল নিবন্ধ পড়া হয়ে গ্যাছে। বিষয় : বাকস্বাধীনতা ! তার ওপর কিছু ভালো আর কিছু মন্দ মিশিয়ে শেষ বক্তার মন্তব্য একটা ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে চলছে। উপসংহার টানার তেমন কিছু নাই বলে সংবাদকর্মীরাও হাত গুটিয়ে বসে আছেন। শেষ কথা বলবেন মন্ত্রী নিজে।  মন্ত্রীর পালা আসার পর আবার একটু হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে সবার নি:শ্বাস প্রশ্বাস ও নড়াচড়ার মৃদু খসখসে আওয়াজ ছাপিয়ে একটা গুনগুন ধ্বনি পাতলা একটা পর্দার মত ঝুলে রইল খানিক ক্ষণ, মন্ত্রী গলা খাঁকারি দিয়ে যেন তাকে তাড়িয়ে কথা শুরু করলেন! আর দ্যাখো কিনা সেই মূহুর্তেবেজে উঠলো টেলিফোনটা! পকেটের একদিকে হেলে-পড়া সরু লম্বাটে সেল ফোনটা এতক্ষণ চুপচাপ তো পড়েই ছিলো! তা রক্ষা যে, ফোনটা সায়লেণ্ট মুডে রাখা অর্থ্যাৎ যার বাকস্বাধীনতা আপাতত রুদ্ধ! মন্ত্রীর বক্তব্যশেষে কে আর শুনবে সভাপতির সমাপনী বয়ান; বক্তব্যের কোন উপসংহার যেহেতু নাই, সবাই বেরিয়ে যেতে ভীড় জমালো ছোট গেটের মুখে। আবারও সেল ফোনটা থরথর করে কেঁপে উঠল পকেটের কোণে বার কয়েক; কিন্তু ভীড়ের চাপে তা বের করে দেখার উপায় কি ?

কয়েক ঘন্টা পর। চারতলায় নিজ অফিস ঘরে উঠে জানালার পাশে দাঁড়ালে এক পশলা বাতাস, আকাশও পাওয়া গেলো একটুখানি। তারপর দৃষ্টি প্যান করে নিচুতে নেমে এলে দ্যাখা যায় ধূলি ধূসর সড়কে মানুষ ও গাড়ীঘোড়ায় কিমাকার একটা ভয়াবহ জন্তু যেন গড়িয়ে চলছে। এবার অপরিচিত নাম্বারে কলব্যাক করে দেখা যাক।

কে? —-জী, হুঁ বলছি। কে – বলছেন —

আমি, আমিবলছি! নারীকণ্ঠ প্রথমে অপরিচিত ঠেকলেও, গলাটা ভারী হতে গিয়ে লঘুতে শেষ হওয়ার মুখে চেনা গেলো। একটু ভারী আর ফ্যাঁশফ্যাঁসে শোনালো যদিও, তবুও ঠিক চেনা গেলো।

এ্যাদ্দিন পর! হ্যাঁ, তা কুড়ি বছর তো হবেই! না ২২ বছর!কি, খুব অবাক হচ্ছো ? দুশো কিলোমিটার দূর থেকে ভেসে-আসা আওয়াজ। কেউ যেনো ফিসফিস করছে; জল-হাওয়া-মেঘ-রোদে ছাওয়া একটা টানেল পেরিয়ে আসছে দূরাগত ও ক্ষীণ গলার অওয়াজ।মনে হলোপানি কেটে এগুচ্ছে একটা শীতার্ত ভয়ার্ত পাখী। একটু যেন হাঁপাচ্ছেও!

কি খবর, আছো তো ভালো?
আমার মোবাইল নাম্বার কোথায় পেলে?

মিনিট দুই কথা হবার পর লাইন অফ; আবারডিসকানেক্টেড ! কলব্যাক করেও পাওয়া গেলো না।

প্রথম কলটির পর লম্বা একটা বিরতি। বেশ ক’দিন।

আর তখুনি মনে মনে ভাবনাটা এসেছিল: একবার যাওয়া যায় না সেখানটায়? চটজলদি পরিকল্পনা , ২দিনের ছুটি ম্যানেজ করে পথে নেমে পড়া।

দুই.
বিকেলের রোদ প্ল্যাটফর্মের নতুন চুনকাম করা দেওয়ালকে পাশ কাটাতে গিয়ে তেরছা হয়ে পড়েছে। স্টেশনের সাইনবোর্ডটা মেঝেঘষে একটু চকচকে হয়েছে বটে, কিন্তু তার পাশে নিমগাছটা রয়েছে সেই সাবেকি- শীতের আগেভাগে কিছু পাতা ঝরিয়ে দিয়ে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে দুটি পাখী-শালিক কি চড়–ই-কংক্রীটে নেমে খুটছে কিছু ওরা এখন। আরো ২টো দোকান বসেছে, আগেরটা তো আছেই।

