পর্ব –১
চিরন্তন এক বাণী ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ কিন্তু আমার প্রশ্ন তারপরেও আমরা সে সুখ খুঁজতে চাইনা কেন? কেনই বা অজানা থাকি এর প্রাপ্তিমন্ত্র থেকে? যেখানে আমাদের মত দেশের বেশী সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ আমরা বাঁচি দূষিত বাতাসে, পথ চলি ময়লা আবর্জনা ছিটানো পথে, প্রত্যেকটা সবজি ফরমালিনযুক্ত, ভোজ্য পণ্য প্রিজারভেটিভ আরও কত বিষ মেশানো।
এতো বিষ নেয়ার পরেও অনেকে বছরের পর বছর তামাক/সিগারেট সেবন করে চলেছেন। দেশের বিরাট একটা অংশের মানুষ ছুটছে ভবিষ্যৎ ভোগান্তির দিকে। আমাদের শরীরটাও একটা মেশিন। তাই একে যেমন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে তেমনি ক্ষতিকর উপাদান মুক্ত রাখতে হবে। সেসবে তাই সর্বপ্রথম আলিঙ্গন করতে হবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। আমরা সবাই জানি অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস থেকেই পৃথিবী জুড়ে এই অস্থির অবস্থার জন্ম। হ্যাঁ দেশ হিসেবে এই রুপ বিভিন্ন রকমের হলেও মূলত খাদ্যাভ্যাস সব দেশের সুস্বাস্থ্যর জন্যই অনেক বড় ভূমিকা রাখে। তাই সময়, অবস্থান যত বাজেই হোকনা কেন পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে বাঁচতে শিখতে তো হবেই। তাছাড়া নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আয়ের তুলনায় আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খরচ অনেক কম অন্যান্য সমতুল্য দেশের তুলনায়। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অনেক স্বাবলম্বী মানুষের কাছেই তা বারতি চিন্তা আর অতিরিক্ত খরচের বিষয়। আমাদের দেশে চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি অনেক থাকলেও ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং উন্নত মানের ঔষধও অনেক রয়েছে। আপনাকে শুধু খুঁজে, বুঝে নিতে হবে। বাংলাদেশের ঔষধ খাতের গুনগত মান নিয়ে আমার একটা ছোট্ট গল্প আছে। তার আগে বলে নেই আমি বর্তমানে বাস করছি স্বাস্থ্য সচেতনতায় উল্লেখযোগ্য একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে।
এখানে এসেই প্রথম ভাল করে জানি আমাদের দেশ ঔষধ শিল্পে কতটা উন্নত। আমার আমেরিকান প্রফেসর একদিন বলছিলেন তার মেয়ে কম্বডিয়া (যেখানে প্রফেসরের শ্বশুরবাড়ি) গিয়ে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। সেখানে মেয়েটার দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে আর সেসময় প্রফেসর নিয়মিত ভালো কিছু মেডিসিন কিনতেন খুব সস্তায়। তাই একদিন ভাবলেন দেখিতো কোন দেশের মেডিসিন, তখন তিনি খুঁজে পেলেন মেডিসিনের গায়ে লিখা ‘ মেইড ইন বাংলাদেশ’। উনি খুব অবাক হয়েছিলেন ছোট দেশের এমন উন্নত মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রি দেখে আর তাই তিনি তার ক্লাস আমাকে পেয়ে একদিন তা শেয়ার করলেন। আমার খুব গর্ব হচ্ছিলো তখন। বিদেশ মাটিতে নিজের দেশের প্রশংসা কার না ভালোলাগে।
তাছাড়া সুস্বাস্থ্য নিয়ে জানতে এবং মানতে আমাদের সবার উচিৎ স্বাস্থ্যসম্মত দেশগুলোকে অনুকরন করা। সেক্ষেত্রে আমি কোরিয়ানদের জীবনযাপনটা কিছুটা তুলে ধরতে পারি। যদিও এই জাতির A to Z সুস্বাস্থ্যর দিকে মুখ করে জীবননামা সাজানো। উদাহরন যেকোনো বিষয়কে বাস্তবিক ভাবে বুঝে নেয়ার একটি অদ্বিতীয় পদ্ধতি। জাপান, কোরিয়ার এডভান্সড টেকনোলজি ছাড়াও সুস্বাস্থ্য বিখ্যাত তা প্রায় সবার জানা। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাই শুধু নয় দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলে স্বাস্থ্যকর প্রতিটি ধাপ। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কোরিয়ানরা।
