ওপার বাংলার গৌতম অধিকারী সম্পাদিত গল্প বিষয়ক ত্রৈমাসিক সাময়িকী”গল্পদেশ” পাঠ শেষ করলাম। গল্প বিভাগে যাদের পাঠ করলাম তারা হলেন, রেজওয়ান তানিম, রাজেশ ধর, শুভ্রদীপ চৌধুরী, গৌতম রায়,শ্যামল সরকার,মাহবুব আলী, সঞ্জয় মৌলিক, পুরঞ্জন দাস, শান্তনু ভট্টাচার্য, অঞ্জন মজুমদার, সাদিয়া সুলতানা, অরণ্যা সরকার, কৌস্তুভ গাঙ্গুলী, রেদওয়ান খান, সুব্রত নাগ প্রমুখ গল্পকার।
বেশিরভাগ গল্গকারের গল্পকে গল্প মনে হয়েছে। তারপরও রেজওয়ান তানিমের “চন্দ্রাহত প্রহরে কেউ” গল্পটি নিয়ে একটু না বলে পারছিনা। কারণ গল্পটি একটু বেশি মনে দাগ কেটেছে। আর তা গল্পের বিষয়ের জন্য নয় বরং গল্পের ফর্ম বা আর্টের জন্য। অনেকটা গুণীজনের যাদুর স্পর্শে গল্পটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে—এ রকম বলা যায়। যার কারণে পাঠক পড়া মাত্রই আফসোস করবেন গল্পের সেই ভিলেন লোকটার জন্য। কারণ, এই গল্পের প্রধান চরিত্র ভিলেনই পাঠকের অন্তরে স্থান করে নেয়। অথচ সাধারণত গল্পের ভিলেনকে কোনো দর্শক হৃদয়ে স্থান দেয় বলে মনে হয়না। সেই ভিলেনই পাঠকের মানসপটে নায়ক হয়ে ওঠে—পাঠান্তে যখন হৃদয় হু হু করে মোচড় দিয়ে উঠে তখনই টের পাওয়া যায়। সেখানেই রেজওয়ান তানিম ব্যতিক্রম এই সংখ্যায়।
সংক্ষেপে বললে অনেকটা এভাবে— একটা ভাড়াটে খুনি। কখনো ক্ষমতাহীন আবার কখনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মিছিল, মিটিং ও ক্ষমতার দখলদারিত্বে ভাড়া খাটে। যার কিনা টাকার বিনিময়ে মানুষকে খুন করতে না পারলে শরীরের টগবগে ফুটন্ত রক্ত হিম হয়না। অথবা মানুষের রক্তে রাজপথ না ভাসাতে পারলে দুধ স্নান হয়না। যে পেটের দায়ে সে আজ ভাড়াটে সেই পেটের ভাত আবার চাপাতি দিয়ে মানুষের ধড় থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে হজম হয়না! অথচ সেই নৃশংস নিষ্ঠুর মানুষটিই কিনা এক মিছিলে বহু মানুষকে খুন করার পর যখন খালের জলে মুখে লেগে থাকা রক্তের দাগ গুলো একটু ধুয়ে নিজ ডেরায় দুধ স্নানে নিমগ্ন হয়ে শান্তির ঘুম দেবেন; ঠিক তখনই আগাম সন্ধ্যার একখানা পরিপূর্ণ দুধ শাদা বা হলুদাভ চাঁদে সে চন্দ্রগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে স্বচ্ছ জলে দেখতে পায় এতক্ষণ যাদেরকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। তারাই তাকে আবার ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। মূহুর্তেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষটি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেখে এতক্ষণ সে যাদেরকে খুন করেছে তারা আসলে সে মানুষটি নিজেই। জলে বহমান রক্তের ধারা তার নিজেরই। জলে ভাসমান কাটা মুণ্ডুটাও তার। এভাবে চলতে থাকে চন্দ্রাহত ব্যক্তিটির আরেক নির্দয়, নিষ্ঠুর প্রহরগুলো। এই প্রহর আর শেষ হয় না। এভাবেই গল্পকার রেজওয়ান তানিম এক সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণ করে তুলেছেন “চন্দ্রাহত প্রহরে কেউ” গল্পে। টানটান উত্তেজনায় কখন যে গল্পটা পড়া শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি। গল্পের প্লট নির্মাণ, কাহিনীর বয়ান ও দৃশ্যমান নাটকীয়তায় বুঝা যায় গল্পটি নির্মাণে যথেষ্ট যত্ন ও সময় দিয়েছেন গল্পকার। গল্পটি পুনঃপাঠের দাবি রাখে। আগামী বইমেলায় রেজওয়ান তানিমের গল্পগ্রন্থ ” অসুখগুলো প্রাপ্তবয়স্ক” এ হয়তো এই গল্পটিও থাকছে। সাথে আরো নতুন গল্পের পাঠের আশায় গ্রন্থটি সংগ্রহের অপেক্ষায় রইলাম। আশা রাখি গ্রন্থটি পাঠক নন্দিত হবে।