নতুন প্ল্যাটফর্মের সাথে মিলিয়ে চায়ের দোকানটাও বদলে নিয়েছে নিজ অবয়ব-কাঠপোড়ানোর সেই ধোঁওয়াভরা চুল্লীটাই যে নেই।এখন বোধহয় বসেছে গ্যাস চুল্লী ! ঝকঝকে একটা ফ্রীজ, পাশে কাঠের ফ্রেমে আটকানো টিভিতে কিছু একটা চলছে। দাড়িভরা মুখের সেই বুড়োটার বদলে ক্যাশবাক্স আগলাচ্ছে ছোকরা বয়সী একজন, হবে হয়তো ওই বুড়োর নাতি কিংবা নতুন কোন মালিক। কিন্তু ওই কাঁঠাল গাছটাই বা কোথায় গেল? কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে, আবার কিনা পাগল ঠাউরে বসে! স্টেশনে নেমে সবকিছুর পরিবর্তন দেখবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে এতটা !

এখানেইতো ছিলো কাঁঠাল গাছটা; এখন দুপুরের তেজ হারিয়ে মরা রোদ থমকে আছে যেখানটায় !এই তো বাইশ বছর আগের এক বিকালে দাশবাবু তাড়া লাগাচ্ছেন পুরো দলটাকে। একটু আগে গাঁয়ের এই একটেরে স্টেশনে দলটাকে নামিয়ে দিয়ে হুঁইসেল বাজিয়ে ধোঁওয়ার আড়ালে মিলিয়ে গেছে ভৈরব লোকাল। “চল চল মা, পা চালিয়ে চল, এখন গরুর গাড়ি দুইটা পাইলে হয়। মধ্যিখানি আবার খাল। যাইতে যাইতে রাইত হ্ইবে কিন্তুক; কি পারবি তো, আবার ভয় পাইবিনা দেহিস কইলাম”- চশমায় লেগে-থাকা ট্রেনের ধোঁওয়া মুছে নিয়ে একমুখভরা পাকা দাড়ির ঘন জংলা থেকে দলটির দিকে দৃষ্টি মেলে ধরেন দাশবাবু।

বলতে গেলে তিনিই এই দলটির দলনেতা! স্টেশন থেকে পুরানো ব্রক্ষপুত্রের তীরের বড় বাজারেরদিকে মাটির নতুন রাস্তায় ২টি গরুর গাড়ি চাকার রেখা ফেলে হেলে দুলে এগিয়ে যায়। ছইয়ের ঘেরাও দেয়া একটি গাড়িতে ২টি সদ্য যৌবনা তরুণী, অন্য গাড়িটায় মালপত্তর সমেত আরো ২ তরুণ, যাদের কি না গোঁফ দাড়ি সেভ করা সবে শুরু হয়েছে। ২টি তরুণী, ১টি অপরটির তুলনায় লম্বা, গড়নে চওড়া গাঁথুনীর। ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলে হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। দাশবাবু ছইয়ের এককোণায় সিঁটিয়ে থেকে পরখ করতে চাইছেন অত হাসাহাসির কারণ কি থাকতে পারে !

ওদিকে পেছন পেছন আসা ছোকরাদের গাড়ি একটু পিছিয়ে পড়েছে। আর কোনও গাড়ি নেই পথে, এমনকি মানুষও। পথ যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানটায় জংলামত এলোমেলো ক’টি গাছ, নিচে ধূসর লম্বা লম্বা ঘাস, তার রুক্ষতা বুঝি পুষিয়ে দিয়েছে ভাঁট কিংবা নাম না জানা আরো কত চেনা অচেনা বুনো ফুল। একটি পত্রহীন শিমূল গাছের কয়েকটি কাঁটাভরা ডাল ঠেলে লাল লাল ফুলের কচি মাথাগুলি সদ্য উঁকি দিয়ে বিকেলের আলোয় যেন কাঁপছেমৃদু মৃদু। দুই পাশের ধান কাটা শীতবিকেলের মাঠ নানান আনাজের ফলনে সবুজ। গোধূলির আলো মেখে মাঠ থেকে হাওয়া উঠে এলে হঠাৎ কিছু শুকনো ধূলো উড়ে পথের বাঁকে; সে এমন কিছু নয়। হাওয়ার তালে গাড়িয়াল গরুর পিঠে বেত ফেলে মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করে- হোই, চল, চল, তাগদা চল। ১০-১১ মাইল পথ। সন্ধ্যার আগে পৌঁছানো যাবে কিনা কে বলবে ! ছইয়ের আবডালে তরুণীরা আরো প্রগলভ হয়ে উঠলে দাশবাবুর ঘুম পায়।