আমাদের দেশের কয়েক বছরের বর্তমান চিত্র অনুযায়ী হার্ট, ডায়াবেটিস অথবা খুব বেশী ওজনের কারণে ভুক্তভোগীরা সকাল বা বিকাল বেলা নিয়ম করে হাঁটেন, ব্যায়াম করেন, পরিমিত খান। যদিও রোগের দেখা মেলার আগে এমন অভ্যাসের দেখা মেলা ভাঁড়।
এক্ষেত্রে কোরিয়ার চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে এদের নগর-পরিকল্পনা করা হয়। যা চিকিৎসাশাস্ত্রে অনেক উন্নত দেশেও করা হয়নি। কেবল স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। নগর-পরিকল্পনায় অন্যতম, পুরো শহরের নিচে লেক-পাড়ের দুই ধার ধরে একপাশে সাইক্লিং এবং অন্যপাশে হাঁটার রাস্তা। কিছুদূর পরপর সেখানে সবরকমের এক্সারসাইজ মেশিনও পাওয়া যাবে। কোরিয়াতে বিভিন্ন মৌসুমে অনেক প্রকারের ফুলে শহর সুসজ্জিত হয়ে যায়। আর যার সবচেয়ে ভালো রূপের দেখা মিলবে লেকের ধারগুলোতে। সেসব রাস্তায় শুধু হার্ট, ডায়াবেটিস অথবা অন্যকোনো রোগী মিলবেনা, পাওয়া যাবে সব বয়সের মানুষজন। বয়স ২ থেকে শুরু করে ৯০ ঊর্ধ্ব লোকজনকেও পাওয়া যাবে।
যাদের কেউ হাঁটছে, কেউ সাইক্লিং করছে, কেউবা আবার এক্সারসাইজ করছে, মোদ্দা কথা যার যা মন চায়। বাচ্চারা বেরোয় বাবা-মার হাত ধরে খোলা বাতাসে, কখনোবা তাদের পাওয়া যায় ছোট্ট রঙ্গিন স্কুটিতে ঘুরে বেরাতে। দৃশ্যগুলো কল্পনা করলেই স্বাস্থ্যকর একটা সমাজের চিত্র চোখে ভেসে উঠে। শহর সাঁজাতে কিংবা সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে এই কাজগুলোতে শুধু সরকারের একক অবদান থাকে তা নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেও এই কাজগুলো করে থাকে। একটা কথা ব্যক্তিগত ভাবে দেখেছি বলে পরিষ্কার করে বলতে পারি, দেশপ্রেম এদের মধ্যে গাঁড়। কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা বেজায়গায় পরে থাকতে দেখলে যেকোনো বয়সের মানুষকে তা উঠিয়ে জায়গা-মত ফেলতে দেখার দৃশ্য খুব অপরিচিত নয়।
শেখার কোন বয়স নাই, এই নীতি মেনে চলে এই দেশের মানুষজনও। কোরিয়ানদের গড় আয়ু ৯০ এর কোঠায় আর আমাদের ৭২.০৫ বছর ২০১৭ এর ডাটা অনুযায়ী। পঞ্চাশের পর কোরিয়ানদের যেখানে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করার পদ্ধতি অবলম্বন করে, সেই বয়সে বাংলাদেশিরা অবসর নিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে থাকে অনেকটা। বার্ধক্য মেনে নেয়া আমাদের দেশের এক প্রকারের প্রথা হয়ে উঠেছে। তাই মনের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা তো অবান্তর সেখানে। এমন দৃশ্যও দেখতে মেলে, বয়স্ক মানুষকে গান শুনতে দেখলেও নেতিবাচক ভাবে দেখা হয়। একটা দেশের সমাজের এমন পদ্ধতিই তো জনসংখ্যা-আধিক্য কমানোর অন্যতম কারণ হতে পারেনা। অভিজ্ঞ জাতি বটবৃক্ষ স্বরূপ। কোরিয়া, জাপানি বয়স্কদের জন্যে কাজের স্তর আলাদা করা থাকে। কিছু বিশেষ ব্যবসা যা শুধু বয়স্করাই করতে পারে, সেসব ব্যবসায় যুবদের জায়গা নেই।
সেসব জাতি মেনে চলে, শরীরও এক প্রকার মেশিন। যতদিন কাজে থাকবে, ক্ষয় ততই কম পাবে। জাপান যাকে সর্বোচ্চ বয়সের ভূমি বলা হয়, ২০১৮ সালে ১১৭ বছর ২৬০ দিন বয়সে মারা গেলেন নবি তাজিমা। সর্বোচ্চ বয়সধারী এসব ব্যক্তিদের কাহিনী পরলে পাওয়া যায়, তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন না কোন কাজে যুক্ত থাকতেন। মেনে চলেন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত শারীরিক কসরত এবং যত্ন নেন নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্যের। বিভিন্ন রকম মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতেও তারা ব্যক্তিগতভাবেও এ-যত্ন নিতে পিছিয়ে নেই। তারই এক সুন্দর উদাহরণ গ্রীষ্মে প্রত্যেকটা বাড়ি ভর্তি ফুল-ফল আর সব্জির গাছে সজ্জিত বাগানগুলো।
লেখক: তাহ্ নিয়া কাদের, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, হানকুক ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ, দক্ষিণ কোরিয়া।