গল্পদেশের দ্বিতীয় গল্পটি রেদওয়ান খানের। রেদওয়ান খানের “ইহলৌকিক” গল্পের বর্ণনা ভালো লেগেছে তবে কাহিনী একান্তই লেখকের নিজের ঘরোয়া কথাবার্তা মনে হয়েছে। অরণ্যা সরকারের “কালো বাইক ও জলকন্যার দিন” গল্পের বর্ণনা ভালো কিন্তু মাঝে মাঝে প্লটের সাথে অন্য প্লটের সঙ্গতি রক্ষা হয়নি। গৌতম রায়ের “গুলশনের মা” গল্পের কাহিনী নির্মাণ ভালো কিন্তু কিছু উর্দু ভাষাজ্ঞান না থাকায় ভালো করে প্রধান চরিত্রের সংলাপের সাথে কমিউনিকেইট করা যায়নি। তবে কাহিনী নির্মাণ অসাধারণ হয়েছে। শ্যামল সরকারের “মনপাখির ডাক” এর আধ্যাত্মিকতার স্পর্শে বলা গল্পে মিতুর হারিয়ে যাওয়ার কারণ রহস্যের কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। মাহবুব আলীর “ফেরা না ফেরা” গল্পে খুকু নামক মেয়েটির জীবন কে প্রস্ফুটিত করতে গিয়ে বাগানের অসংখ্য মুকুলময় বৃক্ষকে যৌতুকের বলিদান হয়েও সংসার রক্ষা হয়নি। পরে দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে কিংবা আরবের শেখদের কাছ থেকে পতিতার লাশ হয়ে ফিরে আসাটা অনেকটা নিঃস্ব মায়ের কাছে যেন বালুচরে শূন্য বুকে এক উল্কাঝড়ের ভয়ংকর নিনাদ বলে মনে হয়েছে। সাবলীল গদ্যের ভাষায় গল্পটিতে চমৎকার কাহিনীর বয়ান হয়েছে।
সঞ্জয় মৌলিকের “গিরীধারীর গরুরচনা” গল্পটি সার্টিফিকেট বা ডিগ্রিধারী অকর্মক ব্যক্তিদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ হয়ে থাকবে। পুরঞ্জন দাসের “ক্ষয়” নামের গল্পের নামের সাথে সার্থক হয়েছে। সুব্রত নাগের “আত্মহত্যা বা নিছক মৃত্যুর” বিষয় বৈচিত্র্য খুব ভালো লেগেছে। শান্তনু ভট্টাচার্যের “মায়া সভ্যতা”র গল্পে কসমিক চরিত্রটাকে ভুতের সাথে তুলনা না করলে আরো ফিকশনধর্মী হতো। সাদিয়া সুলতানার “অন্ধকারের” গল্পটা আরো অন্ধকার হয়ে উঠতে পারতো কিন্তু হয়নি। কৌস্তুভ গাঙ্গুলীর “মানুষ ও মাছ গল্প” খারাপ লাগেনি।
গৌতম অধিকারী সম্পাদিত গল্পদেশের এটি ১ম বর্ষের ১ম সংখ্যা ছিলো। সে হিসেবে সংখ্যাটি খুব দারুণ হয়েছে। “আদি পর্বের গল্প”, অন্য গল্প” “ছোট গল্প”(সাম্প্রতিক) প্রবন্ধ(গল্প-বিষয়ক)”নিয়মিত বিভাগ” ইত্যাদি সংযোজনের মাধ্যমে সম্পাদক সংকলনটিকে দারুণ সমৃদ্ধ করেছেন। আশাকরি গল্পদেশ অচিরেই দুই-বাংলায় পাঠকপ্রিয় হবে। বিজ্ঞাপনহীন একটা পূর্ণাঙ্গ ত্রৈমাসিকের জন্য গৌতম অধিকারীকে ধন্যবাদ দিলে খুব কমই হবে। জয় হোক গল্প বিষয়ক সাময়িকী “গল্পদেশের”। শুভকামনা নিরন্তর।
গল্পদেশ,অক্টোবর, ১ম বর্ষ,১ম সংখ্যা,
সম্পাদকঃ গৌতম অধিকারী
পৃষ্ঠাঃঃ ২৫৬
মূল্যঃ ২২০ টাকা (বাংলাদেশী মুদ্রা)
কুরিয়ার বা ডাকঃ২৫০ টাকা
প্রাপ্তি স্থানঃ কবিতা ক্যাফে, ঢাকা।