পেছনের গাড়িটাও এখন কাছাকাছি দূরত্বে, সেখান থেকে বসে ঠিক বোঝা যায় না বুড়োটা কি মটকা মেরে পড়ে আছে, নাকি গাড়ির দুলুনি আর ফিনফিনে হাওয়ার ঝিমুনিতে সত্যি সত্যি ঘুম পেয়েছে তাঁর ! মাথায় লম্বা আর গড়নে শক্তপোক্ত তরুণটি যে কিছু একটা বলার লোভ সংবরণ করছে সামনের ওই গাড়িটার দিকে তাকিয়ে সেটা তার সহযোগী কিঞ্চিৎ কৃশকায়তরুণটি বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়।

এলোমেলো ভাবনায় কপাল জুড়ে ভাঁজ পড়ে ওর। আরেপিতৃদেবের সিনিয়র সহকর্মী দাশবাবু অবসরজনিত ছুটিতে তাদের সাথে এসেছে তো ২ তরুণীর ১টি তাঁর নিজের মেয়ে বলে। এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দায় মেটাতে এসেছেন তিনি ! আর তুই তো আইছস পাহারাদার অইয়া! তোকে তো আনলাম আমি- অংক -ইংরেজিটা তুই বুঝিয়ে দিবি, আমার ছোট বেলার দোস্ত, হোস্টেল থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছিলি, তা ফুফুকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে আমিই না তোকে নিয়ে এলাম; আমার একটু সাহায্য হবে। আর তুই-ই কিনা আমার বোনটার মাথা চিবিয়ে খেলি! আর মেয়েটাও যেন কেমন, বেহায়ার মত পেছনের গাড়িটার দিকে তাকিয়েই সারা পথ হেসে গড়িয়ে পড়ছে ! অত হাসির কি হলো! -কৃশকায় সহযোগী নিজ মনে গজরায়।

গড়িয়ে-চলা গাড়ির চাকার সংঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাগ বাড়ে, বেহায়া বন্ধুর সংঙ্গ যেন অসহ্য লাগে তার! আরে নেহায়েৎ সরকারদের প্রতিষ্ঠিত বৃটিশ আমলের বনেদি স্কুল বলে, এই অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলটায়ও যে মাধ্যমিকের একটা সেণ্টার আছে -এইসব খবর কে এনে দিয়েছিল তোদের! ফুফাতো বোনটা এসএসসিতে ফেল দিয়ে বসে আছে ঘরে, শহরের কোন স্কুলে পরীক্ষা দিলে সুবিধা হবে না। ফুফু তাই তাঁর মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করার ভার তো দিয়েছে তাকেই।

আজকাল অন্ত:তপক্ষে এসএসসি পাশ না হলে পাত্র কোথায় ! সে-কথায় সায় দিয়ে দলে এসে জুটেছেন মালগুদামের সদ্য-অবসরে যাওয়া ওই কেরাণী দাশবাবু; জীবনসীমান্তে মাধ্যমিক-ফেল নিজের মেয়েটাকে নিয়েও যে তিনি অথৈ জলে! শেষে কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপ করে স্কুলের হেডস্যারকে পটিয়ে ওদের ফরম ফিলাপের ব্যবস্থা করা, এমনকি পরীক্ষা দিতে এসে এই যে থাকার জন্য ওরা কয়েকদিনের মাল পত্র নিয়ে আজ রওয়ানা হয়েছে, সেখানকার নিরাপদ ব্যবস্থাপনাও তাকেই সামলাতে হয়েছে; আরে দেখে শুনেচেহারায় তাকে পছন্দ না হতে পারে, ফুফু কিন্তু পাকা জহুরী; এমনি এমনি কি ওর হাতে সঁপে দিয়েছে মেয়েটার ভার !

ফুফুর কি ভালো মন্দ একটা পরিকল্পনা নাই তাকে নিয়ে! এখানে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে দাশবাবুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হয়েছে তাকেই, কিন্তু, তুই যে আমার জিগরি দোস্ত কই একবারওতো কারুর মনে হয় নাই তোর কথা !

দেখতে দেখতে খাল এসে পড়ে। শেষ শীতের মরা খাল। পুরাতন ব্রক্ষপুত্র থেকে বেরিয়ে এসে গাঁও গেরামের মাঝ দিয়ে কয়েকটি মোচড় খেয়ে দূরে কোথাও উধাও হয়েছে। গোধূলীর আকাশ থেকে ঝরে-পড়া লালচে আবীর যুৎসই জল খুঁজে না পেয়ে শাদা বালিয়াড়িতে পড়ে উসখুস করে – ক’টি পাখি পাখায় বুঝি তা মেখে নিতে হইচই ফেলে দিয়েছে। গরুর গাড়ির বহর দেখে ওরা সাঁ করে উড়ে গেল দূর আকাশে আঁকাবাঁকা রেখা এঁকে। গাড়ির চাকার অস্পষ্ট রেখা পড়ে বালিয়াড়ির ওপর। এবার দূরের আবছায়ায় কালচে রংয়ের জনপদ স্পষ্ট হয়-একটি ২টি আলো জ্বলে উঠছে আর ঢেকে যাচ্ছে ঘর বাড়ি গাছগাছালির আলাদা আলাদা আদল। সন্ধ্যার আকাশ জুড়ে ফুটে ওঠে কয়েকটি আলোর ফুল। বড়বাজারের আলো। খাল পেরিয়ে ওদিকেই যাবে গাড়ি !এবার থামে গাড়ির বহর। দলটাকে গাড়ি থেকে নামতে আদেশ করলেন দাশবাবু : “নাইম্যা পড় মা জননীরা।”

নিজের মেয়েকে সাবধানে ধরে নামালেন, পেছন পেছন নেমে এলো লম্বাটে গড়ন চওড়া গাঁথুনির ফুফুর মেয়েটাও। “তোমরা নদীটা হাঁইট্যা পার অও, পানিতো নাই -দেখো শুধু বালি।”
“এইটা নদী না খাল, অ গাড়িঅলা ?
“খাল না নদী কে বলবে, পানি আসে ওই বর্ষায়, থাকে দুই মাস -” গাড়িওয়ালার জবাব দায়-সারা।

পেছনের গাড়ির চালকটি তারই ছেলে, বাপের পেছন পেছন সে খুব দেখেশুনে সতর্কভাবে গরুসমেত গাড়িটি নিয়ে বালিয়াড়ি পাড়ি দেয়। দাশবাবু যে বালি থেকে বাঁচাতে নিজের ঢোলা পায়জামাকে হাঁটু অবধি মুড়ে বেঁধে নিয়েছেন তা দেখে দলের বড় তরুণটি (যার ওপর তীব্র হয়ে উঠেছে ওর বন্ধুর রাগ) মনে মনে বুড়োর বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না! কিন্তু তার সহযাত্রী বন্ধুটির নজরদারি তাকে কিছুতেই যে মেয়েদের কাছাকাছি হতে দিচ্ছে না !

আরে বন্ধুর ফুফাতো বোন হলে তো বাড়তি সুবিধাই হবার কথা, কিন্তু সে কি সহজে হবার! সবসময় চোখেমুখে আগলে রাখছে, আপাতত মনে হচ্ছে ফুফুর কথার কোন নড়চড় হতে দেবে না সে ! আরে আমি কি আর বুঝি না তোর চালাকি? তা সে কি নিজে যেচে এসেছে? হোস্টেল থেকে বাড়ি এসেছিল ছুটি কাটাতে, তুই ই না “ছেলেবেলার দোস্ত” দোহাই দিয়ে, অংক-ইংরেজি বোঝানোর জন্য একটা মাস্টার চাই এই দলে -এরকমভাবে বলে বলে তোর ফুফু ও দাশবাবুকে বুঝিয়ে আমাকে দলে নিয়েছিলি। এখন তাহ’লে ছাত্রীদের সাথে না মিশতে দেবার হেতু কি?

২টি গরুর গাড়ি বাজারের মুখে এসে যখন থামে তখন রাত নেমেছে। ক’পি-হারিকেন-হ্যাজাক বাতির মিশেলে আলোছায়াময় বাজার জুড়ে মানুষের ব্যস্ত চলাচল- আলোর এলোমেলো প্রক্ষেপণে ওদের মুখোশআঁটা মনে হয়। গলা উঁচু করে কেউ একজন জানতে চায় – কই যায়, ট্রেণের যাত্রী বুঝি ? কার বাড়ি? গাড়িওয়ালা জবাব দেয়: হ, আমরাগো —, সরকারগো বাড়ি যাই ।

তিন.
সেই কাঁঠাল গাছটা তো নেই ই, তার পেছনে যে ১টি কামিনী ও আরো ২টি কলার ঝোপ ছিল সেগুলো সবি গেছে -পুরো জায়গাটা মুড়িয়ে নিয়েছে কংক্রিটের ঢালাই। স্টেশনটা দক্ষিণ দিকটায় আরো অনেকখানি সম্প্রসারিত হয়েছে। আর যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই ২টি গরুর গাড়ি? হ্যাঁ, বাইশ বছর আগে? এখন সেখানে রিকশা, ভটভটিরভীড়, কয়েকটি হোটেল-রেস্তোরা আর মুদীখানায় কিলবিল করছে মানুষ। সেই ধূলি-ওড়া পথ এখন দিব্যি পাকা, পাতলা পিচের আবরণে ছাওয়া। একটা ভটভটি চালু হতে না হতে ধোঁওয়া ও শব্দে বুঁজে এসেছে চারিদিক, ক’জন প্যাসেঞ্জার বসিয়ে আরো কজন যাত্রীর আশায় ইঞ্জিন চালু রেখেই তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ছোকরা হেলপার। মাত্র আধা ঘন্টায় উপজেলা সদর !

বরং রিকশা নেওয়া যাক। দুই পাশ থেকে সামান্য উঁচু রাস্তাটির পিচ এখানে ওখানে উঠে যাওয়ায় রিকশাঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোয়। তবু স্মৃতি রোমন্থন বাধাপ্রাপ্ত হয় না। স্মৃতি মানে কি ? পথটাকে উল্টে পাল্টে দেখা ! দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। দুই পাশের সেই জনহীন সবুজ মাঠ অনেকখানি সংকুচিত। জনবসতি মাঠের সবুজ শুষে নিয়ে রাস্তায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কাঁটামেহেদির বেড়ায় সীমানা টেনে খড় ও টিনের ছাউনি তোলা ছোট ছোট ঘরগুলি – বেড়ায় লেপ্টে আছে সিনেমার রঙিন পোস্টার, ইলেকশান কিংবা ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত। মাঝে মধ্যে পাশ ঘেঁষে সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে উপজেলা সদর থেকে আসা ২/১টি মটর বাইক -কানে-গোঁজা মোবাইলে কথা চালিয়ে যাচেছ বাইকের কুশলী চালক।

কোথায় সেই মোড়ের ধারের শিমূল গাছটি -তার নিচে খয়েরী ঘাস আর বুনো ফুলের ঝোপঝাড় ? এখানে তো দেখছি দিব্যি একটা ছোট বাজার – চা-দোকান,আরো ২/১টি মনোহারি দোকান,১টিতে ব্যাটারী দিয়ে চলছে টিভি, কাঁচ-ঘেরা ১টি খুপরীতে ফ্লেক্সি-লোডের ব্যবসা। “এমপি সায়েব না অইলে আমগো দুর্গতির সীমা থাকতো না, এই রাস্তা ঘাট ,এই রমরমা যা কিছু দেখতাছেন সবি এমপি সাবের দান”- রিকশাওয়ালার গলা উচ্ছাসে বুঁজে আসে। আরে সেই খালটা না ! রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে -“এই যে খালের ওপর পুলটা দেখতাছেন এমপি’র নিজের পয়সায় করা ভোটের আগে আগে। ” কিন্তু কোথায় সেই বালিয়াড়ি – শীত বিকেলের মায়াবী গোধূলীতে সেই যে পাখীরা হুটোপুটি খেয়ে ডানায় আবীর মেখে উড়ে গিয়েছিলো! এখানেই তো হাওয়া টেনে এনেছিল চুল থেকে চুঁইয়ে-পড়া একটা অচেনা ঘ্রাণ- নাকে এসে লেগেছিল! আচ্ছা, এখান থেকে ফিরে গেলে কেমন হয়! কী লাভ হবে ওখানটায় গিয়ে; কী সন্ধানেই বা যাওয়া?
“স্যার কি একটু শরীল গরম কইর‌্যা লইবেন, খাঁটি দুধের চা খাইয়া লন একটু ।”- রিকশাওয়ালার কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে। “না, চল আমাকে তো ফিরতে হবে আবার! ” “হেইডা লইয়া চিন্তার কিছু নাই, রাইত ১০টা পরযন্ত ভটভটি পাইবেন, আধা ঘন্টায় রেল ইস্টিশান ”- উজ্জীবিত গলায় সাহস যোগায় তরুণ রিকশাচালক।

পুলের ওপারে, সন্ধ্যার পটভূমিতে পল্লীবিদ্যুতের আলোয় ফুটে উঠে সেই বাজারটি। এখন উপজেলা সদর। রিকশায় বসে চোখে পড়ে নানাবিধ টাওয়ার, আরো এগুতে সাইনবোর্ড, চটকদার সব হোল্ডিং। সরাসরি বাজারের দিকটায় নয়, বাজারকে বাঁয়ে রেখে গাছগাছালীভরা একটা পথে নেমে গিয়েছিলো গরুর গাড়ি দু’টি। হ্যাঁ, মনে পড়ছে ওখানেই তো ছিল সরকারদের ছোটতরফের দালান, নাটমন্দির, পুকুর ঘাট। চৌষট্টির দাঙ্গায় বড়তরফ, একাত্তরে মেজো ভারতে গিয়ে স্থায়ী হলেও ছোটতরফ “সংগ্রামের” পর আবার ফিরে এসে কয়েকটি ঘরে দিব্যি সংসার পেতেছিল। বাজারে তাদের পাটের গুদাম, কাপড়ের ব্যবসা। ওদেরই দালান লাগোয়া বিশাল অব্যবহৃত বৈঠকখানা ছেড়ে দিয়েছিল খোদ হেডস্যারের অনুরোধে পরীক্ষা দিতে আসা ওই পরিবারটিকে। জেলা সদর থেকে আসা সজ্জন সরকারী অফিসের “মালবাবু” (কেরানী) দাশবাবুর কাছে ব্যবসার ভালো মন্দ কাজে সরকারদেরও যেতে আসতে হয়েছে। তা দুটি মাত্র মেয়ে , নিজেরাই রান্না করে খাবে, ক’দিনই বা থাকবে, পরীক্ষাটা দেবে , এই তো ?

“কি কইলেন, অহন যাইবেন অইখানে!”- সরকার বাড়ি যাবার প্রস্তাবে রিকশাওয়ালা যারপরনাই বিস্মিত হয়। তার বিশ্বাস হয়না।ওইদিকটায় ইতোমধ্যে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। তবে অন্ধকার হলেও আবছায়ায় দেখা যায় ইট বিছানো রাস্তা দুই পাশে কয়েকটি বন্ধ পাটগুদামে চাপ-ধরা সরু গলি পেরিয়ে ফের মাঠের ধার ও তার ওপারে মরা নদীটির তীর পর্যন্ত চলে গেছে। আগে এদিকটায় ছিলো বাজারের প্রধান অংশ, এখন নদী মরে গিয়ে বন্দর পরিত্যক্ত হলে অনেকখানি সরে গিয়ে নয়া বাজার-বসতি গড়ে উঠছে উপজেলা সদরের দিকটায়। রিকশা এসে থামে সরকারদের ভিটায়। সরকারদের ভিটা এখন পরিত্যক্ত। “ছোট কর্তাও চইলা গেছে ভারতে সেই মচজিদ ভাংগার পরে পরে, কাউরে বইলা যায় নাই”-রিকশাওয়ালার সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট।
অন্ধকার এখনও ঘন জমাট-বাঁধা নয়। নিচু ছোপ ছোপ ঝোপ-জঙলার আড়ালে আবডালে ২/১টি ছোট ছোট ভিটা থেকে ছিটকে-আসা আলো আর মানুষের গলার স্বর অন্ধকারে যেন জোনাকীর আলো; ফুলকি ছড়িয়ে মিলিয়ে যায়। কেবল পেছনের বাঁশঝাড়সমেত সরকার বাড়ির বড়সড় বাগানটিতে অন্ধকার নিজ মহিমায় থিতু হতে পারে, সেইখানে মেলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রিকশা থেকে নেমে খানিকদূর হেঁটে গেলে, ততক্ষণে  কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠে এসেছে, তার লালচে আলোয় স্পষ্ট হয় বৈঠকখানার চৌচালা ঘরটা-এখন অনেকটাই ঢেকে আছে বুনো লতায়-ঢোলকলমী, মানকচু, আশশ্যাওড়ার ঝোপে ! “এখন দিনের বেলায়ও কেউ আসে না সাপের ভয়ে স্যার। গত বারের আগের বারে মতিন দরজির বড় বেটির লাশ পাওয়া গিছলো ওই জঙলায়, কেউ বলে ফাঁস নিছে, কেউ বলে মেরে ফেলে রেখেছে, তাপ’র এই রাস্তায় চলাচল আমরা ছাইড়্যাই দিছি। ”-

রিকশাওয়ালার মৃদু মন্তব্যেও চিন্তায় ছেদ পড়ে না। ততক্ষণে গরুর গাড়ির চাকার আওয়াজ মাথার ভেতরে গড়িয়ে চলে।কতদিন কাটিয়া গিয়াছে? একদা নিশীথে এইখানে তো বসিয়াছিলাম আমরা! চাঁদ উঠিয়াছিল ফাল্গুনের, সেই চালতা গাছটির ফাঁকে, তারপর উঠিয়া আসিয়াছিল এই বৈঠকখানায়। হ্যাঁ,বৈঠকখানা বাহিয়া তোমার মুখে খেলা করিতেছিল চাঁদ। চাঁদের গায়ে চাঁদ –! আর কোথা হইতে লেবুফুলের গন্ধভরা হাওয়া আসিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দিয়াছিল তোমার কাজল কেশদাম। ফাল্গুনের মাঠে পড়িয়া থাকা ফিনফিনে চাদরের ওমগায়ে মাখিয়া সোনাতলী আশ্রমের কীর্তন আসিয়া ভাসাইয়া দিয়াছে জ্যোছনাধোয়া বৈঠকখানা, আঙিনা, সরকারবাড়ির দরদালান । ওরা সব ঘুমাইয়া পড়িয়াছে-একটিমাত্র ঘরে কয়েকটি তক্তপোষে স্বপ্নহীন ঘুমে পাশাপাশি । কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা দাশবাবু, তাঁর কন্যা , এমনকি আমাদের ওপর দিনরাত্রির নজরদারি করিয়া ক্লান্ত তোমার ফুফাতো ভাইটি পর্যন্ত ঘুমে মরিয়া । শুধু আমরা বাহির হইয়া আসিয়াছি, ওই নিশীথ রাত্রির ডাকে । ভয়-ঘাম-অচেনা আনন্দ ! জ্যোছনার জলে পড়িয়া, ভাসিয়া, ডুবিয়া- একে অন্যের হাত ধরিতে গিয়া বুঝিয়াছিলাম কী অথৈ জলে ভাসিয়া গিয়াছি, মুছিয়া গিয়াছে তীরের চিহ্ণ- আহা -তাহার কোন তল নাই, কুল নাই, কিনার নাই!

চার.
টেলিফোন সংলাপের সময়টুকু যেন চামচে মেপে নেওয়া! তা ছাড়া আছে নানা রকম যুক্তিও। যেমন -“নিজের মত করে” কল করার অনুমতি নাই, “এটা বড় ছেলের সেট”। সুযোগমত কল করলে তবে কথা বলার সুযোগ মেলে। সকাল ১০টার দিকে কলটা আসে। সপ্তাহে ২/১ বার। কাঁচে-ঢাকা অফিস কক্ষের বাইরে রেলিং-ঘেরা খানিকটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালে সামান্য হাওয়া মেলে; একটু একাকীত্বও ! কলটা রিসিভ করে কানের কাছে পৌঁছানোর আগেই কথার তুবড়ি ছোটে অপর প্রান্তে – “আমার জামাই তো আমাকে ছাড়া অন্ধ, আমি রান্না করে দিলে তবে খাওয়া ! কয়-তোমার তো পোলা দুইডা না, আমারে লইয়া তিনখানা।” “ আমার শ্বাশুড়ী তো আমারে মা কইতে অজ্ঞান, বাড়ির পুকুরের মাছ, তরিতরকারি এমনকি গাইয়ের দুধ পর্যন্ত পাঠায়া দেয়। মফস্বল শহরে আমার বাসায় আসতে মোটে ১ ঘন্টার পথ। শ্বশুর চোখে দেখে না, তাতে কি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নাতীদের খবর রাখে। তাঁর বড় নাতীকে নিয়ে কতো যে আশা। ‘তোমার বর স্কুল মাস্টারিতে গেছে ,কিন্তু আমার নাতি হওয়া চাই কমের পক্ষে কলেজ মাস্টার।’ এইরকম কথা।” কথার পিঠে ২/১ টা মন্তব্য করারও জো নাই ! দ্রুত কথা শেষ করার তাড়ায় উপসংহার টানার আগেই আচমকা অফ হয়ে যায় লাইন। এটুকু কথা বলার জন্য এই ফাঁকটুকু বের করতেও অনেক কসরত করতে হয় অপর প্রান্তে। কাজের বুয়াটাকে দোকানে পাঠিয়ে, যখনছেলে ২টি স্কুলে ও কোচিংয়ে, জামাই যখন রোজকার কর্মস্থল স্কুলে তখুনি ফাঁক মেলে। তাও প্রতিদিন না, সপ্তাহে ২/১ দিন । ফের কয়েক মিনিটের কথার তুবড়ি। কথা বলা মানে আত্মকথন কিংবা স্বগতোক্তি। এই প্রান্তের কাজ শুধু কল রিসিভ করে মনোযোগ দিয়ে শুনে যাওয়া।

তা এইসব বলার জন্যই্ কি ফোন করা?
“আমার মোবাইল নাম্বার কোথায় পেলে?”
“কথা বলার জন্য অনেকদিন অনেক জায়গায় খুঁজে তবে তোমার বড় বোনের কাছ থেকে নাম্বারটা পেয়েছি !হায় রে কি সব দিন গেছে ,সত্যি কি পাগলামীই না করেছি আমরা- নাক টিপলে দুধ বেরুবে তখন কিনা ফন্দী এঁটেছি -হাত ধরে পালাবো!”
“তা, তোমারজামাই কি জানে এই সব ? ”
“নাহ, দিন রাত্র ছাত্র নিয়া তার কারবার। আমার হাতের দুইডা ডাইল ভাত পাইলে সে খুশি। এই কয় দিন ধইর‌্যা, আমার যখন ডায়বেটিস ধরা পড়লো আর ডাক্তারে কইলো হার্টে রিঙ পরাইতে অইবো তহন থাইক্যা দেখতাছি বড় মনমরা অইয়া গেছে বেচারা! ডাক্তার আমাকে রোজ ২ বেলা খাওয়ার আগে আগে ইনসুলিন নিতে বলেছে-তা, দেখো আমার গায়ে সামান্য সূঁচ ফোটাতে জামাইর হাত কাঁপে! বলে কি না-তোমার শরীল কষ্ট পাইলে আমারও শরীল কেমন করে ! এই তো দেখো না গত কাল থাইক্যা দাঁতে ব্যাথা শুরু হইছে –মাড়ির ২ডা দাঁত ফেলাইতে অইবো আগে। মানুষটার লাইগ্যা পরান পোড়ে আমার ! খালি পোলা ২ডার লাইগ্যা চিন্তা অয়,অল্প বয়সে মা হারাইবো — আহ –”

তা এইরকম সময়-মাপা টেলিফোন বয়ানে সেই গল্প ফিরিয়ে আনার সুযোগ কোথায় ? সেই জায়গাটায় সেদিনের আচমকাঘুরে আসা, সেই জায়গাটা যে সম্পূর্ণ পাল্টেছে, এখন যে তা ঢেকে আছে বুনো আগাছায়, সেই গল্প শোনানোর লম্বা সময় পাবার কি কোন জো আছে? না হয় কোনভাবে ওই ভ্রমণ-বিবরণী শোনানো গেলো , কিন্তুওপান্তের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তাতে ? কল্পনায় কত কিছু ভেবে নেওয়া যায়! আবার ২২ বছর পর যোগাযোগটা যেহেতু ঘটেছে, পুরা গল্পটা নূতন করে দাঁড় করানোর যখন একটা সুযোগ আজ দু’জনের সামনে, সম্পর্কটাও কি আবার ঝালাই হতে পারে না !এই তো মেঘ-বন্দী সেই চিঠিগুলি, ওর ভুল-বানানে আঁকাবাঁকা হরফে সাজানো চিঠিগলি বারবার বাসা বদল করেও দিব্যি রয়ে গ্যাছে কাঠের বাকসোয়!তার চিঠিগুলি কোথায়, আছে তো? নাকিসেইগুলি মেঘ হয়ে ভেসে গ্যাছে নি:সীমনীলিমায়? যখন কিনা কথা বলার কত কথা ছিল, অথচ পিতা মাতা পরিবার প্রতিবেশি সব দুয়ারে অষ্টপ্রহর খিল তুলে বসে আছে, দেখা-সাক্ষাৎ-জানাজানি এমনকি গরমের দুপুরে বাড়ির পেছনের ভ’তুড়ে জংলায় শ্বাসরুদ্ধকর চুম্বন কী দুর্লভ -তখনতো মেঘেই ছিল বাড়ি, হাওয়ায় ঘর বাঁধা ছাড়া তখন উপায় বা কি ছিলো ? মেঘে, হাওয়ায় নয়তো জ্যোছনায়, নয়তো কি? নিরুদ্দিষ্ট জীবনে দাঁড়াবার মাটি কই ? হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ, আর হঠাৎ ছিটকে-পড়া আরো অথৈ জলে ২ জন ২ দিকে ! কোথাও কি ভুল ছিল! আজ তবে সেই অসম্পূর্ণ গল্প ২ জনে মিলে আবার সম্পূর্ণ করা যায় না কি? একবার কি সুযোগ হতে পারে না বুনো আগাছা কেটে সাফ করে ফেলবার! আহা কল্পনায় কত কিছু ভেবে নেওয়া যায়!

পাঁচ.
এরই মধ্যে একদিন অফিস ঘরটায় বসের ডিকটেশন নেওয়ার ব্যস্ততা। দুপুরের মধ্যে বসের বক্তব্য লিখে দিতে হবে -প্রেস ফ্রিডম ডে উপলক্ষ্যে একটি দৈনিকে প্রকাশিতব্য ক্রোড়পত্রে বাকস্বাধীনতার উপর বসের যে লেখা ছাপা হওয়ার কথা তার মুসাবিদা। এন্তার পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি, গুগল সার্চ করো, ইউনেস্কো কি বলছে তা চেক করো, তারপর সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে-সেইভাবে লেখাটা রেডি করো। আর অমনি তখুনি দ্যাখো বেজে উঠছে ফোনটা ! বসের সামনে ডিকটেশন নিতে গিয়ে ভাগ্যিস টেলিফোনটা সায়লেন্ট মুডে রাখা। থিরথির করে কাঁপছে মাংশপেশী সমেত পকেটের খানিকটা অংশ, অনেকক্ষণ। তারপর আলগোছে বের করে নিয়ে গলাটা মুচড়ে দিলে নিথর হয়ে গেলো ফোনটা।

অনেকদিন কাটিয়া গিয়াছে। সেই নির্দিষ্ট নম্বর হইতে সাড়া পাইয়া আর ফোনটা বাজিয়া উঠে না। বহুদূরের টানেল বাহিয়া একটি শীতার্ত পাখী যেন জল কাটিয়া আগাইয়া আসিতেছে। তাহার আওয়াজ শুনিবার আকুল প্রতীক্ষায় প্রহর গড়াইয়া যায়।

সৈয়দ কামরুল হাসান : কথাসাহিত্যিক।
নরসুন্দা ঈদ সংখ্যার আরও লেখা পড়ুন…
লাল পাসপোর্ট ।। গাজী মহিবুর রহমান

About the author

নরসুন্দা ডটকম